বিরল রোগে আক্রান্ত এক শিশুর খোঁজ মিলেছে হবিগঞ্জে। ১১ বছর বয়সী ওই শিশু দেখতে অনেকটাই বুড়োদের মতো। চিকিৎসকরা বলছেন, এ রোগে আক্রান্তদের গড় আয়ু মাত্র ১৩ বছর। জীবনের শেষ সময়টুকুতে সন্তানকে প্রাপ্য সেবাটুকু দিতে পারছেন না সর্বশান্তপ্রায় পরিবারটি। চিকিৎসকরা অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিলেও মেয়ের জন্য স্বপ্ন দেখছেন তার মা-বাবা।
হবিগঞ্জ শহরের শায়েস্তানগর এলাকার বাসিন্দা ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী কামরুল হাসানের স্ত্রী জোৎস্না বেগমের গর্ভে ২০০৭ সালে নিতু’র জন্ম হয়। জন্মের ৩ মাস পর নিতু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এতে নিতুর হাত, পা, মুখ, শরীরের চামড়া শুকিয়ে আস্তে আস্তে বৃদ্ধদের রূপ ধারণ করে। পরবর্তীতে হবিগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে চিকিৎসা করেন নিতুর মা-বাবা। কিন্তু এর কোন সমাধান না পেয়ে নিতুর মা-বাবা সিলেটে দু’বছর চিকিৎসা করান। এতেও কোন ফল পাননি। কয়েকদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়ে নিতু। দিশেহারা হয়ে পড়েন নিতুর মা-বাবা।
এক পর্যায় ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতুর মা-বাবা তার চিকিৎসা শুরু করেন। সেখানে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নিতুর চিকিৎসা করানো হয়। অনেক গবেষণা করে চিকিৎসকরা তার মা-বাবাকে জানান, নিতু প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত। এ ধরণের রোগীরা অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকেন। চিকিৎসা করে এর কোন ফলাফল পাওয়া যায় না।
পরবর্তীতে ঢাকার চিকিৎসক হবিগঞ্জের ডাক্তারদের দ্বারা চিকিৎসা করার পরামর্শ দেন। গত বছর ৩ মাস পর্যন্ত প্রায় মৃত্যুশয্যায় ছিলো নিতু। এ সময় নিতু খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তরল খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। চিকিৎসকদের কাছে নিলে তাকে ৮টি ইঞ্জেকশন দেন। কিন্তু নিতুর শরীর শুকিয়ে গিয়ে মাংস শক্ত হয়ে যাওয়া ইঞ্জেকশন পুশ করতে গেলে সুই ভেঙ্গে যায়। এমতাবস্থায় ৬ মাস অসুস্থ থাকে নিতু।
এদিকে মেয়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে জায়গা জমি বিক্রি করে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে গেছেন নিতুর বাবা কামরুল ইসলাম কমরুল। নিতু বয়সে ১১ বছরের হলেও চুলহীন মাথা আর ভাজপড়া চামড়া দেখে তার বয়স বুঝার উপায় নেই। বিরল প্রজেরিয়া রোগে আক্রান্ত সে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের হিসাবে ৪০ লাখ মানুষের মধ্যে এমন রোগাক্রান্ত লোকের সংখ্যা মাত্র একজন। অল্প বয়সে বুড়িয়ে যাওয়ায় এ রোগে আক্রান্তদের গড় আয়ু সাধারণত ১৩ বছর। এরই মধ্যে শারীরিক নানা জটিলতায় ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট এ শিশুটি। ৬ সন্তানের মধ্যে ৩য় নিতুর চিকিৎসার খরচ যোগাতে নিতুর পরিবার এখন প্রায় নিঃস্ব, বাবার ব্যবসাও লাটে উঠেছে।
এ ব্যাপারে নিতু বাবা কামরুল ইসলাম কমরু ও মা জোৎস্না বেগম জানান, নিতু’র চিকিৎসা করতে করতে তারা সব কিছু বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসকরা জানিয়েছেন এ ধরণের রোগীরা বেশিদিন বাঁচে না। চিকিৎসা করিয়ে কোন লাভ হবে না। তারপরও আমরা নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে চিকিৎসা সেবা করে যাচ্ছি।
তারা জানান, নিতু তাসনুভা-শামীম ফাউন্ডেশনের প্রতিবন্ধী স্কুলে লেখাপড়া করছে। সে লেখাপড়ায় ভাল। যেমন লিখতে পারে, তেমিন আর্ট করতে পারে। অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে লেখাধুলা করলেও কথা বলতো খুবই কম। এছাড়া অধিকাংশ সময় সে অসুস্থ থাকে। ইদানিং হবিগঞ্জ পিডিবি’র নির্বাহী প্রকৌশলী শামছ-ই-আরেফিন এর সহধর্মীনি বাংলাদেশ মাদকবিরোধী শক্তি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, নারী সমাজকর্মী চৌধুরী জান্নাত রাখীর সাথে তাদের পরিচয় হয়। তারপর রাখী নিতুকে নিজের সন্তানের মত দেখাশোনা করেন। এখন নিতু অনেকটা স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা ও খেলাধুলা করে। আর নিতুর অধিকাংশ সময় কাটে রাখী’র বাসায় তার সন্তানদের সাথে খেলা করে। রাখীর শিশুরাও নিতুকে আপন করে নিয়েছে বোনের মতো।
এদিকে নিতু যাতে টেলিভিশন দেখতে পারে এ জন্য চৌধুরী জান্নাত রাখী তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে টেলিভিশন ক্রয় করে দিয়েছেন। এজন্য তারা চৌধুরী জান্নাত রাখীর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। সরকারী কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নিতু’র বাবা কামরুল ইসলাম বলেন, গত বছর পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ তাদের ডেকে নিয়ে ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন। আর প্রতি মাসে প্রতিবন্ধী ভাতা ৭শ’ টাকা পাচ্ছেন। কিন্তু নিতু’র অনেক চাহিদা থাকে। বিভিন্ন সময় চাইলে তাদের তা ক্রয় করে দিতে হয়। নিতু’র চিকিৎসার ঔষধের টাকার জন্য তাদের বিপাকে পড়তে হয়। তারপর নিজের মেয়েকে লালন পালনে তারা কোন ধরণের ত্রুটি রাখছেন না। তারা এখনও স্বপ্ন দেখছেন, নিতু অনেকদিন বেঁচে থাকবে।
নিতুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক শেখ ফয়জুুল হক জানান, নিতুকে নিয়ে তাদের স্কুলের যাত্রা শুরু হয়েছিল। নিতু অনেক ভাল ছাত্র। সে অসুস্থ থাকার কারণে নিয়মিত স্কুলে আসতে পারে না। তবে নিতুর পড়ালেখার পাশাপাশি ছবি আঁকায়ও তার আগ্রহ রয়েছে। তার কর্মকান্ডে আমরা শিক্ষকরা খুশি।
হবিগঞ্জ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, নিতুকে তিনি দেখেছেন। তাকে বর্তমানে ৭শ’ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাকে কোন বড় সহযোগিতা করা যায় কি না সেটি আমরা ভেবে দেখছি।
হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ অধ্যক্ষ ডা. মো. আবু সুফিয়ান জানান, আমাদের বয়স হলে যেমন শরীরের কাঠামো তৈরী হয়, তার শরীরের সে ধরণের কাঠামো তৈরী হয়েছে। আমরা একজন বুড়ো মানুষকে যেভাবে যত্ন নেই। তাদেরকে সে ধরণের যত্ন নিতে হবে। তিনি বলেন- এসব বাচ্চারা বেশিদিন বাঁচে না। তাদের গড় আয়ু হলো ১৩ বছর। তাদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। এতে যতদিন তারা বেঁচে থাকবে জীবনটা ভাল কাটাতে পারবে। তবে এ রোগের কোন চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই বলে তিনি জানান।
বিডি প্রতিদিন/৩০ এপ্রিল ২০১৮/হিমেল