যখন খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটায় ঠিক তখনই কিস্তির ও সুদের টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে ভাঙন কবলিতরা। চড়া সুদে টাকা এনে অনেকেই কৃষি কাজ ও ব্যবসা করত। অনেকের নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বাড়ি ঘর দোকান-পাট। কিস্তির টাকা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কয়েকশ' পরিবার। জীবন বাজি রেখে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে তারা। নেই শিশুদের জন্য ঔষধ খাওনোর টাকা-পয়সা। আবার যুবতি মেয়েদের নেই কোন নিরাপত্তা এমনটাই জানালেন শরীয়তপুরে নড়িয়া উপজেলার ভাঙন কবলিতরা। অবশ্য পুলিশ বলছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
বর্ষা মৌষমে ৫ হাজার ৮২ পরিবরের তালিকা করেছে উপজেলা প্রশাসন। এবার ভাঙনে ২শ'র উপরে ২য় থেকে ৪তলা ভবন নদী গর্ভে বিলিন হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রসাশন। এ পর্যন্ত ভাঙন কবলিতদের আয়ের জন্য কোন ব্যবস্থা করতে পারেনি প্রশাসন। তবে বলছে, নির্মাণ কাজ চলছে।
এদিকে, সরকারের কাছে কিস্তি থেকে মুক্তির করার দাবি জানিয়েছে ভাঙন কবলিতরা। ভাঙন রক্ষার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নদীর ঘাটে এসে কান্নাকাটি করছেন।
খোলা আকাশের নিচে থালা বাসন ছাই দিয়ে মাজছিলেন আর চোখের পানি ফেলছিলেন নড়িয়া উপজেলার কেদারপুর ইউনিয়নের চর জুজিরা গ্রামের মেঘলা বেগম। কাছে গিয়ে কারণ জানতে চাইলে হাফিয়ে কান্না শুরু করেন তিনি।
কথা হয় মেঘলা বেগমের সাথে তিনি জানান, গরিব কিন্তু স্বামী শহীদুল ইসলাম, সন্তান, ভাই ও মাকে নিয়ে এক খণ্ড জমিতে সুখেই কাটছিল তার সংসার। স্বামী কৃষি কাজ করতেন। আর ভাই রিকসা চালাতো, সেই আয় নিয়ে সংসার ছিল তার। হঠাৎ একদিন সেই জমিটুকু পদ্মার নদী গর্ভে চলে যায়। দুঃখ-কষ্ট নিয়ে সেখান থেকে প্রথমে কেদারপুর লস্কর বাড়ির বাগানে আশ্রয় নেন। সেই বাগানও নদী গর্ভে চলে যায়। এখন পরিবার নিয়ে কেদারপুর মিয়া বাড়ির মাঠে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
এখানে কিভাবে দিন কাটছে জানতে চাইলে মেঘলা বেগম বলেন, একটি এলাকায় আমরা অনেকেই বাস করতাম। সবার বাড়ি ঘর যা ছিল তা নদীতে ভেঙে নিয়ে গেছে। দুইবার ভাঙার পর এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি আমরা। অনেক কষ্ট হয় খোলা আকাশের নিচে থাকতে। আগে তিন বেলা খেতাম, এখন এক বেলা খেয়ে বেঁচে আছি। দিন হলে রোদে পুুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি। আর রাতে পোকার কামড় খাই। কোন বিদ্যুতের আলো নেই এখানে। চোরের ভয়ে রাত জেগে থাকতে হয়। আমার দুই বছরের একটি সন্তান আছে। এখানে কোন বিছানা নেই। রাতে অন্ধকারে ছেলেকে নিয়ে মাটিতে থাকতে হয়।
তিনি বলেন, আমার স্বামী কৃষি কাজ করতো, ভাই রিকসা চালাতো। এখন রাস্তা ভেঙে যাওয়ায়, ফসলি জমি নদীতে চলে যাওয়ায় কাজও বন্ধ। নদী ভেঙে যাওয়ায় অনেক গরিব হয়ে গেছি। এতো কষ্ট, তার উপর আবার কিস্তি। প্রতিদিন স্যারেরা আসেন কিস্তির টাকার জন্য। কিস্তি না দিলে খারাপ আচরণ করেন স্যারেরা। কিছু দিন পরে যদি কিস্তিগুলো নিতো তা হলে ভাল হতো। আর সরকার যদি সাহায্য করতো আমরা বাঁচতে পারতাম।
মিয়া বাড়ির মাঠে খোলা আকাশের নিচে মেঘলা বেগমের পরিবারের মত বসবাস দশটি পরিবারের। বসত ভিটা হারিয়ে ওই মানুষগুলোর বুক জুড়ে হাহাকার।
গত দুই সপ্তাহ আগে তাদের বাপ-দাদার বসত বাড়িতে বাস করতেন তারা। গত ৬ সেপ্টেম্বর পদ্মার প্রবল ভাঙন শুরু হয় সেই ভাঙনে তাদের বাপ-দাদার ঘরবাড়ি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। কোন রকমে ঘরের আসবাবপত্র সরাতে পারলেও চিরতরে হারিয়ে যায় বাপ-দাদার ভিটে মাটি। সব হারানোর পর অন্যের জমিতে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে পরিবারগুলো। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথার উপর ছাপড়া দিয়ে সন্তান, বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তারা। গত ১০ দিনে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি পারিবারকে ৩০ কেজি চাল দেয়া হয়েছে। ৩০ কেজি করে চালে তাদের এতো বড় সংসার চলছে না। তারা বাঁচতে চায়, একটু আশ্রয় চায়। পরিবারের সদস্যগুলো বিভিন্ন রোগে ভুগছে বলে জানান তারা। পরিবারগুলো বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও থেকে ঋণ এনেছিল, কিস্তি নিতে সেই এনজিও’র কর্মীরা চাপ প্রয়োগ করছেন।
রাশ মনি দাস জানান, আমার স্বামী মূলফৎগঞ্জ বাজারে মাঠার দোকান করতো। এক মাস সাত দিন হলো আমাদের ঘরবাড়ি, দোকান পাট নদীতে চলে গেছে। সব হারিয়ে কেদারপুর মিয়া বাড়ির মাঠের রাস্তার পাশে কোন রকম মাথা গুজেছি। আমার দুইটি সন্তান ছেলে অনিক দাস আর মেয়ে প্রিয়া দাস। নদীতে আমাদের সব নিয়ে যাওয়ায় ছেলে মেয়েদের পড়া-লেখা বন্ধ হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, জীবন বাঁচাতে আমার স্বামী বাজারে বাজারে গিয়ে বাদাম বিক্রি করছেন। এতে আর সংসার চলে না। তার উপর আবার কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমরা খাইতে পাই না, কিস্তি দিমু কিভাবে। প্রতিদিন কিস্তির স্যারেরা এসে চাপ প্রয়োগ করছেন। এ সময় যদি কিস্তিটা বন্ধ রাখা যেত ভালো হত। আমি এক বছর যাবৎ প্যারালাসেস-এ ভুগছি। আমার চিকিৎসার জন্য স্বামী কিস্তি তুলেছিল। কিন্তু কিস্তি দিব দূরের কথা ঔষধ কিনতে পারছি না।
মৃত্যু আব্দুল বারেক গাজির স্ত্রী মাসুদা বেগম (৬০) বলেন, কেদারপুর চর জুজিরা গ্রামে ২১ শতাংশ জমির ছিল আমার। ছয় বছর সেই বাড়িতে আমরা থেকেছি। নদীতে সেই জমি বাড়ি নিয়ে গেছে। এখন অনেক অভাব, টাকার জন্য কিছু খেতে পারছি না, ঘর তুলতে পারছি না। একটি ছেলে তাও প্রতিবন্ধী। কয়েকদিন যাবৎ ডাল দিয়ে ভাত খাচ্ছি। তা খেয়ে গলা জলে যাচ্ছে। আল্লাহ ছাড়া আমাদের দেখার কেউ নাই। উপরে ছাপড়া দিয়ে কোন রকমে থাকি। দুইদিন রাতে চোর এসেছিল এখানে। থাকার কোন স্থান নাই, আমরা কোথায় যাব। চেয়ারম্যান মেম্বররা কিছু দিলে দিছে, না দিলেও দিছে। তা বলে আর লাভ কি?
নড়িয়া থানার ওসি মো. আসলাম উদ্দিন বলেন, ভাঙন এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে নিরাপত্তার জন্য আরো পুলিশ মোতায়ন করা হবে।
তবে জেলা প্রশাসন বলেছে, আগামী পাঁচ মাস ভাঙন কবলিত এলাকায় ঋণ দেওয়া কোন সংস্থা, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কিস্তি আদায় বন্ধ রাখবে। কিন্তু তারপরও বিভিন্ন এনজিও, ব্যাংক ও বীমা ভাঙন কবলিতদের কাছ থেকে কিস্তির টাকার জন্য প্রতিদিন চাপ প্রয়োগ করছেন।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে চাল, শুকনা খাবার ও টিন বিতরণ অব্যাহত আছে। যে সকল ব্যবসায়ীরা ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কাজ করবে সরকার। আমাদের কৃষি ঋণ কমিটির মিটিং হয় গেল, মিটিং-এ জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা হচ্ছে নদী ভাঙন কবলিত এলাকায় যে সকল ব্যবসায়ী ব্যাংক বিমা ও এনজিও থেকে লোন গ্রহণ করেছে তাদের পরিষ্কার ডিসি স্যার চিঠি দিয়ে দিয়েছে। সেখানে আগামী পাঁচ মাস ঋণের কিস্তি আদায় কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রাখার জন্য জেলা প্রশাসকেরপক্ষ থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চিঠির কপি ব্যাংক, বিমা ও এনজিওদের পৌঁছে দিয়েছি।
বিডি-প্রতিদিন/১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮/মাহবুব