ঠাকুরগাঁও হরিপুর উপজেলার বহরমপুর চরভিটা গ্রামের এরফান আলী ছিলেন একজন পরাটা ও চা বিক্রেতা। ১৯৯৯ সালে বহরমপুর টি-ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ ও ২০০১ সালে যাদুরানী মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করেন।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশের বহরমপুর ছোট বাজারে চা-পরাটার দোকান দেয় এরফান। ওই বাজারেই তার বাবা নুুরুল ইসলামেরও আছে মুদি দোকান। দুই ভাই, ৬ বোনসহ ১০ জন সদস্যের সংসারে বাবাকে সহযোগিতা করতেই লেখাপাড়ার পাশাপাশি চা-পরাটা বিক্রি করতেন এরফান।
তখন ওই গ্রামে শতভাগ সাক্ষরতার হার ছিল না। তাই দৃঢ় প্রত্যয়ে ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামটিতে শিক্ষার আলো ছড়ানোর পণ করেন তিনি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে নিজের মনোবল ও প্রচেষ্টায় ২০০১ সালে নিজের ধান ক্ষেতে বাঁশের ঘর তুলে স্থাপন করেন-চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়।
সফল হবে না ভেবে এলাকার মানুষ তাকে ডাকতেন 'পাগল এরফান'। মানসিক পাগল নয়, শিক্ষার আলো ছড়াতেই পাগলামী-এমন প্রত্যয় নিয়ে বসে নেই এরফান। শুরুতে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। এর পরেও পেছনে তাকায়নি সে। এলাকার দ্বারে দ্বারে ঘুরে ৪০জন শিক্ষার্থী সংগ্রহ করে ২০১১ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের পাঠদানের অনুমতি পায় এরফান আলী। ৫টি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিয়ে রাত-দিন পড়ে থাকতেন বিদ্যালয়ে। ক্লাস পরীক্ষা আর বছরের কিছু গদবাঁধা আয়োজন। এর বাহিরেও যে কিছু থাকতে পারে তার প্রমাণ চরভিটা স্কুল।
প্রধান শিক্ষক এরফান আলী সেই প্রচলিত ধারণা যেন পাল্টে দিয়েছেন। সবুজে ঘেরা একটুকরো জমিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্কুল, দেয়ালে জলজল করছে বিখ্যাত মানুষদের ছবি আর মনীষীদের নানা উক্তি। আর স্কুলে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখতে ও পাঠদানে আনন্দ বাড়িয়ে দেয় নানা ধরনের খেলার উপকরণ।
পাশের হার ঈর্ষাণীয় হওয়ায় এই অজো পাড়াগাঁয়ের স্কুলটি সরকারিকরণ হয় ২০১৩ সালে, তবে সে ঘোষণা আসে ২০১৫ সালে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় মনোযোগী করতে ২০১৪ সালে নিজ খরচে চালু করেন “মিডে মিল”। মানে সাপ্তাহে দুই দিন দুপুরে এক বেলা খাবার।
একদিন ডিম-খিচুরী, অন্যদিন মাছ-ভাত। শুরুতে প্রধান শিক্ষক নিজের ও অভিভাবকদের কাছ থেকে মুষ্টি চাল সংগ্রহ করে মিডডে মিল চালু করেন। এখন আর মুষ্টি চাল নিতে হয় না। ১শ শতকের এই স্কুলে ৬৬ শতকের একটি পুকুর আছে। সেখানে মাছ চাষ আর হাস-মুরগি পালন করে বছরে আয় ২ লাখ টাকা। আর ১০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে করেছেন আমের বাগান। সেখান থেকে বছরে আয় হয় ৩লাখ টাকা। সে আয় থেকেই এখন ৩২০জন শিক্ষার্থীদের মিড-ডে মিলের খরচ বহন করে বিদ্যালয়টি। আর মিড-ডে মিলে বছরে খচর হয় ৬লাখ টাকা। অবিশিষ্ট টাকার যোগান দেন বিদ্যালয়ের এই প্রধান শিক্ষক এরফান আলী।
২০১৫ সালে ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য শুরু করেন বিনা খরচে সান্ধ্যকালীন বাড়তি ক্লাস। সৌর বিদ্যুতের আলোতে সন্ধ্যা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলে অতিরিক্ত এই ক্লাস। এতে শিক্ষার্থীরা লোখাপড়ায় মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি বাড়তে থাকে পাশের হারও। স্বস্তি নামে এলাকার গরীব অভিভাবকদের মাঝে, তাই খুশি তারাও। এজন্য বিদ্যালয়ে ৩২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য আছে চার জন শিক্ষক। চাপ বেশি হওয়ায় আরো তিনজন প্যারাশিক্ষকও নিয়েছেন প্রাধান শিক্ষক। এর খরচও বহন করেন এরফান আলী।
এই বিদ্যালয়ের মিড ডে মিলে সফল হওয়ায় ২০১৬ সালে ১৬ আগস্ট প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সমন্বয় সভায় চরভিটা প্রথমিক বিদ্যালয়কে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর পরিপত্র জারি করে সারা দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে দেয়। সেই চা বিক্রেতা এরফান আলী ২০০৮ সালে রাজধানীর একটি বে-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে এখন ওই বিদ্যালয়ের সফল প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক।
বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী হাসনারা আক্তার ও ৫ম শ্রেণির খাবিরুন আক্তার জানায়, এই বিদ্যালয়টি এই এলাকার সোনার টুকরো। পরিবেশ এতই ভাল যে বাড়িতে লোখাপড়া করতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় এখানেই থাকি।
৬ষ্ঠ শ্রেণির আইরিন আক্তার এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ৩য় শ্রেণিতে। বাবা রাজ মিস্ত্রী-মা একজন গৃহিনী। লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করতে হিমসিম খায় তার পরিবার। কিন্তু এই বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত কোন খরচ না থাকায় এবার নতুন করে চালু করা ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে আইরিন।
৫ম শ্রেণির রিয়াজ জানায়, এখানে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা, সঙ্গীত ও পুকুরে নৌকা দিয়ে ঘুরানো হয়। বিদ্যালয়ের চারপাশ ফুল ফল আর সবুজ পাতাসহ নানা রঙের পরিবেশ। এতই ভাল লাগে যে সে অনুভূতি বোঝানো যাবে না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এরফান আলী বলেন, আমি পাগল শিক্ষার। শিক্ষার আলো ছড়াতে এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে আরো নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর ডিডি (নিয়োগ শাখা) একেএম সাফায়েত আলী সম্প্রতি পরিদর্শনে এসে শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার ল্যাব উদ্বোধন করেন।
এসময় তিনি বলেন, এই বিদ্যালয়টি পরিচ্ছন্ন। শিক্ষার মান ও পাশের হার সন্তোষ জনক। এছাড়াও অন্যান্য কারিক্যুলাম এক্টিভিটিস থাকায় শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে পেরেছে শিক্ষার্থীরা। খুব শিগগিরই এই বিদ্যালয়ে নতুন ভবন দেয়া হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেই এর মান আরো বেড়ে যাবে বলে জানান তিনি।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন