দশম শ্রেণির ছাত্রী স্বর্ণার দিনরাত কাটছে এখন হাসপাতালে অসুস্থ্য মায়ের পাশে। গত চারদিন ধরে বই নিয়ে বসা হয়নি তার। আপন কাকা সমির হাওলাদারের নির্মম নির্যাতন ও মারধরের যন্ত্রনায় বাসন্তী রানী যখন ছটফট করে তখন মায়ের মাথার পাশে বসে শান্ত্বনা দিচ্ছে তার বড় মেয় স্বর্ণা।
মা ও বোনের এ কষ্ট কাছ থেকে দেখছে ছোট বোন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সমাপ্তি। মা দিবসে সকল ছেলে-মেয়েরা যখন মায়ের সাথে হাসি, আনন্দে সময় কাটাচ্ছে তখন পিতৃহীন এ দুইবোন হাসপাতালের গ্রিল ধরে লুকিয়ে চোখের জল ফেলছে। হয়তো প্রকৃতির কাছেই বিচার চাইছে তারা।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া হাসপাতালে রবিবার দুপুরে কথা হয় বাসন্তী রানীর সাথে। উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নিজকাটা গ্রামের এ গৃহবধু স্কুলের গণ্ডি পার হতেই বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। বয়স মাত্র ২৮ হলেও স্বামীকে হারিয়েছেন এক যুগ আগে। তখন ছোট মেয়ে দুই মাসের গর্ভবতী। নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে কখনও রাস্তার মাটি কেটে, হোগলা বুনে দুই মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। দুই মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষতের স্বপ্ন দেখে বিসর্জন দিয়েছেন নিজের ভবিষ্যৎ। বড় মেয়ে স্বর্ণা এখন পাখিমারা প্রফুল্ল ভৌমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দমশ শ্রেণিতে ও ছোট মেয়ে সমাপ্তি নিজকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে।
অহত বাসন্তী রানী জানান, তাদের আতঙ্ক এখন দেবর সমির হাওলাদার। স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটা দখল নিতে একের পর এক চক্রান্তের পর এবার তাদের ঘর থেকে বের করে তালা ঝুলিয়ে উঠানে ফেলে নির্যাতন করে। রডের আঘাতে মাথা ফেটে যায়। মাথা থেকে প্রচণ্ড রক্ত বের হলেও নির্যাতন থামেনি। দুই মেয়ে মায়ের ওপর নির্যাতন করতে দেখে কাকাকে বাধা দিলেও তাদেরও মারধর করে। গত ৮ মে বিকালে এ ঘটনা ঘটেছে। এ সময় প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলে তাদের ওপরও হামলা চালায় সমির।
এ হামলার খবর দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে গ্রামবাসী একজোট হয়ে এগিয়ে আসলে সমির পালিয়ে যায়। ওই রাতেই মা, দুই মেয়ে ও এক প্রতিবেশীকে কলাপাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ ঘটনায় ৯ মে কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেবর সমির ও তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী পুতুল রানীর নামে মামলা দায়ের করেন বাসন্তী রানী। আদালত কলাপাড়া থানার ওসিকে মামলাটি এজাহার হিসেবে নেওয়ার নির্দেশ দেন। মায়ের ওপর নির্মম নির্যাতনের দৃশ্য এখনও ভুলতে পারেনি দশম শ্রেণির ছাত্রী স্বর্ণা।
স্বর্ণা জানায়, মায়ের মাথা থেকে যখন রক্ত বের হচ্ছিল তখনও তাকে কিল ঘুষি ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক মেরেই যাচ্ছে তার কাকা। সে দৌঁড়ে গায়ের ওড়না দিয়ে মায়ের মাথার ক্ষতস্থান বাঁধতে গেলে তাকেও মারধর করে।
স্বর্ণা জানায়, আজ সব বন্ধুরা মাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে, ঘরে কতো ভালো মন্দ রান্না হবে। কিন্তু আমার মা তো যন্ত্রনায় ছটফট করছে। মায়ের চোখের জল আমাদের দুই বোনকে ভুলিয়ে দেয় এ দিবসের কথা। বাবার মুখটা মনে নেই আমার। ছোট বোনতো বাবাকেই দেখেনি। মায়ের ঘামে ভেঁজা কষ্টের শ্রমে তারা দু’মুঠো ভাত খেয়ে লেখাপড়া করছে। কিন্তু আজ যদি মায়ের কিছু হয়ে যায় তখন কে দেখবে তাদের। তারা তো এতিম হয়ে যাবেন। তার মাকে যারা মেরেছে তাদের কী শাস্তি হবে না এ প্রশ্ন করে কেঁদে ফেলে তারা। এই দুই বোনের চোখের জল ও আর্তনাদ দেখে হাসপাতালে অন্য রোগীর স্বজনরাও চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন