এতদিন টের পাওয়া যায়নি। এখন পাওয়া যাচ্ছে। বগুড়ায় বিএনপির ঘরে ছিল দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব নিয়ে বিএনপি চললেও নেতাদের কোনো কারসাজি ছিল না। ছিল সাধারণ ভোটারদের। বগুড়ার বিএনপি নেতাদের মেধা শক্তি দিয়ে চলে না, চলে লন্ডনের ছকে। বিএনপির নেতারা এতদিন পদের পাওয়ার খাটিয়েছে মাত্র।
আর সাধারণ ভোটাররা উন্নয়নের আশায় বারবার ধানের শীষে ভোট দিলেও নেতারা থেকেছেন গলা সমান দ্বন্দ্ব নিয়ে। এবার এই দ্বন্দ্বের জেরে বিএনপির ইতিহাসে প্রথমবার আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। নিজের ঘরে নিজেই দেয় তালা, দেয় আগুন, করে ভাঙচুর। বগুড়ার বিএনপি এখন ক্ষমতার মোহে আত্মঘাতী।
বগুড়া জেলা বিএনপির কার্যালয় ঘুরে জানা গেছে, কার্যালয় ঘিরে এখন বইছে উত্তেজনা। গুটি কয়েক নেতা বিএনপির ঘরে কাদা ছুঁড়ছে। ঝুলছে তালা, ভাঙছে তালা, হচ্ছে বহিষ্কার, জ্বলছে আগুন। এই হচ্ছে বগুড়া জেলা বিএনপির বর্তমান অবস্থা।
নতুন আহ্বায়ক কমিটি কেন্দ্র করে এখন বিএনপি’র দু’গ্রুপ দুই মেরুতে। ঘাটি খ্যাত বগুড়া জেলা বিএনপির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে। যেকোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে দখল পাল্টা দখলকে কেন্দ্র করে যুবদল ও ছাত্রদলের ৮ নেতা বহিষ্কার হয়েছে সংগঠন থেকে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বগুড়া জেলা কমিটি শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত ২৫ এপ্রিল জেলা বিএনপির নেতৃত্বস্থানীয় নেতাদের ডেকে পাঠানো হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিসে। সেখানে জেলা বিএনপি নেতাদের সাথে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের কমিটি নিয়ে বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে জেলা কমিটির নেতারা উত্তেজিত হয়ে উঠলে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে বাকবিতণ্ডা জড়িয়ে পরেন। এ ঘটনার পর জেলা বিএনপি থেকে সদস্য পদ স্থগিত করা হয় মেহেদি হাসান হিমু ও পরিমল চন্দ্র দাসের। বহিষ্কৃত দুইজনই বিএনপির নিবেদিত নেতা। এই খবর জেলায় পৌঁছালে বিএনপি অফিসে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ করে ভিপি সাইফুল ইসলাম এর অনুসারিরা।
পরদিনে কেন্দ্রীয় নির্দেশে ভিপি সাইফুলসহ নেতৃবৃন্দ সেই তালা খুলে কার্যক্রম চালায়। ২৯ এপ্রিল সাধারণ সভা ডাকা হয় বিএনপি কার্যালয়ে। ওই সভায় জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন চানসহ নেতা-কর্মীরা উপস্থিত হয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে। একই দিন সন্ধ্যায় সাবেক সংসদ সদস্য হেলালুজ্জামান লালুর বাড়িতে বৈঠক করে। পাল্টা আহ্বায়ক কমিটি করে কেন্দ্রে পাঠায়। দুটি কমিটি গঠনেই জেলা বিএনপির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। এরই প্রেক্ষিতে কেন্দ্র থেকে বগুড়া জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত করার পর ১৫ মে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট জেলা কমিটি ঘোষণা করে। কমিটিতে ভিপি সাইফুল ইসলাম এর অনুসারিদের নাম বেশি না থাকায় বিক্ষোভ দেখায় তার অনুসারীরা।
স্বেচ্ছাসেবক দল, যুবদল, ছাত্রদল ও অপর সহযোগী সংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী ও বঞ্চিতরা নতুন ঘোষিত আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা সন্ধ্যায় শহরের নবাববাড়ি সড়কের দলীয় কার্যালয়ের সামনে নতুন কমিটির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে অবস্থান ও দলীয় কার্যালয়ের দখল নেয়। একপর্যায়ে তারা দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। সেখানে পুলিশ পর্যন্ত মোতায়েন হয়। পরে রাত সাড়ে ১০ টার দিকে নতুন দায়িত্ব পাওয়া আহ্বায়ক কমিটি ও ছাত্রদল নেতৃবৃন্দ জেলা বিএনপি’র অফিসে গিয়ে পদবঞ্চিতদের গ্রুপের দেয়া তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে দখল নেয়। সেখানে তারা গভীর রাত পর্যন্ত অবস্থান নেয়।
জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে থেকে জেলা বিএনপির যে ছক করছেন তা নিয়েই জেলা বিএনপিকে চলতে হবে।
বগুড়ার বিএনপি নেতা সাবেক বগুড়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আলী আজগর হেনা জানান, দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলেছি। কারা যেন তালা দিয়েছিল। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য হেলালুজ্জামান তালুকদার লালুর বাড়িতে যান। সেখানে রাখা কিছু মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছে কে বা কারা।
এদিকে বিএনপি সূত্র জানায়, দলীয় কার্যালয়ে তালা লাগানো, আগুন ও সাবেক সংসদ সদস্যর বাসায় হামলার ঘটনায় বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পৌর কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেন পশারি হিরু, তৌহিদুল ইসলাম বিটু, জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুকুল ইসলাম ফারুক, যুগ্ম সম্পাদক মাসুদ রানাসহ ৬ জনকে বহিষ্কার এবং জেলা ছাত্রদলের সিনিয়ার সহ-সভাপতি আবু জাফর জেমস ও সাংগঠনিক সম্পাদক রবিউল ইসলাম আউয়াল এর পদ স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এছাড়া উপজেলা নির্বাচনের পক্ষে ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় বুধবার রাতে মীর শাহে আলম ও মাফতুন আহম্মেদ খান রুবেল এর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্র বিএনপি।
বগুড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। এখানে কারো যদি অভিযোগ অনুযোগ থাকে তবে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং আমাদের বলতে পারে তা না করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ঠিক নয়। প্রত্যেক দলে কমিটি নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, পরে সবকিছু ঠিকও হয়ে যায়।
তিনি জানান, বগুড়ায় বিএনপি এক। কোনো গ্রুপ নেই।
বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ভিপি সাইফুল ইসলাম এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বগুড়া সদর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর আবুল কালাম আজাদ জানান, বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে। সাবেক এমপি লালুর বাসার সামনে থাকা তিনটি মোটরসাইকেল রাস্তার উপরে ফেলে দিয়ে যায় বিক্ষুব্ধরা। এর আগে বিএনপি আফিসের সামনে আগুন লাগিয়ে দেয়।
বগুড়ার কাহালু নন্দীগ্রাম আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা আলহাজ্ব মোশারফ হোসেন জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এর নির্দেশনায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। এই কমিটির মাধ্যমে আগামীতে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সকল প্রকার আন্দোলনকে গতিবেগ করা হবে। এখানে কোনো গ্রুপিং নেই। কিছু কর্মীকে ভুল বোঝানো হয়েছে মাত্র। যারা ভিন্ন ঘটনার চেষ্টা করছে তারা বিএনপির কেউ না।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত হোসেন