১৫ নভেম্বর, ২০১৯ ১৪:৫৩

উল্লাপাড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনা : উদ্ধার কাজ শেষে চলছে লাইন মেরামতের কাজ

আব্দুস সামাদ সায়েম, সিরাজগঞ্জ

উল্লাপাড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনা : উদ্ধার কাজ শেষে চলছে লাইন মেরামতের কাজ

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় স্টেশনে দুর্ঘটনাকবলিত রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের উদ্ধার কাজ শেষ হয়েছে। এখন ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইনের মেরামত কাজ চলছে। তবে বিকল্প অন্য একটি লাইন দিয়ে ব্রডগেজে চালিত ট্রেনগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল করলেও সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। 

এদিকে, রেলওয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলার কারণে ভুল সিগন্যাল, রেলপথের ক্রুটি, ঝুঁকিপূর্ণ ব্রীজ ও গেটম্যানের সংকটসহ নানা কারণে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষসহ স্বয়ং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় রেলওয়ে নিরাপদ যাত্রা এখন মরণযাত্রায় পরিণত হচ্ছে বলে মনে করছেন সুধীজনরা। এ অবস্থায় রেলওয়েতে কাঙ্খিত সেবা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন তারা। আর কর্তৃপক্ষ বলছে- নানা সংকটের কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।
 
জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় বিকট শব্দে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি উল্লাপাড়া স্টেশনের কাছে লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনসহ চারটি বগিতে আগুন ধরে যায়। বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও চালকসহ অন্তত ১০জন আহত হন। দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ জেলা-উপজেলা প্রশাসন স্থানীয়দের সহায়তা আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। এতে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার পর উদ্ধার কাজ শুরু হয়। রাত ৮টার মধ্যে ছয়টি বগি অপসারণ করে ব্রডগেজে চালিত ট্রেনগুলোর চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। আর মিটারগেজে চলাচল ট্রেনগুলো বন্ধ রাখা হয়। শুক্রবার দুপুর ১টার দিকে লাইনচ্যুত বগিগুলো সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করা হয়। কিন্তু রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ট্রেন চলাচল পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি। তবে সন্ধ্যার মধ্যে মেরামত শেষে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হবে কর্তৃপক্ষ জানান। দুর্ঘটনার কারণে ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয়ের কারণে বৃহস্পতিবার থেকে যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। 

অন্যদিকে, দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন করতে রেলওয়ের পক্ষ থেকে তিনটি ও সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। এদিকে, দুপুরে রেলওয়ে সচিব মোফাজ্জেল হোসেন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

এ সময় তিনি বলেন, ভাল সিগন্যালিং ব্যবস্থা, ভাল বগি, চালকদের সতর্কতা, রেললাইনের ক্রুটিসহ বেশ কয়েকটি ডিসিপ্লিন একত্রে রেলওয়ের অপারেটিং সিস্টেম চলে। এর মধ্যে একটি ডিসিপ্লিন ফেইলর হলে দুর্ঘটনা ঘটে। এখানেই যে কোনো একটি ডিসিপ্লিন ফেল হয়েছে। তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। তবে রেলওয়ে লোকবলসহ বিভিন্ন সিস্টেমে ক্রুটি রয়েছে। এ কারণে কাঙ্খিত সেবা দিতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হচ্ছে। 

তিনি আরও জানান, যে বগিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত তা প্রায় তিন কোটি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল। এ হিসেবে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও তদন্তে যদি কারো গাফিলতি প্রমাণ হয় তা শাস্তি দেয়া হবে। 

তিনি বলেন, রেলওয়ে যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশেষ করে চালক, সহকারী চালক, সিগন্যাল ম্যান যারা রয়েছেন তারা অনেকেই অদক্ষ। এ কারণে সম্প্রতি তাদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দক্ষ জনবল গড়ে ওঠার পাশাপাশি রেললাইনের ক্রুটি মেরামত করা হলে দুর্ঘটনা কমে যাবে। 

তদন্ত কমিটির কাজ শুরু:
রেলওয়ে ও জেলা প্রশাসনের গঠিত চারটি তদন্ত কমিটি সকাল থেকে কাজ শুরু করেছে। দুর্ঘটনার সময় লাইনে কাজরত দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদসহ লাইন পরিদর্শন করেছেন। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রধান চীফ অপারেটিং সুপারেন্টেন্ডডেন্ট শহিদুল ইসলাম জানান, মূলত হিউম্যান ফেইলর তথা চালক, সিগন্যাল ম্যানের ভুল এবং মেটারিয়াল ফেইলর তথা ইঞ্জিনের ক্রুটি, বগির ক্রুটি ও লাইনের ক্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দুটি বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তশেষে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে কি কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও অন্য তিনটি তদন্ত টিমও আলাদা আলাদাভাবে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। 

বারবার দুর্ঘটনায় আতঙ্কিত যাত্রীরা:
সম্প্রতি মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বেড়ে যাওয়ায় নিরাপদ যাত্রা হিসেবেই ট্রেন বেছে নেয় যাত্রীরা। বারবার ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় যাত্রীদের মধ্যে ট্রেন যাত্রা নিয়েও আতঙ্ক শুরু হয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের গাফিলতির জন্য বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করে যাত্রীদের রেলের উপর থেকে আস্থা কমে যাচ্ছে।
 
উল্লাপাড়ার বাসিন্দা ইউসুফ আলী মন্টু, ট্রেনযাত্রী আসিফ হোসেন, নুর হোসেন, রাশেদা খাতুনসহ অনেকেই জানান, কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে বার বার দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে ট্রেনের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। তারা আরও বলেন, শুধু কালকেই নয় মাত্র কয়েকদিন আগে একই স্টেশনে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে তিনজন মারা যায়। গত দুমাস উল্লাপাড়ার পঞ্চক্রোশী এলাকায় গেটম্যানের অভাবে ট্রেনের সাথে মাইক্রোবাসে দুর্ঘটনায় বর কনেসহ ১২ জন মারা যান। বার বার দুর্ঘটনায় ট্রেনে যাতায়াতকারী যাত্রীদের মধ্যে দুর্ঘটনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। 

তারা বলছেন, কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় রেলের কাঙ্খিত সেবা নিশ্চিত করতে দক্ষ জনবল নিয়োগসহ ক্রুটিপূর্ণ রেলপথ ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্রীজগুলো মেরামতের দাবি জানাচ্ছি। 

ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ: 
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিমপাড় থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত প্রায় একশ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। এর মধ্যে ছোট-বড় প্রায় ৫০টির অধিক ব্রীজ রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হওয়ায় এ সকল ব্রীজের আয়ুস্কাল অনেক আগেই ফুরিয়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সংস্কার না করায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। উল্লাপাড়ার বংকিরহাট ও কামারপাড়া দুটি ব্রীজের গার্ডারে ফাটল দেখা দেয়ায় কাড, স্লিপার দিয়ে ঠেকনা দিয়ে ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা চালু করে রাখা হয়েছে। ব্রীজগুলো দ্রুত মেরামত করা না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়াও এই রেলপথের বিভিন্ন পয়েন্টে গেটম্যান না থাকায় দুর্ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে। 

বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর