মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বরিশাল নগরীর বান্দ রোডের পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিসে ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙ্গালিদের ধরে এনে হানাদাররা নির্মম নির্যাতন করতো পাশ্ববর্তী বিআইপি’র কলোনীর একটি ভবনের টর্চার সেলে। আর নারীদের নিয়ে আমোদ-ফূর্তি করতেন আরেকটি ভবনে।
কখনও কখনও কীর্তনখোলা নদীর তীরে লাইনে দাঁড় করিয়েও ব্রাশ ফায়ার করে পাখির মতো হত্যা করা হতো স্বাধীনতাকামীদের। পরে কখনও তাদের লাশ ফেলে দেওয়া হতো কীর্তনখোলা নদীতে। আবার কখনো মাটিচাপা দেওয়া হতো নদী তীরবর্তী ভূমিতে। মুক্তিকামীদের আক্রামণে কোণঠাসা হয়ে ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা পালিয়ে যাওয়ার পর বরিশাল শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
বরিশালের সিনিয়র সাংবাদিক আইনজীবী অ্যাডভোকেট এসএস ইকবাল জানান, পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যাওয়ার পর ত্রিশ গোডাউন সড়কের পাশে তৎকালীন এডিসি মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হকের লাশ আবিষ্কার করেন মুক্তিযোদ্ধারা।এছাড়া, ত্রিশগোডাউন সংলগ্ন খাল থেকে কীর্তনখোলা নদীর তীর পর্যন্ত আরও অনেকের লাশ পাওয়া যায়। মূলত ত্রিশগোডাউন খাল থেকে কীর্তনখোলা নদী পর্যন্ত পুরো এলাকাই বধ্যভূমি।
স্বাধীনতার পর কোনও সরকার এই বভ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। অবহেলা আর অযন্তে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি বিজরিত টর্চারসেল, পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকার আর বধ্যভূমি।
মুক্তিযোদ্ধারা ত্রিশগোডাউন খাল থেকে কীর্তনখোলা নদী পর্যন্ত পুরো এলাকা বধ্যভূমি হিসেবে সংরক্ষণের দাবি জানালেও ১৯৯৭ সালে তৎকালীন সরকারের সময়ে কীর্তনখোলা নদীর তীরে বটগাছের পাশে অল্প জায়গা জুড়ে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
ওই সময় জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে স্মৃতিস্তম্ভটি সুরক্ষিত করতে এবং এর পবিত্রতা রক্ষায় চারপাশে প্রায় আড়াই ফুট উঁচু পিলার করে এসএস পাইপ দিয়ে সিমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। বিশেষ দিবসে সেখানে প্রবেশের জন্য নির্মাণ করা হয় দুটি গেট। কিন্তু সীমানা প্রাচীরের উচ্চতা কম হওয়ায় উৎসুক মানুষ প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে জুতা-স্যান্ডেল নিয়ে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভে প্রবেশ করে এর পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করে।
কেউ সেখানে নাচানাচি আর কেউ অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। রাতের আঁধারে খুলে নেয় সীমানা প্রাচীরের এসএস পাইপ এবং দুটি গেট। এ কারণে এখন পুরোপুরি অরক্ষিত হয়ে পড়েছে বরিশালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বধ্যভূমির পবিত্রতা রক্ষায় সেখানে দুটি সতর্কীকরণ নোটিশ সাটিয়ে দেওয়া হলে তা কেউ মানছে না। নোটিশ পড়ছে আর জুতা স্যান্ডেল নিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ মারিয়ে পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করছে উৎসুকরা।
সেখানে দায়িত্বরত সিটি করপোরেশনের একজন প্রহরী জানান, বধ্যভূমিতে সব চেয়ে বেশি পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করছে মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। নিষেধ করলেও তারা শোনেন না। উল্টো ভয়ভীতি দেখায়।
এছাড়া, অনেক আগন্তুকও বধ্যভূমির পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি একদল ইউটিউবার বধ্যভূমিতে জুতা-স্যান্ডেল নিয়ে নাচানাচি করে ওই ভিডিও আবার ফেসবুকে পোস্ট করে। স্থানীয়দের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরে আবার ওই ভিডিও সরিয়ে ফেলে তারা।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি বিজরিত বধ্যভূমির যথেচ্ছ ব্যবহার দুঃখজন উল্লেখ করে এর প্রবিত্রতা রক্ষায় পুরো বধ্যভূমি এলাকা সুরক্ষিত এবং সংরক্ষিত করার দাবি জানিয়েছেন বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাবেক সভাপতি এসএম ইকবাল।
এদিকে, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বধ্যভূমির হালচিত্র দেখতে গত মঙ্গলবার সরেজমিন পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান এবং স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম। এ সময় তারা বধ্যভূমির পবিত্রতা ক্ষুণ্নকারী কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন এবং তাদের সতর্ক করে দেন। সেখানে দাঁড়িয়েই জেলা প্রশাসক মুঠোফোনে বধ্যূঁমি আরও সুরক্ষিত করতে গণপূর্ত বিভাগকে নির্দেশ দেন। আগামী ২৬ মার্চের আগেই বধ্যভূমি আরও সুরক্ষিত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন জেলা প্রশাসক।
তৎকালীন সরকার বধ্যভূমি সংরক্ষণ করলেও বিআইপি কলোনীর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর টর্চারসেল ও বাংকার ছিল অবহেলিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে বর্তমান সরকার প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে ওই টর্চার সেল ও বাংকার সংরক্ষণের কাজ চলছে।
বিডি প্রতিদিন/কালাম