২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ১৮:১৬

দক্ষিণের জনপথ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গোলগাছ

উত্তম কুমার হাওলাদার, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)

দক্ষিণের জনপথ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গোলগাছ

গোলগাছ মূলত গোলপাতা নামে পরিচিত। এটি অর্থকরী গাছ। সারিবদ্ধ ঘন ঝোপের মতো বেড়ে ওঠা গোলগাছ দেখতে অনেকটা নারকেল গাছের মতো। এর উচ্চতা প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট। সাধারণত লবণাক্ত পলিযুক্ত মাটিতে ভালো জন্মায়। এ গাছে রস থেকে তৈরি করা গুড় (মিঠা) হয়।

প্রতিবছর শীত মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে গাছিরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে রস সংগ্রহে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অন্তত ৩০টি পরিবার গোল গাছের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এক সময় এ উপজেলার বিভিন্ন খাল-বিল ও নদীর তীরে প্রচুর গোলের বাগান দেখা যেত। কিন্তু জলবায়ুর প্রভাবজনিত কারণ ও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ আর চাষাবাদের অভাবে দক্ষিণের জনপথ থেকে ক্রমশই এ গাছ ধ্বংস হতে বসেছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা জানা গেছে, প্রতিবছর আষাঢ় মাসে গোল গাছের গাবনা ফল হয়। আর গাবনা ফলের ডাটা নিচু রাখার জন্য মাটিচাপা ও পা দিয়ে একাধিকবার লাথি মারা হয়। ১৫দিন এভাবে গাবনা ছড়ার আগাছা পরিষ্কার করে ডাটার মাথা থেকে গাবনা ফল ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কেটে ফেলা হয়। এরপর ডাটার অংশ তিন দিন শুকিয়ে  নেওয়ার পর সকাল-বিকেল দুইবেলা পাতলা করে (একসুত পরিমাণ) কেটে ফেলে রশির সঙ্গে একটি ছোট্ট হাড়ি বেঁধে রাখা হয়।

পরদিন খুব  ভোরে রস সংগ্রহ করা হয়। শুরু হয় বাড়ির উঠানে বসে রস দিয়ে গুড়  তৈরির কাজ। আর সেই গুড় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন গাছিরা। তালতলী, পাথরঘাটা, ভোলা ও খুলনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাসহ চরাঞ্চলে গোলগাছের একাধিক বাগান রয়েছে। তবে এই জনপদের এক সময় সর্বত্র রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজনসহ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘরের ছাউনি হিসেবে গোলপাতা ব্যবহার করতো।

এছাড়া শীত  মৌসুমে গোলবাগানের মালিকরা এর রস দিয়ে গুড় উৎপাদন করে বাড়তি অর্থ উপার্জন করে থাকেন। আবার গোলের রস দিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু পিঠা পায়েস।

উপজেলার নবীপুর গ্রামে দেখা গেছে, শিখা রানী হাওলাদার খড়কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রস দিয়ে গুড় তৈরি করছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, বাবা রে, বিয়ের পর থেকেই প্রতি বছর এই সময় রস জ্বাল দিতে হইছে। আবার তা দিয়ে গুড় তৈরি করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের সর্ববৃহৎ বনাঞ্চল সুন্দরবনসহ দক্ষিণ উপকূলের বিভিন্ন স্থানে গোলগাছ রয়েছে। তবে বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া, কুয়াকাটা, রাঙ্গাবালি, গলাচিপা, দশমিনা, বাউফল, বরগুনার আমতলী, তালতলী, পাথরঘাটা, ভোলা ও খুলনা  জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাসহ চরাঞ্চলে গোলগাছের একাধিক বাগান রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট গাছিদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, উপকূলীয় এলাকায় যেসব গোলগাছের বাগান রয়েছে, তা প্রকৃতির অশেষ দান। বনবিভাগের এক শ্রেণির অসাধু বনকর্মীর সহযোগিতায় বনদস্যুরা অবাধে গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ গোল বাগানগুলো ধ্বংস হতে বসেছে। গোলগাছ চাষাবাদ অত্যন্ত লাভজনক, সহজসাধ্য এবং ব্যয়ও খুব কম। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। এতে  কোনো পরিচর্যা করতে হয় না।

এছাড়া শুধু গোলগাছের বীজ (গাবনা) সংরক্ষণ করে তা নিচু জমিতে পুঁতে রাখলেই চারা গজায়। এর একেকটি ছড়ায় এক থেকে দেড়শ’ বীজ থাকে। এতে ব্যয়ের চেয়ে আয় অনেক গুণ বেশি বলে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের নবীপুর এলাকার অমল ঘরামি জানান।
নবীপুর গ্রামের গোলবহরের মালিক নিঠুর চন্দ্র হাওলাদার বলেন, বছরের সাড়ে তিন মাস রস দিয়ে গুড় তৈরি করি। শুধু গুড়ই বিক্রি হয় প্রায় এক লাখ টাকা। এছাড়া গোলপাতা দিয়ে আরো ২০ হাজার টাকা আয় হয়।

একই গ্রামে অপর এক গোলবহর মালিক নিখিল চন্দ্র হাওলাদার বলেন,  গোলবাগান থেকে যে লাভ হয় তা সরল জমিতে ধানচাষ করে হয় না। এক একর জমিতে ধান পেতাম সর্বোচ্চ ২৫ মণ। কিন্তু ওই জমিতে সৃষ্টি হওয়া গোলগাছের বাগান দিয়ে প্রতি বছর আমার আয় হয় প্রায় এক লাখ টাকা। তবে এখন বাজারে গিয়ে গুড় বিক্রি করতে হয় না।

এক  শ্রেণির খুচরা বিক্রেতা বাড়িতে এসেই গুড় নিয়ে যান। প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গোলের গুড় ক্রেতা আনসার উদ্দিন বলেন, অন্য গুড়ের চেয়ে আলাদা স্বাদযুক্ত, সাশ্রয়ী হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষিত থাকে বলে গোলের গুড়ের ব্যাপক চাহিদা। এ রসের পিঠা বা পায়েস অতি সুস্বাদু হয় বলেও তিনি জানান।

উপজেলা বন কর্মকর্তা মো. আব্দুল সালাম বলেন, গোল গাছ থেকে প্রতিবছর সরকার রজস্ব আয় বাড়াতে পারে। এ গাছের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন নদীতে ভাটায় পানি নামার পরে যে পরিমাণ জমি থাকে সেসব স্থানে ৩০ হাজার গোল গাছ লাগানের নির্দেশনা পেয়েছি। তবে এ উপজেলায় নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ, চাকমাইয়া, টিয়াখালীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের খাদে কিংবা খালের তীরে  গোলবহর রয়েছে।

বিডি প্রতিদিন/আল আমীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর