অভিযুক্ত পাঁচ ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কারে হাইকোর্টের আদেশেও আতঙ্ক কাটেনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ফুলপরীর। অভিযুক্তদের স্থায়ী বহিষ্কার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন ইবি শিক্ষার্থী ফুলপরী ও তার পরিবার। আদালত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ফুলপরীর নিরপত্তায় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দিলেও, তাতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না তারা।
ফুলপরীর গ্রামের বাড়ি পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার শিবপুর গ্রামে গিয়ে জানা যায়, গ্রামের দরিদ্র ভ্যানচালক আতাউর রহমানের মেয়ে ফুলপরী খাতুন। নিজে নিরক্ষর হলেও চার সন্তানকে উচ্চ শিক্ষিত করার স্বপ্নে সংগ্রামী জীবন আতাউরের। বড় ছেলেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করিয়েছেন। বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর, ৩য় সন্তান ফুলপরীকেও ভর্তি করেছেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ওঠার পর ছাত্রলীগ নেত্রীদের অমানবিক র্যাগিংয়ের শিকার হন ফুলপরী। গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিবস্ত্র করে রাতভর শারীরিক নির্যাতন করে ভিডিও ধারণ করে ইবি ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগিরা।
পরদিন, প্রাণভয়ে হল ছেড়ে পালিয়ে বাড়ি চলে আসেন ফুলপরী। পরিবারকে জানানোর পর নির্যাতনের ঘটনায় ভেঙে না পড়ে প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেয় ফুলপরী ও তার পরিবার। পরদিন সপরিবারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে গিয়ে লিখিত অভিযোগে বিচার দাবি করেন ফুলপরী।
এরপর দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে ঘটনা তদন্তে গঠিত হয় একাধিক কমিটি। বিশ্ববিদ্যালয় ও আদালতের নির্দেশে গঠিত পৃথক তদন্ত কমিটি তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন দেয়। একই সাথে এ ঘটনায় হল প্রভোস্ট শামসুল আলম, হাউজ টিউটর মৌমিতা আক্তার, ইশরাত জাহানের দায়িত্বে অবহেলা এবং প্রক্টর শাহাদাত হোসেনের উদাসীনতা ছিলো বলেও, প্রতিবেদনে জানানো হয়। বিষয়টি আমলে নিয়ে বুধবার হাইকোর্ট পাঁচ ছাত্রীকে সাময়িক বহিষ্কার ও হল প্রভোস্ট শামসুল আলমকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। কিন্তু অভিযুক্তরা স্থায়ী বহিষ্কার না হওয়ায় ক্যাম্পাসে ফেরার সাহস পাচ্ছেন না ফুলপরী।
বুধবার দুপুরে ফুলপরীর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার সাথে।
এ সময় ফুলপরী বলেন, আমার উপর নির্যাতনের ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়ায় আমি হাইকোর্টের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তারা স্থায়ী বহিষ্কার না হওয়ায় আমি হতাশ। কারণ অভিযুক্তরা আমার ওপর অমানবিক নির্যাতন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার ও পড়ার কোনো যোগ্যতা নেই ওদের। আমি তাদের সবাইকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবি জানাচ্ছি। ন্যায়বিচার ও অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে আমি কুষ্টিয়া আদালতে মামলা করব, মামলার প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান। অন্যায়ভাবে যারা আমাকে পাশবিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে দ্রুত তাদের বিচার চাই, শাস্তি চাই। কেননা আমি ওখানে পড়তে গেলে কয়েক বছর অবস্থান করতে হবে সেখানে। অভিযুক্তরা সাময়িক বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের পর ক্যাম্পাসে ফিরে এসে আমার উপর আবারো নির্যাতন চালাবে বলেও শংকা ফুলপরীর।
ফুলপরীর বড় ভাই হজরত আলী বলেন, অভিযুক্তরা যে ধরণের অপরাধ করেছে তা ক্ষমার অযোগ্য। তারা স্থায়ী বহিষ্কার ও শাস্তির আওতায় না এলে এমন ঘটনা আবারো পুনরাবৃত্তি হতে পারে। আমরা চাই এ ঘটনায় দোষীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাক, যাতে সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন নিষ্ঠুর র্যাগিং সংস্কৃতির মূলোৎপাটন হয়।
এদিকে, ফুলপরীর প্রতিবাদ ও সাহসিকতা সারা দেশে প্রশংসিত হওয়ায় তাকে নিয়ে গর্বিত এলাকাবাসী। তারাও এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। ফুলপরীর প্রতিবেশী শরিফুল ইসলাম বলেন, নিরবে অন্যায় সহ্য না করে প্রতিবাদ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ফুলপরী। ফুলপরীর বাবা কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানদের শিক্ষিত করার চেষ্টা করছেন। ফুলপরীকেও তিনি প্রতিবাদ করতে সাহস যুগিয়েছেন। ফুলপরীকে নির্যাতনে জড়িতদের সঠিক বিচার হলে, সবাই নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে অনুপ্রেরণা পাবে।
হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার নেটওয়ার্ক পাবনার সভাপতি আব্দুল মতীন খান বলেন, ফুলপরী দেখিয়ে দিয়েছে, অভিযোগ দিলে বিচার পাওয়া যায়। গ্রাম থেকে উঠে আসা একটা মেয়ে অন্য সবার মতো বিপদ আপদ-এতো চিন্তা ভাবনা না করে যে প্রতিবাদী হয়েছে, সে একটা উদাহরণ স্থাপন করেছে। সবসময় এটাই হওয়া উচিত, কিন্তু আসলে হয় না, সেই কারণেই ফুলপরী একটা দৃষ্টান্ত।
বিডি প্রতিদিন/এএ