শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
গল্প

বসন্তের রূপকথা

রুনা তাসমিনা

বসন্তের রূপকথা

কৃষ্ণচূড়া গাছ পাশের আমগাছকে ডেকে বলল,ভাই প্রতিবেশি, তুমি তো আছ মহাসুখে। কি সুন্দর করে মুকুল ফুটিয়ে সাজিয়ে রেখেছ নিজেকে। আমাকে দেখো না! কি বিচ্ছিরি! এখনো একটি পাতাও গজায়নি।

আমগাছ বলল, মন খারাপ করো না ভাই। বসন্ত তো চলেই এসেছে। কিছুদিন পর তোমাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর দেখাবে। তোমার লাল টকটকে ফুলগুলো দেখে সবাই কত তারিফ করবে!

কুয়াশা লুকিয়ে ছিল আমগাছের পাতার ফাঁকে। ওদের কথা শুনে খুব মন খারাপ হলো তাদের। বলল, তোমাদের এই মন খারাপের কারণ আমি ভাই। আমি তো শীতেই আসি। আর এসেই তোমাদের সহজ সরল পাতাগুলো ঝরিয়ে দিয়ে তোমাদের রুক্ষ করে দেই। বলতে বলতে মনের দুঃখে এক ফোঁটা শিশির ঝরে পড়ল আমগাছের পাতার ওপর।

শিশিরের কান্না দেখে আমগাছ বিচলিত হয়ে বলল, তুমি কাঁদছ! না না কেঁদো না ভাই। অনুনয় করি তুমি কেঁদো না। প্রকৃতি তোমাদের অভিভাবক। সে যখন তোমাদের আসতে বলবে, তখন তো তোমাদের আসতেই হবে। কৃষ্ণ ওকে বোঝাও ভাই।

কৃষ্ণচূড়ার মন এমনিতেই খুব নরম। তার উপর কুয়াশার কান্না দেখে আরও বিচলিত। বলল,

কুয়াশা মেয়ে কান্না করো না। বসন্ত আমাকে লাল ফুলে রাঙিয়ে দেবে। তুমি কান্না থামাও ভাই।

ওদের কথার মধ্যেই রোদ এসে হাজির। শিশিরের গায়ে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগল। রোদের আদরে ঝিকমিক করে উঠল শিশির কণা। আমপাতা মুগ্ধ হয়ে পাশের পাতাদের ডেকে ডেকে দেখাতে লাগল। ফিসফিস করে বলল, দেখো দেখো শিশির কণাকে ঠিক মুক্তার মতো দেখাচ্ছে। রোদ বলল, এভাবে কাঁদতে নেই। ওরা সবাই তোমার বন্ধু। চলো আমার সাথে। বলে শিশির কণাকে বুকে লুকিয়ে মৃদু পরশে আমগাছ, গাছের মুকুল, পাতায় পাতায় বুলিয়ে দিতে লাগল তার কোমল আদর। বাদ গেল না পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছও। মনমরা করে রোদের সান্ত্বনা নিতে লাগল সে।

একটু পরেই কোথা থেকে উড়ে এসে একটি কোকিল বসল তার মরা ডালে। বসেই ডেকে উঠল কুউউউ... কুউউউ...। কী মিষ্টি কণ্ঠে সে ডাকছে! আর কী আনন্দ তার গলায়! ডেকে ডেকে এ ডাল থেকে ও ডালে যাচ্ছে। সে খুশিতে এতো আত্মহারা ছিল খেয়ালই করেনি। কৃষ্ণচূড়া গাছ মন খারাপ করে তার আনন্দ দেখছে। হঠাৎ খেয়াল করে বলল, কি ব্যাপার গাছ বন্ধু! কেন এমন মন খারাপ?

বলল, তোমার কি আনন্দ! তুমি ঘুরে ঘুরে গাইছ। নেচে নেচে ডাকছ কুউউউ.... কুউউউ... কিন্তু দেখো আমার ডালে একটিও পাতা নেই। আমাকে কেমন বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। তাই আমার মন খারাপ।

ও এই কথা! এতে মন খারাপ করার কি আছে! শীত এসে সব গাছের পাতা ঝরিয়ে দেয়। বসন্ত তো এসেই গেল। তোমার ডালে ডালে নতুন পাতা গজাবে, লাল লাল ফুলে তোমার সারা মাথা ঢেকে যাবে। তুমি আবার সবুজ, সতেজ হয়ে উঠবে। আমি তখন তোমার ছোট ছোট কচি পাতার আড়াল থেকে ঢাকবো কুউউউ...

কোকিলের কথা শুনে কৃষ্ণচূড়া গাছের মন দারুণ ভালো হয়ে গেল। বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে কোকিলকে সে দোলাতে লাগল। কোকিল মহা আরামে দুলে দুলে ডাকতে লাগল কুউউউ.. কুউউউ...

হঠাৎ ডাক থামিয়ে বলল, দেখ দেখ কৃষ্ণ তোমার নিচে কি সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে।

জানি। স্কুলে বসন্ত উৎসব হবে। তাই এত সাজগোজ। বলল কৃষ্ণ, তাই নাকি! খুব আনন্দের কথা তো!

কারা করবে?

স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। আমি তো অনেক বছর এখানে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি ওদের। কি সুন্দর করে ওরা গায়! নাচে!

এবার তাহলে আমিও আসব দেখতে। তুমি জানো কখন হবে ওদের উৎসব?

খুউব জানি। পরশু দিন। ফাল্গুনের প্রথম দিন। তুমি আমার ডালে বসে দেখ কোকিল বন্ধু। পরশু দিন আসবে বলে কোকিল কুউউউ.. কুউউউ... করে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল।

ফাল্গুনের প্রথম সকাল। কোকিল এসে কৃষ্ণচূড়ার ঢালে বসে কুউউউ.. ডাকে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে জেগেই কৃষ্ণচূড়া গাছ, আম গাছ অবাক!

কি সুন্দর করে ওরা সাজিয়েছে স্কুলের মাঠ। তাদেরও পরিয়ে দেওয়া হয়েছে গাঁদা ফুলের মালা। এ ডাল থেকে ও ডালে ঝুলছে রঙিন কাগজে কাটা নানারকম ফুল। ছেলেমেয়েরা নানারকম সাজে আসতে লাগল। মেয়েদের কারও মাথায় ফুলের মুকুট। কেউ পরেছে ফুলের গয়না। পরনে বাসন্তি রঙের শাড়ি, জামা, ফ্রক। গাছের নিচে যেন অনেক ফুলপরি জড়ো হয়েছে। ছেলেরা পরেছে পাঞ্জাবি, ফতুয়া। তাদের হাতেও ফুল। সবার হাতে রঙিন ডালায় নানারকম পিঠা। আমগাছের নিচে বসানো টেবিল ভরে যাচ্ছে নানারকম পিঠায়। মাঠের একপাশে কি সুন্দর করে স্টেজ করেছে! টুকটাক যা কাজ ছিল এই ফাঁকে সেরে নিচ্ছে স্কুলের কর্মচারী অন্তু। আম পাতার ফাঁক থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে কুয়াশা আকাশের দিকে চলল।

ও ভাই কুয়াশা, কোথা যাও? দেখ না নিচে কত আনন্দ আজ!

কুয়াশা বলল, আমি থাকলে ওদের আনন্দ মাটি হবে ভাই। রাতে এলে তোমাদের কাছ থেকে শুনবো আজকের গল্প। ওই দেখ কমলা রঙ ছেড়ে রুপালি পোশাক পরে সূর্য আসছে। তোমরা রোদের সাথেই মজা কর।

নিচে এত আনন্দ দেখে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভুলেই গেল তার দুঃখের কথা। স্টেজে শুরু হয়েছে বসন্তের গান। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নিচ্ছে বসন্তকে। স্কুলের আঙিনা ভরে গেল ফুলে ফুলে। গানের তালে তালে আমগাছ সুর মেলালো মুকুল দুলিয়ে, পাতা নাচিয়ে। কৃষ্ণচূড়া শুকনো ঢালে বসে কোকিলও গুনগুন করে গাইতে লাগল বসন্তের গান। ছেলেমেয়েরা গানে, নাচে কি অপূর্ব সুন্দর করে প্রকৃতির কথা বলছে! বলছে ফুলের কথা, পাখির কথা। কি খুশি ওদের মনে! দুপুর পর্যন্ত খুব মজা হলো। খুশির আমেজে কেটে গেল সারা দিন।

রাতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠল গাছেরা। গরমের অস্বস্তি কেটে গেল গাছেদের। পর দিন ভোরবেলা নিজেকে দেখে মুগ্ধ আমগাছ! পাতাগুলো সব ধুইয়ে দিয়ে গেছে বৃষ্টি। রোদের নরম ছোঁয়ায় চিকচিক করছে তারা। প্রতিবেশীকে ডেকে বলল, ও ভাই কৃষ্ণ, এবার তো তোমার ঢালে আসবে নতুন পাতা। তুমি আবার আগের মতো সুন্দর হয়ে যাবে। আর যখন লাল লাল ফুল তোমার মাথায় গজাবে সবাই তোমার সৌন্দর্যের তারিফ করবে।

কয়েকদিন পর সত্যি সত্যিই কৃষ্ণচূড়া গাছের ঢালে ঢালে ফুটল নতুন কচি পাতা। তার মনে এখন আর দঃখ নেই। কোকিল এসে তার ঢালে বসে গান গায়। স্কুলের ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে কোকিলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ডাকে কুউউউ... আর কচি পাতা দুলিয়ে হেসে ওঠে কৃষ্ণচূড়া গাছ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর