আন্দোলনের নামে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো এবং পরবর্তীতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কারফিউ জারির কারণে পর্যটন ব্যবসা বড় রকমের হুমকির মুখে পড়েছে। পর্যটন স্পটগুলোতে এখন আর পর্যটকের দেখা মিলছে না। হোটেল-মোটেলগুলোতেও পর্যটকদের কোনো বুকিং নেই। সমুদ্রসৈকতগুলোতে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
কক্সবাজার : কিছুদিনের অনাকাক্সিক্ষত প্রেক্ষাপট দেশের প্রধান পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে পর্যটকশূন্য অবস্থায় নিয়ে এসেছে। ফলে হোটেল-মোটেলে চলছে মন্দাভাব। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল বিকালে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে, পর্যটকশূন্যতায় সৈকতসহ বিনোদন কেন্দ্রগুলো খাঁ খাঁ করছে। পর্যটক না থাকায় পর্যটন ব্যবসায় নেমেছে ধস। দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে। টানা কয়েকদিন দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে পরিবহন সেক্টর। দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ সড়কে ছোট-বড় সব ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় পরিবহন সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো চরম অর্থকষ্টে পড়েছে।
কক্সবাজারের ছোট-বড় ৫ শতাধিক আবাসিক হোটেলে-মোটেলে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোরও একই অবস্থা। জনজীবনে এর চরম প্রভাব পড়েছে। জয়নাল আবেদীন নামে এক রেস্তোরাঁ মালিক জানান, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলছে এ পরিস্থিতি। পর্যটক একদমই নেই। আর আমাদের ব্যবসাটাই হচ্ছে পর্যটনকেন্দ্রিক। দেশে চলমান পরিস্থিতিতে সবকিছু থমকে আছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের ব্যবসায় চরম ধস নেমেছে।
হোটেল ব্যবসায়ী মো. তারেক জানান, আমাদের হোটেল- মোটেল ব্যবসা একেবারেই বন্ধ। হোটেলে একটি রুমেও বুকিং নেই। কদিন এ অবস্থা চলবে কে জানে? তবে এ পরিস্থিতি যদি আরও বেড়ে যায় অনেক দুর্ভোগে পড়ব। কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম নেওয়াজ জানান, ৫ শতাধিক হোটেল-মোটেলে নেই কোনো পর্যটক। এমন অবস্থায় লোকসান গুনতে হচ্ছে হোটেল ব্যবসায়ীদের। তিনি আরও জানান, চলমান অস্থিরতায় পর্যটন খাতে কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সিলেট : বন্যা ও চলমান আন্দোলনে ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েছে সিলেটের পর্যটন ব্যবসা। তিন মাস ধরে সিলেটে পর্যটক না আসায় অনেক হোটেল মালিক বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল পরিশোধ করতে পারেননি। সংযোগ বিচ্ছিন্ন এড়াতে তারা ধরনা দিচ্ছেন বিদ্যুৎ ও গ্যাস অফিসে। চলমান এই সংকট কাটাতে ব্যবসায়ীরা চান সরকারি প্রণোদনা। সরকারের সহযোগিতা না পেলে এ ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পর্যটনশিল্পকে ঘিরে সিলেটে গড়ে উঠেছে কয়েক শ হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও গেস্ট হাউস। এ ছাড়াও পর্যটনের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে এ অঞ্চলের রেস্টুরেন্ট, ট্রান্সপোর্ট ও কুটিরশিল্পের ওপর। পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে স্থানীয় লাখো মানুষের জীবনজীবিকার চাকা ঘোরে। কেউ নৌকা দিয়ে পর্যটক পরিবহন করে, আবার কেউ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু বন্যা ও চলমান আন্দোলনের কারণে গত তিন মাস ধরে সিলেটের পর্যটন খাত কঠিন সময় পার করছে। বন্যার কারণে বারবার পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা ও বর্তমান কারফিউ পরিস্থিতির মধ্যে সিলেটবিমুখ হয়ে পড়েন পর্যটকরা।
নগরের জিন্দাবাজারের হোটেল গোল্ডেন সিটির মহাব্যবস্থাপক মৃদুল কান্তি দত্ত মিষ্টু জানান, তিন মাস ধরে পর্যটকদের দেখা মিলছে না। ফলে হোটেল অতিথি শূন্য। ব্যবসা একদম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। মাস শেষে বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল দেওয়া যাচ্ছে না। বকেয়া বিলের জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাস অফিস সংযোগ বিচ্ছিন্নের হুমকি দিচ্ছে। এর ওপর রয়েছে ভ্যাটের চাপ। হোটেল স্টাফদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। তাদের ‘খোরাকি’ চালানোই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা চললে হোটেল বন্ধ করে দিতে হবে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এমদাদ হোসেন জানান, পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে হোটেল, ট্রান্সপোর্ট, রেস্টুরেন্ট, কুটিরশিল্পসহ অনেক খাত জড়িত। পর্যটক সমাগম বেশি হলে এসব খাতের ব্যবসা চাঙা থাকে। আর পর্যটক না এলে এ খাতের ব্যবসায় ধস নামে। গেল তিন মাস ধরে সিলেটের পর্যটন খাতের ব্যবসা খুবই কঠিন সময় পার করছে। বন্যা ও আন্দোলনের কারণে সিলেট বিভাগে এ খাতে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে ক্ষতি হয়েছে। এ খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারি প্রণোদনার প্রয়োজন।
রাঙামাটি : পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে পাহাড়। প্রতি বছর এ মৌসুমে পর্যটকের পদভারে পাহাড় উৎসবমুখর থাকলেও এবার ভিন্ন চিত্র। পর্যটক নেই পর্যটন কেন্দ্রে। নেই স্থানীয়দের আনাগোনা। তাই একেবারে শূন্য রয়েছে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পর্যটন কেন্দ্রগুলো। স্থবির হয়ে পড়েছে পর্যটক সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান। একই অবস্থা বিরাজ করছে রাঙামাটির শপিং মলেও। রাঙামাটি পর্যটন কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে কোনো বুকিং নেই পর্যটনের হোটেল-মোটেলে। বুকিং যা ছিল তাও বাতিল করেছেন পর্যটকরা। তাই অলস সময় পার করছেন হোটেল কর্মচারীরা। রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা বলেন, রাঙামাটি পর্যটন মোটেলে ২০ ভাগও বুকিং নেই। দেশের চলমান পরিস্থিতির জন্য বুকিং প্রায় বাতিল হয়ে গেছে। ঝুলন্ত সেতুতেও তেমন কোনো পর্যটক আসেনি। এক কথায় বলা যায় স্থবির ব্যবসা।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : পর্যটকশূন্য অবস্থায় রয়েছে কুয়াকাটা। সৈকতের কোথাও নেই কোনো পর্যটকের আনাগোনা। খালি পড়ে আছে পাতা বেঞ্চিগুলো। বুকিং নেই হোটেল-মোটেলগুলোতে। সারা দেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড থেকে এমন অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে পর্যটননির্ভর ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন-কুটুম’র সাধারণ সম্পাদক হোসাইন আমির বলেন, এখন কারফিউর কারণে সৈকতের কোথাও কোনো পর্যটকের আনাগোনা নেই।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ