২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণার আগেই অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও বাজেট কাঠামো নিয়ে।
শনিবার (৩১ মে) রাজধানীর কাকরাইলে দেশ টিভির আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘বাজেট ভাবনা’ শীর্ষক সংলাপে তাঁরা বলেন, বর্তমান অর্থনীতি গভীর সংকটে থাকলেও বাজেট সেই বাস্তবতা প্রতিফলিত করে না। বরং ভৌত অবকাঠামোতে অতি বরাদ্দ আর সামাজিক খাতে অবহেলা দেশকে দীর্ঘমেয়াদে সংকটময় পরিস্থিতিতে ফেলছে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সুলতান মাহমুদ।
আলোচনায় ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বর্তমানে মূলত প্রাইভেট ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি খাতে কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য বিদ্যমান। সরকারের কার্যক্রমেও বৈষম্যের ছাপ স্পষ্ট, বিশেষ করে সুযোগের বৈষম্য এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যও বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কারণ এ দুটি খাত জনগণের মৌলিক অধিকার এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ভিত্তি। বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের প্রায় ৯৬ শতাংশ আসে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় থেকে। কিন্তু সেই সঞ্চয়ের হার কমে যাওয়ায় বিনিয়োগও কমে যাচ্ছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বাজেট ব্যতিক্রমী সময়ে দেওয়া হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ স্থবিরতা, মধ্যবিত্তের সংকট-সবই বাড়ছে। শুল্ক কাঠামো পুনর্বিন্যাস, কর ব্যবস্থায় ডিজিটাল সংস্কার ও স্বচ্ছতা জরুরি। অর্থনৈতিক বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজমান, সেটা আমি অস্বীকার করব না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ব্যবসায়িক পরিবেশ অনুকূল না হলে রাজস্ব বাড়বে না। করনীতিকে ব্যবসাবান্ধব করতে না পারলে প্রত্যাশিত রাজস্ব আসবে না। বাজেট বৈষম্যবিরোধী হতে হবে। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব
বাংলাদেশের (আইইউবি) উপাচার্য ড. মো. তামিম বলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও টেকসই পরিকল্পনায় বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। শিক্ষানীতিতে আমূল সংস্কার দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমই) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এলডিসিতে যাওয়ার পর আমাদের অবস্থান কী হবে সেটা নিয়ে কোনো রোডম্যাপ নেই। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত যে, এলডিসির পর আমরা নিজেরা বিপর্যয়ে পড়ব কি না! তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাকিয়ে আছেন আমাদের ওপর। আমরা তো ভালো নেই। তারা আমাদের দেখেই বিনিয়োগ করা নিয়ে আশঙ্কায় আছেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রতি বছর বাজেটে টানাটানি চলে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সব সময় কম হয়। ফলে সামাজিক খাত অবহেলিত হচ্ছে। যত শিক্ষিত, তত বেকার- এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। বাজেট মানেই এখন সাধারণ মানুষের চোখে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া। রাজনীতিবিদদের দেশের ওপর কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। আমাদের দেশের বাজেটে ব্যয় বুঝে আয় ঠিক করে, অথচ হওয়ার কথা আয় বুঝে ব্যয় ঠিক করা। তা ছাড়া বাজেটে বিল্ডিং নির্মাণ খাতে ১৬ শতাংশ বরাদ্দ বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি আরও বাড়াবে। দেশের আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে হলে ব্যাংকনির্ভরশীলতা কমাতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উন্নয়ন অধ্যয়নের শিক্ষক রাশেদ আল তিতুমীর বলেন, প্রকৃত মজুরি কমছে, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় খাত ঋণ পরিশোধ। বাজেটের ৫১ শতাংশ অর্থ ঋণ পরিশোধে ব্যয় হবে। নতুন করে কর্মসংস্থান কীভাবে হবে? রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা এবং সংস্কারের অভাবে দেশের অর্থনীতি অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে।
ঢাবির অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে গেলে কর্মসংস্থান বাড়বে না। কর রাজস্ব যদি শুধুই ব্যয় মেটাতে ব্যয় হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ টিকবে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি জরুরি।
অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ বলেন, বিগত কয়েক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৫০ শতাংশ অবমূল্যায়িত হয়েছে। সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিপাকে। বাজেটে জবাবদিহি, সত্যিকারের বিনিয়োগকারীদের সহায়তা ও আর্থিক খাতের সংস্কার দরকার।