আল্লাহতায়ালা আমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন শুধু তাঁর ইবাদত ও দাসত্ব করার জন্য। কোরআনুল কারিমের সর্বপ্রথম সূরা আল ফাতিহায় আমরা নামাজের প্রতি রাকাতে মহান আল্লাহর কাছে এই বলে আবেদন-নিবেদন করছি যে, ‘আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।’ (আয়াত ৪)। আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদের রুজি হিসেবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর। যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগি কর।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৭২)।
মহান আল্লাহ এ পৃথিবীতে জীবনযাপন করার জন্য আমাদের অজস্র সম্পদ দান করেছেন। এ সম্পদ সঠিক ও যথার্থভাবে উপার্জনের জন্য তিনি নির্দিষ্ট পন্থা-পদ্ধতি বা ব্যবস্থা বলে দিয়েছেন। সম্পদ মানব জাতির জন্য আল্লাহ-প্রদত্ত বিশেষ নিয়ামত বা কল্যাণ। এ সম্পদ দুইভাবে উপার্জন করা যায়। এক. সঠিক ও যথার্থ উপায়ে অন্য কথায় হালাল পন্থায়। দুই. অসৎ ও অন্যায়ভাবে অন্য কথায় হারাম পন্থায়। সঠিক ও যথার্থ পন্থায় সম্পদ উপার্জনে কোনো বাধা-নিষেধ নেই। আল্লাহতায়ালার বিধান ও নবী (সা.)-এর প্রদর্শিত নীতি অনুযায়ী সম্পদ উপার্জন অন্য ইবাদতের মতোই একটা ইবাদত। হালাল পন্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করা অবশ্যই ইবাদত।
আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পদ উপার্জন করা ইবাদতের পর্যায়ে পড়ে। ইবাদত শুধু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সব ভালো কাজই ইবাদত। আল্লাহতায়ালা সন্তুষ্ট হন, মনঃপূত বা পছন্দ করেন এমনভাবেই সম্পদ বা অর্থ উপার্জন করতে হবে। তিনি পছন্দ করেন না, মনঃপূত-সন্তুষ্ট নন বা নৈকট্য লাভ করা যাবে না, এমন কোনো পন্থায় সম্পদ উপার্জন করা সঠিক তো নয়ই, বরং জেনে-শুনে গুনা অর্জন করা হবে। গুনা অর্জন করা মানে আল্লাহতায়ালার মারাত্মক শাস্তি ভোগ করা। আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু ও মেহেরবান। তাই তিনি অনেক অন্যায় ও গুনার শাস্তি তত্ক্ষণাৎ এ দুনিয়ায় প্রদান করেন না। মানুষের সামনে মানুষ লজ্জা পাবে অসম্মানী হবে অপদস্থ হবে সম্ভবত এ কারণেই তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে শাস্তি প্রদান করেন না। তার অর্থ এই নয় যে, অন্যায় অবৈধ গর্হিত অনৈতিক বিধান লঙ্ঘন করার জন্য বিধান লঙ্ঘনকারীকে কখনো শাস্তি প্রদান করা হবে না। প্রত্যেকেরই তার নিজ নিজ কর্মের ফল অবশ্যই ভোগ করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের মার বড়ই কঠিন।’ (সূরা বুরুজ, আয়াত ১২)। আমরা অনেক সময় মনে করি, অমুকে অন্যায়ভাবে অর্থসম্পদ উপার্জন করেছে। অন্যের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করেছে। সে অনৈতিকভাবে সম্পদ গ্রহণ করে পাহাড়সম সম্পদের মালিক হয়েছে। কোথায় তার তো কিছুই হচ্ছে না। সে তো দিব্যি গাড়ি-বাড়ি হাঁকিয়ে সমাজে প্রতিভাবানদের মতো চলাফেরা করছে। আল কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যারা সীমা লঙ্ঘন করেছিল ও সেখানে অশান্তি বাড়িয়েছিল আর তোমার প্রতিপালক তাদের ওপর শাস্তির কশাঘাত হানলেন। তোমার প্রতিপালক তো সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।’ (সূরা ফাজর, আয়াত ১১-১৪)। সম্পদ বা অর্থ উপার্জন করায় ইসলামে নিষেধ নেই। উপার্জিত বা অর্জিত অর্থসম্পদ মোট কী পরিমাণ হবে এর কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা বা মাপকাঠি নেই। তবে সেই উপার্জিত বা অর্জিত অর্থসম্পদ হতে হবে ন্যায় ও নৈতিকতার সঙ্গে অর্জন। অর্থ উপার্জন হতে হবে যথার্থ ও বিধিসম্মতভাবে। অন্যায়-অসাধু, অবৈধ, অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জন মোটেই সংগত নয়। ইসলাম এটা মোটেই সমর্থন করে না। আমাদের নবী (সা.) ব্যবসার মাধ্যমে অর্থোপার্জন করতেন। ‘আল্লাহতায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন, আর সুদকে করেছেন হারাম।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৭৪)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমরা অবৈধভাবে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৮)।
ওপরের আয়াত দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, আল্লাহ ধনসম্পদ অবৈধভাবে ভোগ করতে নিষেধ করেছেন। আর ব্যবসা-বাণিজ্য তথা শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের নির্দেশ প্রদান করেছেন। রিজিক-রুজি বলতে আল্লাহ-প্রদত্ত ধনসম্পদ, পশুপাখি, জীবজন্তু হতে পারে। আবার মানুষের শ্রম দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী ধনসম্পদ বা পারিশ্রমিকও হতে পারে। তাই জীবিকা বা রুজি যে ধরনেরই হোক না কেন, তা হালাল বা বৈধ হতে হবে।
রুজি হালাল হওয়ার গুরুত্ব : আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের জন্য রুজিরও ব্যবস্থা করেছেন। পৃথিবীতে আসার আগে মায়ের গর্ভ থেকেই সে ব্যবস্থা তিনি করেছেন। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের স্তনে দুধের ব্যবস্থা করেছেন। তেমনি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে দ্রব্যসামগ্রী সে আহার করবে, সেগুলোর কোনোটি তার স্বাস্থ্যের, আত্মার, জ্ঞানের, কর্মের জন্য উপযোগী সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তা পবিত্র ও হালাল রূপে চিহ্নিত করেছেন। যে কাজের মাধ্যমে তার জন্য ও সমাজের অন্য লোকদের জন্য কল্যাণ নিহিত এবং কারও জন্য যাতে কোনো প্রকার ক্ষতি না হয়, সে ধরনের কাজ ও শ্রম দ্বারা অর্জিত রুজি-রোজগার হালাল করেছেন। আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিশ্রম করে হালাল রুজি কামাই করলে বান্দা এ পৃৃথিবীতে যেমন শান্তি পাবে, তেমন পরকালেও হবে পুরস্কৃত।
হালাল রুজির উপকারিতা : হালাল রুজি মানুষের শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়েই উপকারী ও কল্যাণকর। যে লোক দুধ পান করে সে লোকের যেমন স্বাস্থ্য ভালো হয়, তেমন তার বুদ্ধিও বাড়ে, তার মনমানসিকতা হয় দুধের মতো নির্মল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মদ পান করে মদ তার স্বাস্থ্যকে যেমন নষ্ট করে, তেমন মস্তিষ্ককে করে বিকৃত, ধ্বংস করে চরিত্রকেও। মানুষের কাছে হয় লাঞ্ছিত ও অপমাণিত।