সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয়-সংশ্লিষ্টতা প্রায় ৪৪ বছরের। সেই ১৯৭৭ সালে স্যারের স্ত্রী প্রয়াত ড. নাজমা জেসমিন চৌধুরী রচিত নাটক ‘আলোটা জ্বালো’ ঢাকা শিশু নাট্যম প্রযোজনা করেছিল। শিশু নাট্যমের সংগঠকরূপে সেই থেকে পরিচয়-আলাপচারিতা এবং ক্রমেই ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ। তবে স্যারের লেখার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল আরও আগে। স্যার এবং নাজমা আপার সক্রিয় সহযোগিতা ও সমর্থনে ১৯৭৮ সালে গঠিত হয়েছিল ঢাকা লিট্ল থিয়েটার। নাজমা আপা এবং স্যারকে কেন্দ্র করেই বলা যায় সংগঠনটির সার্থক পথচলা সম্ভব হয়েছিল। নাটকের মহড়া, দলের কার্যালয় তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসেই কেন্দ্রীভূত ছিল। অসংখ্য শিশু-কিশোর, অভিভাবক এবং সংগঠকের সরব উপস্থিতিতে তাঁদের আবাসটি পরিণত হয়েছিল সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্ররূপে। ১৯৮৯-এর ১২ সেপ্টেম্বর দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত নাজমা আপা অসময়ে চলে গেলেন। আমরা বঞ্চিত হলাম তাঁর মাতৃস্নেহ থেকে। সেই অপূরণীয় ক্ষতি আর পূরণ হলো না।
তিনি বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবী কারা? প্রধানত যাঁরা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে মেনে নিতে অসম্মত হন। এবং ব্যবস্থাটাকে বদলাতে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, তারাই বুদ্ধিজীবী’ কথাটি যে নির্ভুল সত্য সেটা বলা নিষ্প্রয়োজন। ওই যে ব্যবস্থাকে মেনে না নেওয়া এবং ব্যবস্থা বদলের জন্য কাজ করা। এটিই অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সুদীর্ঘকাল যাবৎ করে এসেছেন। তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে, বক্তৃতায়, লেখায় এ কথাগুলো বারবার প্রাসঙ্গিকক্রমে তিনি অবিরাম বলে এসেছেন। করে এসেছেন নানাবিধ কর্মকাণ্ড। তাঁর পাঠকের সংখ্যা নিরূপণ করা অসম্ভব বললে ভুল হবে না। এখনো তিনি সমান তালে লিখে চলেছেন। আমাদের জ্ঞান বিকাশে, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে আমাদের শানিত করে চলেছেন। তাঁর লেখা পাঠে সেটা আমরা বারবার উপলব্ধি করে এসেছি। আরেকটি কথা তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বলেন, জ্ঞান বৃদ্ধির অনুশীলনের কথা। প্রতিপক্ষদের পরাভূত করতে তাদের চেয়ে জ্ঞানে, মেধায় অগ্রগামী না হলে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করা সম্ভব হবে না। শাসক শ্রেণি জ্ঞানে অগ্রসর, তাদের পরাভূত করতে হলে জ্ঞানে তাদের অতিক্রম করতে হবে। আমাদের উপমহাদেশে বিপ্লবের অনেক সম্ভাবনার সৃষ্টি হলেও কেবল জ্ঞানের অভাবে সময়োচিত অবস্থান না নিতে পারার কারণে বিপ্লব সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমেই বিদ্যমান ব্যবস্থার বদল সম্ভব। যার কোনো বিকল্প নেই। ওই কাজটি করার ক্ষেত্রে জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করতে হবে। প্রতিপক্ষের চেয়ে জ্ঞানে অগ্রসর হতে হবে। নয়তো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়া অতীতেও সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রত্যাখ্যানের দৃঢ়তা। ওই প্রত্যাখ্যান তিনি তাঁর জীবনে অত্যন্ত সচেতনভাবে এবং দৃঢ় প্রত্যয়ে অনেকবার করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় পিতার নির্দেশে অর্থনীতিতে না পড়ে বাংলা সাহিত্যে পড়ার সংকল্পের কথা বলায় পিতার সঙ্গে মতবিরোধ ঘটে। পরে পিতা ও পুত্রের সমঝোতা হয়। সাহিত্য পড়লেও বাংলায় নয়, ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে হবে। তিনি যেহেতু সাহিত্যই পড়বেন তাই ইংরেজি সাহিত্য পড়ার অনুমতি লাভ করে ইংরেজি সাহিত্যেই ভর্তি হয়েছিলেন। অনার্স ও মাস্টার্সে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করার পর পিতা তাঁর জন্য সিএসপি পরীক্ষার ফরম ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শাসক সহযোগী আমলা হতে অস্বীকৃতি জানান এবং সিএসপি পরীক্ষার ফরমটি ছিঁড়ে ফেলেন। তখনকার সময় মেধাবীদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল সিএসপি হওয়া; কিন্তু তিনি সে পথে না হেঁটে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিলেন। পিতার নির্দেশ এক প্রকার প্রত্যাখ্যান করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। উপাচার্য পদ গ্রহণের জন্য তাঁকে তখনকার সামরিক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে উপাচার্যের পদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালে তিনি সেই পদ গ্রহণে অসম্মতির কথা জানানোর পর জেনারেল এরশাদ বলেছিলেন, তাহলে নির্বাচন কেন করেছেন? স্যারের সোজাসাপ্টা জবাব ‘আমাদের অস্তিত্ব প্রমাণে’। পরবর্তী সময়ে তিনবার তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তিনি তা নাকচ করে দেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দুবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কর্তৃক উপাচার্যের প্যানেলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথমবার ১৯৮৩ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯৯০ সালে। প্রথমবার তিনি সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাঁকে বাংলা একাডেমির সভাপতি মনোনীত করে প্রস্তাব দিলেও তিনি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
আজ ২৩ জুন ২০২৫, বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ, লেখক, গবেষক, নতুন দিগন্ত পত্রিকার সম্পাদক, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের ৯০তম জন্মদিন। আজ বিকাল ৪টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা দেবেন। বিষয় : ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের ভূমিকা’ অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত। তিনি প্রথাগত আত্মজীবনী লিখেননি। স্যারের ৯০তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা ও বিনম্র ভালোবাসা।
► নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত