ইউএনডিপির একটি প্রকাশনায় বিভিন্ন ধরনের বঞ্চনা এবং যারা পেছনে থাকতে পারে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে লিঙ্গ, বয়স, আয়, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, প্রতিবন্ধিতা, জাতীয়তা, আদিবাসী, শরণার্থী হিসেবে বৈষম্যের কারণে নাগরিক পরিচয়ের বাইরে বাস্তুচ্যুত বা অভিবাসী হয়ে পড়া লোকজন সুবিধাবঞ্চিত হয়। দ্বিতীয় পর্যায় ভৌগোলিক অবস্থা, রাস্তা, গণপরিবহন, ব্রডব্যান্ড, স্যানিটেশন এবং জ্বালানির মতো প্রাথমিক পরিষেবার সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় কিছু লোক বঞ্চিত হয়। সামগ্রিকভাবে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে গ্রামীণ লোকদের শহরাঞ্চলের মানুষের তুলনায় বহুমাত্রিক দরিদ্র হওয়ার আশঙ্কা বেশি। বিশ্বব্যাপী অসম বাণিজ্য, অর্থ, বিনিয়োগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদব্যবস্থার মতো শাসনব্যবস্থার অনেক বিষয় বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ছোট দেশগুলো পুরোপুরি বিশ্বায়নের সুফল লাভে বা উপকৃত হতে বঞ্চিত হয়। আর্থসামাজিক অবস্থান এবং আইন দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, দক্ষতা অর্জন, নিরাপত্তা, উত্তরাধিকারী বা সম্পদ অর্জনের অধিকার, ভূমির মালিকানা, জীবিকা নির্বাহের জন্য চাকরি খুঁজে পাওয়া, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি এবং নিরাপদ কর্মস্থল, বীমার সুবিধা এবং সামাজিক সুরক্ষা কৌশল, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ব্যাংক হিসাব খোলা, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ থেকে লাভবান হওয়ার বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। সব শেষে মানুষ যখন হিংসা, সংঘাত, স্থানচ্যুতি, অভিবাসীদের বিশাল স্থানান্তর, পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং অন্যান্য ধরনের জলবায়ুর ঘটনা বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঝুঁকিতে পড়ে তখন তারা পেছনে পড়ে যায়।
বঞ্চনার বিরুদ্ধে এসডিজির চারটি জাদুকরী শব্দ ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’ বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে এসডিজি যাত্রার আগে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে চালু রয়েছে এবং গত এক দশকে গতি অর্জন করেছে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের ‘উন্নয়ন চমক’ এবং ‘উন্নয়নের অনুসরণীয় উদাহরণ’ হয়েছে বাংলাদেশ।
আন্তরিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সম্পদ আহরণ, সহায়ক নীতিমালা, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং দরিদ্রবান্ধব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মেয়েদের শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং এগুলো নিয়ে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের সোনালি দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে; অনেক মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এমডিজির অনেক সফলতা থাকা সত্ত্বেও দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে দুর্বল মানুষ পেছনেই রয়েছে। লিঙ্গবৈষম্য, দরিদ্র ও ধনী পরিবারের মধ্যে ব্যবধান, গ্রামীণ ও শহর অঞ্চলের মধ্যে বড় ব্যবধান, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশের অবক্ষয়ের কারণে দরিদ্র মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উন্নয়নের পথে সংঘাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় হুমকি যার ফলে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ এখনো ঘরহীন, প্রাথমিক পরিষেবাসমূহ থেকে বঞ্চিত এবং ক্ষুধার্ত রয়ে যাচ্ছে। ২০২০ সালে মহামারী করোনা, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, অধিক বন্যা এবং নদীর ভাঙন দুর্বলদের আরও ঝুঁকিপূর্ণ করেছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, টেকসই পরিবেশ এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এ তিন নীতির পাশাপাশি ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’ এবং সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনকে প্রথমে সেবা দেওয়ায় এসডিজিকে বৈশ্বিক আকাক্সক্ষার সুসংহত এবং সমন্বিত কার্যক্রমে পরিণত করেছে। এর অর্থ হচ্ছে সবার জন্য বিশেষত সমাজের শেষ প্রান্তের লোকজনের জন্যও এসডিজির সব সুবিধা পৌঁছানো প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন হচ্ছে নারী, যুবক এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য বিনিয়োগ করা। সবার জন্য উন্নত জীবনের লক্ষ্যে স্থানীয় উদ্যোগ ও সমন্বিত কার্যক্রম প্রয়োজন। তদুপরি ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’র অর্থ হলো সর্বত্র চরম দারিদ্র্র্যের অবসান ঘটানো এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের মধ্যে অসমতা হ্রাস। সুতরাং ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’ যাওয়ার চাবি হলো প্রগতিশীল সর্বজনীনতার পথে সবচেয়ে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ চিহ্নিত করা এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। গড় ও সর্বজনীন অগ্রগতি যথেষ্ট নয়; তা সবার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে না বরং প্রান্তিক মানুষ বঞ্চিতই থেকে যায়। ‘কাউকে পেছনে না ফেলে’ তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিটি বিতরণের বিপরীতে কারা লাভবান হবে তার ওপর জোর দেওয়া হয়। সুতরাং গতানুগতিক কার্যধারার বদলে সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হবে এসডিজির আওতায়।
অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার জন্য এসডিজি বাস্তবায়নে সবার জন্য, সমাপ্তি ঘটানো, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সর্বজনীন, ন্যায়সংগত, সমান এবং অন্যান্য গুণগত ও পরিমাণমতো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যদি আমরা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এবং লক্ষ্যগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাব যে ‘শেষ’ শব্দটি এসডিজি-১ (দারিদ্র্যের অবসান), এসডিজি-২ (ক্ষুধা শেষ হওয়া) এ দুটি অভীষ্ট এবং ১১টি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ‘সবার জন্য’ ছয়টি অভীষ্ট এসডিজি-৩ (স্বাস্থ্যকর জীবন নিশ্চিত করা), এসডিজি-৪ (মানসম্পন্ন শিক্ষা), এসডিজি-৫ (লিঙ্গসমতা), এসডিজি-৭ (আধুনিক শক্তি), এসডিজি-৮ (অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান), এসডিজি-১৬ (শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান) এবং ১৮টি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এর পাশাপাশি, ‘অন্তর্ভুক্ত’ শব্দটি পাঁচটি অভীষ্টে এসডিজি-৪, এসডিজি-৮, এসডিজি-৯ (স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো), এসডিজি-১১ (মানববসতি), এসডিজি-১৬ এবং পাঁচটি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ছাড়া ‘সর্বজনীন’ শব্দটি আটটি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ‘অধিকার’ ছয়টি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ‘ন্যায়সংগত’ একটি অভীষ্ট এসডিজি-৪ এবং সাতটি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে এবং সবশেষে ‘সমতা’ শব্দটি দুটি অভীষ্ট এসডিজি-৫, এসডিজি-১০ (বৈষম্য হ্রাস) এবং ১২টি লক্ষ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। অভীষ্ট-১০-এর সব লক্ষ্য অসমতা হ্রাস করার বিষয়ে। সুতরাং এটি বলা যেতে পারে যে প্রত্যেকের চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো অভীষ্ট বাস্তবায়িত হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। তাই ‘কাউকে পেছনে না ফেলা’ ১৭টি অভীষ্টের জন্যই প্রযোজ্য। অতএব পেছনে কাউকে ছেড়ে না যাওয়া মানে প্রতিটি একক ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো এবং এটি ২০৩০-এর এজেন্ডার অন্যতম সুন্দর বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পেছনে থাকতে পারে ভূমিহীন মানুষ, ঘরহীন মানুষ, চর, হাওর, পার্বত্য ও দুর্যোগ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ, বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত, দুস্থ মহিলা, বয়স্ক মানুষ এবং অবিবাহিতা নারী, কিশোরী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, উপকূলীয় অঞ্চল এবং জলবায়ুতে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন, ক্ষুদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং জেলেরা। উপরোক্ত চিহ্নিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি আরও যারা পেছনে থাকতে পারে তারা হলো এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত, সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত, মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা, মাদকাসক্ত যুবক, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তি, স্কুল থেকে ঝরে পড়া শিশু, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণবিহীন ব্যক্তি। সহিংসতার শিকার মহিলা ও শিক্ষার্থী, গৃহকর্মী এবং হিজড়াদের ঝুঁকির মধ্যে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মী, প্রান্তিক মানুষ, চা বাগানের শ্রমিক, মালী, ড্রামবাদক, ধোপা, বাজনদার, দাই, হাজাম, রবিদাস, চামড়া শ্রমিক/মুচি, নাপিত, সাপুড়ে ইত্যাদি এসডিজিতে পেছনে থাকতে পারে। করোনার কারণে দিনমজুর, রিকশাচালক, পরিবহনকর্মী, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে কর্মরত, অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত মানুষ, সরকারি ক্ষেত্র ছাড়া প্রায় সব পেশার মানুষ এ তালিকাটি দীর্ঘায়িত করেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের লোনা জল, জলাবদ্ধতা এবং ভূমিক্ষয় আরও ঝুঁকিপূর্ণ করতে ভূমিকা রেখেছে। করোনা, আম্ফান, মারাত্মক পুনঃ পুনঃ বন্যা এবং নদীর তীর ভাঙনের কারণে গত আট মাসে ঝুঁকিপূর্ণ লোকের সংখ্যা ও মাত্রা উভয়ই বহুগুণে বেড়েছে।
নতুন আইন প্রণয়ন, ছোট ঋণ সুবিধা, প্রতিবন্ধী ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের জন্য ভাতা, সরকারি চাকরিপ্রাপ্ত পিতা-মাতার মৃত্যুর পরে পেনশন সুবিধাসমূহ, পারিবারিক সঞ্চয়পত্র, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি এবং আইন প্রয়োগ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। প্রতিবন্ধী কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন সংস্থা, অটিজম ট্রাস্ট, বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড ২০১৫, বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন অ্যাক্ট ২০০৮, জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬, খসড়া বাংলাদেশ শিল্প নকশা আইন ২০১৬ এবং খসড়া জাতীয় ওয়েব অ্যাক্সেসিবিলিটি স্ট্যান্ডার্ড ২০১৬ এসডিজি সম্পর্কিত পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সহায়তা, শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরির সুযোগ, সরকারি সুযোগে অন্তর্ভুক্তি এবং তাদের পণ্য বিক্রিসহ মূলধারায় আনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচি ঘোষণা করে যা বিগত দুই বছর যাবৎ কার্যকরভাবে বাস্তবায়নে সরকার কাজ করছে। আধুনিক কৃষি, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা, আধুনিক যোগাযোগ, পরিবেশ সংরক্ষণ, শিল্প ও বাণিজ্যে প্রযুক্তি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সবার জন্য ইন্টারনেট কার্যক্রম নিয়ে ডিজিটাল গ্রাম যা অন্য নামে বলা হয় ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বাস্তবায়ন হচ্ছে। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচি গ্রামের মানুষের জীবনমান বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈষম্য কমাতে সক্ষম হবে।
লেখক : সাবেক মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) ও সাবেক মুখ্যসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
 
                         
                                     
                                                             
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        