শনিবার, ৫ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

এলএসডি যুগে টিকটক রাজনীতি

সৈয়দ বোরহান কবীর

এলএসডি যুগে টিকটক রাজনীতি

পত্রিকায় দেখে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কীসের ছবি। এই ছেলেরা কি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের কোনো আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য গ্রেফতার হয়েছে? পুলিশ ভ্যানে তাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। ছেলেগুলোর চেহারা সপ্রতিভ। কদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। এজন্যই কি পুলিশ এদের গ্রেফতার করল? এমন ভাবতে ভাবতে খবরে চোখ বুলিয়ে চমকে গেলাম। এরা এলএসডি সেবকচক্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর নিখোঁজ এবং মৃত্যুর সূত্র ধরে পুলিশ এলএসডির মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ার তথ্য পায়। তরুণদের সর্বশেষ ক্রেজ এলএসডি। একটু পরে দেখলাম এলএসডি এমন একটা নেশা যা উদ্ধত করে, আত্মবিনাশী করে, আত্মহত্যাপ্রবণ করে একজন মানুষকে। হতাশা, বিষাদ থেকে রক্ষা পেতে এ নেশার চল হয়েছিল। এটি নেশা হিসেবে পুরনো হলেও বাংলাদেশে নতুন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুরনো নেশা হলেও বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে এলএসডির ব্যাপক চল শুরু হয়েছে তরুণদের মধ্যে। এলএসডি খেয়ে তরুণরা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, বোধশক্তিহীন, আত্মবিনাশী হয়ে উঠছে। সেজন্য ছবিতে তাদের গ্লানি নেই, কুণ্ঠা নেই, অপরাধবোধ নেই, তারা লজ্জিত নয়।

সংবাদপত্র পড়ে অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে দেখলাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। দেশে কাগজে-কলমে লকডাউন চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে অন্তত মাস্ক পরাটা বাধ্যতামূলক করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বাসে স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। মানুষ উপচে পড়ছে। বেশির ভাগ গণপরিবহন যাত্রীর মাস্ক নেই। বাজার হাটের অবস্থা তো আরও ভয়ংকর। রাস্তায় চলতে চলতে দেখবেন, স্বাস্থ্যবিধি মানে এমন মানুষের সংখ্যাই কম। মাস্ক পরা যেন এক শাস্তি। গত মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ওঠানামা করছে। কিন্তু ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন শঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় করোনা নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এর থেকে বাঁচার উপায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরা। কিন্তু কজন করছে তা? ঢাকায় তা-ও দোকানপাটে, গণপরিবহনে নানা স্টাইলে মাস্ক পরা হয়। কেউ নাকের নিচে, কেউ গলায় মাস্ক ঝুলিয়ে রাখে। মাস্ক যেন এক নতুন ফ্যাশন স্টাইল। কিন্তু ঢাকার বাইরে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন না দেশে করোনা মহামারী চলছে। ইউরোপ, সৌদি আরবসহ ৪১টি দেশ বাংলাদেশে সংক্রমণ বেশি হওয়ায় বাংলাদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত করোনায় প্রায় ১৩ হাজার মানুষ মারা গেছে। গত মের শেষ সপ্তাহে রংপুর গেলাম। আমার মায়ের মৃত্যুর ৪০ দিন পেরোনো স্মরণে কবর জিয়ারত ও দোয়া করতে। সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকেই দেখলাম মাস্ক উধাও। মাস্কের কথা বললে লোকজন হাসে। পীরগঞ্জের ছোট গ্রাম চতরা আমাদের বাড়ি, সেখানে ‘মাস্ক’ জিনিসটা কী তাই অনেকে জানে না। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি, মাস্ক পরার কথা বললে হাসে। এ হাসি আর ওই তরুণদের হাসি একই রকম। করোনাকালে আমার মনে হচ্ছে পুরো সমাজ যেন এলএসডিতে বুঁদ হয়ে আছে। না হলে কেন এ আত্মবিনাশী উপেক্ষা? আমরা যেন এলএসডি যুগে প্রবেশ করেছি।

করোনা তো একটা ব্যাধি। আমাদের সমাজে বীভৎসতা, অমানবিকতা, পৈশাচিকতা এক ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এ প্রবণতা করোনার চেয়েও ভয়াবহ। সেদিন একজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎ কী, এ নিয়ে তাঁর মত জানতে চাইছিলাম। বেচারা একটি ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। এখন চাকরি নেই। অনলাইন এবং বাড়িতে গিয়ে টিউশন করে কোনোমতে চলেন। আমার প্রশ্ন শুনে হাসলেন। তারপর বললেন, ‘এখনকার তরুণরা এলএসডির নেশায় বুঁদ হয়ে টিকটক বানাবে। টিকটক শেয়ার দেবে, লাইকি বাড়বে এরপর ভাইরাল হবে।’ আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তাই তো, আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎ কী? দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। অনলাইন ক্লাসের নামে এক তামাশা চলছে। গতবার এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি। এবার মাধ্যমিকের পরীক্ষাও হলো না। আগে তা-ও একটি খোলার তারিখ দিয়ে আশা ঝুলিয়ে রাখা হতো। এখন শিক্ষামন্ত্রী বলে দিলেন, করোনা সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে না নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে না। আবার তিনি বলছেন, ‘শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে।’ শিক্ষার্থীরা কী করবে? তারা এলএসডিতে আসক্ত হচ্ছে। কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। টিকটকের ফাঁদে নানা অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র। টিকটকের নামে এক নারীর ওপর নিপীড়নের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে নারী পাচারের ভয়ংকর কাহিনি বেরিয়ে এসেছে। এলএসডির আত্মবিনাশী প্রভাব কি শুধু তরুণ-কিশোররা? একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন পুরো সমাজ যেন এক আত্মবিনাশী পথে। আমরা সবাই কেমন যেন বীভৎস, উন্মাদ, অমানবিক হয়ে উঠছি। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম স্বামীকে কয়েক টুকরো করা হয়েছে। শুধু মেরে ফেলে মনের জ্বালা মেটেনি। এই ভয়ংকর মানসিকতা তৈরি হয় কীভাবে? সংবাদপত্রে দেখলাম একজন নারী চিকিৎসকের রক্তাক্ত লাশ পাওয়া গেছে। এজন্য মামলা করতে হবে। কিন্তু কেউ মামলায় বাদী হতে রাজি না। এ রকম অমানবিক বাংলাদেশ কেন হচ্ছে? এ রকম স্বার্থপর কেন হচ্ছে আমাদের সমাজ?

এখন চাপপাশে যা দেখছি, যা ঘটছে তা আমাদের বৈশিষ্ট্য নয়, এ আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নয়। কিন্তু আমরা যেন ক্রমে বদলে যাচ্ছি। আগে রাস্তায় একজন দুর্ঘটনায় পড়লে লোকজন ছুটে আসত। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেত। নিকটজনকে খবর দিত। এখন এ রকম দুর্ঘটনায় যদি কখনো পড়েন তাহলে খবর আছে। কয়েকজন এসে আপনার মানিব্যাগ, ঘড়ি, অন্যান্য দামি জিনিস অবলীলায় নিজের মনে করে নিয়ে যাবে। আর বেশির ভাগ মানুষ দূর থেকে মোবাইলে ঘটনার ভিডিও ধারণ করবে। তারপর তা ফেসবুকে দেবে। অপেক্ষা করবে ভাইরালের। এ রকম একটা সমাজে আমরা প্রবেশ করেছি যেখানে আমরা জানি না পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে। সন্তান জানে না তার পিতার বিপুল বিত্তের উৎস কী? স্বামীর মাসিক বেতন কত জানার পরও স্ত্রী ডায়মন্ডের হার দাবি করেন। আয়ের চেয়ে অসংগতির জীবন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। নব্বইয়ের দশকেও বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক ঘৃণা ছিল। দুর্নীতিবাজরা মানুষের সঙ্গে মিশতে আড়ষ্ট থাকত। চুরির টাকার বড়াই দেখা যেত না। কিন্তু সময় এখন পাল্টে গেছে। এলএসডির প্রভাবে এখন দুর্নীতিবাজরাই দাপুটে। দুর্নীতিবাজদের উল্লাসনৃত্যে সৎরা কোণঠাসা। দুর্নীতির অভিবাসন ঘটেছে। দুর্নীতিবাজদের মধ্যে নিম্নশ্রেণির দুর্নীতিবাজরা দেশে কিছু চুরি-চামারি করে। আর বড় দুর্নীতিবাজরা তো সব টাকা রপ্তানি করে। বলা হয়, গার্মেন্ট নাকি বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। আমি হিসাব করে দেখেছি এ তথ্য ভুল। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য হলো টাকা। প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় তার তুলনায় গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানি আয় তুচ্ছ। বাংলাদেশে দুর্নীতি নিয়ে কথা হয় হঠাৎ। হাঁপানি রোগীর মতো। শ্বাসকষ্ট হলে যেমন জোরে কাশে। তেমনি কারও সঙ্গে দেনা-পাওনায় ঝুটঝামেলা হলেই তাকে মহা উৎসাহে ধরা হয়। আর যতক্ষণ দেনা-পাওনায় সমস্যা নেই ততক্ষণ তার টিকিটি কেউ ধরতে পারে না। জি কে শামীম থেকে সাহেদ, ড্রাইভার মালেক থেকে ডা. আরিফ সবই শর্ত পূরণে ব্যর্থতায় দুর্নীতিবাজ। আবার স্বাস্থ্য খাত খোবলা করা মিঠু, বেসিক ব্যাংক চেটেপুটে সাফ করা বাচ্চুর কিছু হয় না। তারা গায়ে বাতাস দিয়ে ঘোরে। কিছুদিন আগে কানাডার বেগমপাড়ায় বাংলাদেশিদের বাড়ি নিয়ে খুব হইচই হলো। টিকটক রাজনীতির যুগে প্রথমবার নির্বাচন করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন ড. আবদুল মোমেন। তিনি বোঝেন কী বললে ভাইরাল হবে। তিনি এক বোমা ফাটালেন, বললেন, ‘আমরা আগে মনে করতাম কানাডায় বোধহয় রাজনীতিবিদদের বাড়িঘর বেশি। কিন্তু এখন খোঁজ নিয়ে দেখলাম আমলাদের বাড়িঘরই বেশির ভাগ।’ তাঁর এ কথায় লাইক, শেয়ার হলো বটে কিন্তু কানাডাসহ বিদেশে বাড়ির মালিকদের নামের তালিকা জাতি জানল না। হয়তো কোনো দিন জানবেও না। এখন বাংলাদেশে প্রভাবশালী অনেক আমলা দেশে ব্যাচেলর জীবনযাপন করেন। বউ-বাচ্চারা বিদেশ থাকেন। তাদের বিদেশি পাসপোর্টও আছে। অর্থাৎ দেশপ্রেমবিবর্জিত, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, আত্মবিনাশী একটি সমাজের চেহারা যেন প্রকট হচ্ছে। যে চেহারার সঙ্গে এলএসডির উপসর্গের মিল আছে। কেউ কারও অবস্থায় সুখী নয়। যিনি ভাড়াবাড়িতে থাকেন তিনি যেন মৃতপ্রায়, তার বাঁচা আর মরার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যিনি নিজের বাড়ি বা ফ্ল্যাটে থাকেন তার মতো দুঃখী যেন দ্বিতীয় কেউ নেই, আরেকটি বাড়ি না থাকলে তার ভবিষ্যৎ কী? এভাবেই অপ্রাপ্তির হতাশায় আকণ্ঠ ডুবে যাচ্ছে এই সমাজ, আমাদের চারপাশ। লোভ এখন সর্বব্যাপী। হেফাজত পরিচয়ের মাওলানা সাহেবদের যে বিত্তবৈভবের কথা আজকাল শুনছি তাতে লোভ মহামারী কোথায় পৌঁছেছে অনুমান করা যায়। প্রশ্ন হলো, সমাজটা এ রকম অনৈতিক হয়ে উঠছে কেন? কেন আমাদের নীতি উবে যাচ্ছে। মূল্যবোধের শিকড়কে কেন উপড়ে ফেলছি। অসহিষ্ণুতার বিষবাম্প ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকে অনেক কথা বলবেন। অনেকে সামাজিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেবেন। কিন্তু আপনি যদি রাষ্ট্রে বিশ্বাস করেন তাহলে মানতেই হবে রাজনীতিই হলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক শক্তি। রাজনীতিহীন রাষ্ট্রে সমাজ হয় ভারসাম্যহীন। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হবে রাজনীতি দিয়ে। রাজনীতিই হলো একটি দেশ ও সমাজের চালিকাশক্তি। রাজনীতি যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় চালকের আসনে না থাকে তাহলে ওই রাষ্ট্র ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেই। বিশে^র দেশে দেশে এটি প্রমাণিত, রাজনীতিকে যেখানেই নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে সেখানে রাষ্ট্রই ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ এবং বোধগম্য উদাহরণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। জনগণ তার পছন্দের প্রতিনিধিদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত করে। এরা হলেন সংসদ সদস্য। জনপ্রতিনিধিদের নেতা আবার তার নির্বাহী দায়িত্ব কয়েকজনকে ভাগ করে দেন। এরা হলেন মন্ত্রী। আর জনপ্রতিনিধিরা যেন ঠিকঠাকমতো কাজ করতে পারেন সেজন্য সহযোগিতা করতে কিছু লোক রাখা হয় বেতন দিয়ে। এরা হলেন কর্মচারী। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এরা চলেন। এদের বোধগম্য ভাষায় চাকরবাকর বলা যায়। এই হলো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালন পদ্ধতি। আর এজন্যই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘সবচেয়ে খারাপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো স্বৈরাচারী ব্যবস্থার চেয়ে উত্তম।’ এর প্রমাণ বিশে^র চারপাশে তাকালেই ঢের পাওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশে এক অদ্ভুত গণতন্ত্র চলছে। এখানে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আছেন, কিন্তু সংসদ সদস্যদের কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা ডিসিদের হাতে। এখানে মন্ত্রিসভা আছে কিন্তু মন্ত্রীদের কোনো ক্ষমতা নেই। সব ক্ষমতা আমলাদের হাতে। রাজনীতি এখন নিয়ন্ত্রক নয়। ফলে এ সমাজে এলএসডি সংক্রমণ ঢুকেছে।

ধরা যাক আপনি বাড়ির মালিক। আপনার বাড়িতে ড্রাইভার আছে, মালী আছে, রান্নার বাবুর্চি আছে, ঘর পরিষ্কারের লোক আছে। একদিন আপনি আবিষ্কার করলেন, আপনি বাড়ির মালিক ঠিকই কিন্তু আপনার কোনো ক্ষমতা নেই। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো গুরুত্ব নেই। আপনি সকালে লুচি আর আলুর দম খাবেন বলে আগের রাতে বাবুর্চিকে বললেন। বাবুর্চি বললেন, না, এটা সম্ভব নয়। আমি যা দেব তা-ই খেতে হবে। আপনি ঘুমুতে যাবেন। ঘর পরিষ্কারের লোক বললেন, এখন তো ঘুমাতে পারবেন না। আপনার চাকরবাকরই যদি আপনার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে তখন আপনি কী করবেন? অতিষ্ঠ হয়ে পাগল হয়ে যাবেন (এলএসডি আক্রান্ত) অথবা ঘর ছেড়ে চলে যাবেন। আপনি যদি বলিষ্ঠ, ব্যক্তিত্ববান হন তাহলে এসব চাকরবাকরকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেন, ভালো লোক নিয়োগ দেবেন। আর দুর্বল চিত্তের হলে চাকরবাকর জোট বেঁধে আপনাকে চালাবে। আপনি তাদের কথায় উঠবেন-বসবেন। আপনি তাদের ভয় পাবেন। এরা আপনার খাবারে বিষ মেশাতে পারে। রাতে এরা আপনার গলা টিপে মারতেও পারে। এ আতঙ্কে এদের হাতেই সংসারের চাবি তুলে দিয়ে আপনি আশ্বস্ত থাকতে চাইবেন।

বাংলাদেশ কি এখন এ রকম একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে? চাকরবাকরই যেন দেশের মালিক বনে গেছে। আর বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদরা টিকটকের চরিত্র হয়ে গেছেন। দেশে এখন রাজনীতি বলতে কিছু নেই, রাজনীতির নামে যা হচ্ছে তা হলো টিকটক। টিকটক নিয়ে বিশে^ হুলুস্থুল। এটা আসলে খুব ছোট্ট (৩০ থেকে ৯০ সেকেন্ড) ভিডিও কনটেন্ট। অল্প কিছু সময়ে এমন কিছু করতে হবে যাতে মানুষ আকৃষ্ট হয়। সময়স্বল্পতায় দ্রুত ভিডিও কনটেন্টের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এখন টিকটকে বিকৃতি, অশ্লীলতা এবং অরুচির উৎসব চলছে। বাংলাদেশের রাজনীতিও এখন শটকাট পদ্ধতিতে ধাবমান। রাজনীতি এখন মাঠেও নেই, জনগণের কাছেও নেই। এখন রাজনীতি চলে গেছে ফেসবুকে। ফেসবুকে লাইভে এসে নেতারা ঘোষণা দেন, হুমকি দেন। ফলে নেতৃত্বের চেইন অব কমান্ড নেই। ফেসবুকে যার যত ফলোয়ার, লাইক, শেয়ার তিনি তত বড় নেতা। ত্যাগী, পরীক্ষিত ইত্যাদি শব্দ কেবল বক্তৃতার জন্য সংরক্ষিত। রাজনীতিতে টিকটক ফরমুলাই এখন শক্তিশালী। একটা-দুইটা কথা বলে ঝড় তুলুন, ব্যস, আপনি ভাইরাল নেতা। কাদের মির্জা থেকে মন্ত্রী। সবাই দেড় মিনিটে কিছু বলে, করে ভাইরাল হতে চান। জনগণের কী হলো না হলো সে কথা কে ভাবে। টিকটক রাজনীতি সমাজকে লক্ষ্যহীন করেছে। চাকরবাকর যখন ড্রাইভিং সিটে বসেছে, সাধারণ মানুষ অধিকারহীন হয়ে পড়েছে তখন মানুষ আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর হয়েছে। অদ্ভুত এক আত্মহননের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে টিকটক রাজনীতির মহামারীতে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর