বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আফগানদের মানুষও হতে হবে

মনজুরুল আহসান বুলবুল

আফগানদের মানুষও হতে হবে

১. বাংলাদেশে একটু বয়সী মানুষ যারা তারা সবাই তার নাম জানবেন। তার অহিংস, উদারনীতির কারণে তাকে অনেকে ‘সীমান্ত গান্ধী’ নামেও জানতেন, কেউ বলতেন বাচ্চা খান, কেউ বলতেন বাদশাহ খান। তিনি একটা সময় পাকিস্তানের রাজনীতির অপরিহার্য মানুষ ছিলেন। পশতুন এই নেতার জন্মস্থান আফগানিস্তানে। তিনি খান আবদুল গাফ্ফার খান। সারা জীবন পাকিস্তানে রাজনীতি করলেও ১৯৮৮ সালে মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন তাঁকে যেন জন্মভূমিতেই দাফন করা হয়। আফগানিস্তানের জালালাবাদে তাঁর কবরস্থান ঘিরে গড়ে তোলা স্মৃতিসৌধ এখন দর্শনীয় স্থান। এ স্মৃতিসৌধের গায়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত উক্তি : ‘ভুলে যাও উজবেক, তাজিক, হাজারা বা পশতুন পরিচয়... যদি নিজেদের আফগান ভাবতে না পার তাহলে আফগানিস্তান টিকবে না।’

২. আফগানিস্তান নিয়ে হালফিল অবস্থা দেখে সীমান্ত গান্ধীর কথাই মনে পড়ছে। উজবেক, তাজিক, হাজারা ও পশতুন তো ছিল বা আছেই; এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কখনো মুজাহিদিন, কখনো তালেবান পরিচয়। এসবই আবার খন্ড-বিখন্ড কখনো আল-কায়েদা, কখনো আইসিস, কখনো আইএস-কে, কখনো নর্দান অ্যালায়েন্স, কখনো প্রতিরোধ যোদ্ধা- নানা পরিচয়ে। বেশি পুরনো ইতিহাসে না যাই, সবশেষ বিজয়ের পর কাবুল ও কান্দাহারে যখন তালেবানের বিজয়োল্লাস চলছে তখন কাবুলেই উদয় হলো নতুন সংগঠন ‘ইসলামিক স্টেট-খোরাসান’; সংক্ষেপে আইএস-কে। কাবুল বিমানবন্দরে হামলার জেরে আলোচনায় এসেছে এ জঙ্গিগোষ্ঠীর নাম।

সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে : আদতে এরা পশ্চিম এশিয়ার জঙ্গি সংগঠন আইএসের আফগান শাখা। বর্তমান পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তানের একাংশ নিয়ে প্রাচীন খোরাসান অঞ্চল। আইএসের আফগান শাখা ওই অঞ্চলকে তাদের নামে জুড়ে নিয়েছে। প্রায় দুই দশক আগে আইএসের প্রতিষ্ঠা করেন আল-কায়েদার ইরাকি শাখার প্রধান আবু মুসাব আল জারকোয়াই। সে সময় সংগঠনের নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্ত (আইএসআইএল)।

তুরস্ক, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন, সাইপ্রাস, প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েলের একাংশ নিয়ে গঠিত প্রাচীন লেভান্ত ভূখন্ড। পরে সাময়িকভাবে সংগঠনের নাম ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস)।

আইএস-কের লক্ষ্য খেলাফতের (খলিফার শাসন) পুনঃপ্রতিষ্ঠা। আফগানিস্তানের নানগরহর, নুরিস্তান, কুনার প্রদেশ আইএস-কের ঘাঁটি। জালালাবাদসহ নানগরহরের বেশ কিছু এলাকাতেই শিবির রয়েছে তাদের।

একদা পশতুন ‘ওয়ারলর্ড’ গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের নিয়ন্ত্রণে ছিল নানগরহর। পরে তালেবানের দখলে যায়। এখানে সক্রিয় আইএস-কে গোষ্ঠীতে পশতুনের পাশাপাশি আরব, পাক, উইঘুর ও মধ্য এশিয়ার জঙ্গিরাও রয়েছে। ২০১৪ সালে পাকিস্তান তালেবান নেতা হাফিজ সাইদ খান আইএস-কে গঠন করেন। তৎকালীন আইএসপ্রধান আবু বকর আল বাগদাদির অনুগামী হাফিজ ২০১৬ সালে আমেরিকার বিমান হামলায় নিহত হন। বাগদাদির মৃত্যু হয় ২০১৯-এ সিরিয়ায়। ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে আইএস-কের প্রায় ৩ হাজার জঙ্গি ছিল। তার বড় অংশই সাবেক তালেবান।

ওসামা বিন লাদেনের জমানায় আল-কায়েদার সঙ্গে সখ্য আইএস-এর। পরবর্তী আল-কায়েদাপ্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির সময় দুই সংগঠনের সম্পর্কে ফাটল ধরে। আল-কায়েদাঘনিষ্ঠ তালেবানেরও বিরোধিতা শুরু করে আইএস।

তালেবান ও আইএস দুটি সংগঠনই সুন্নি মতাবলম্বী। তালেবান দেওবন্দি মতাদশের অনুসারী। আইএস অনুসরণ করে সালাফি মতবাদ; সুফি মতবাদের কট্টর বিরোধী তারা। এ সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটুকু ধার করে জানালাম আফগানিস্তান আসলে আফগানদের হতে কত দেরি সে বিষয়টি বোঝানোর জন্য। এবারের তালেবান যদিও নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে কিন্তু গুয়ান্তানামো বে বা পাকিস্তানের জেলফেরত যাদের চেহারা আবার কাবুলে দেখা যাচ্ছে তাতে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না।

৩. ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১০০ বছর আগে ব্রিটিশের হাত থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্ত থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৮ বার বদলেছে আফগানিস্তানের পতাকা। গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য : ১৯০১ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেছেন বাদশাহ হাবিবুল্লাহ খান। তাঁর রাজত্বে পতাকায় ছিল একটি মসজিদের ছবি। মসজিদের ঠিক নিচে ছিল আড়াআড়ি দুটি তলোয়ার, পুরোটাকে বৃত্তাবদ্ধ করেছিল একটি ফুলের মালা।

১৯২১ সালে ব্রিটিশ থেকে পুরোপুরি মুক্তি পায় আফগানরা। তখন বাদশাহ আমানুল্লাহ খান। তিনি পতাকার ভিতরের মসজিদের ছবি বদলে দেন, নিচে তলোয়ারের আকারও খুব ছোট করেন এবং গোলাকার ফুলের মালার বদলে আট চূড়াবিশিষ্ট একটি নকশা এঁকে দেন।

১৯৭৮ সালে কমিউনিস্টদের হাতে দাউদ খান খুন হলে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন নুর মুহাম্মদ তারাকি। তিন রঙের পতাকা পরিণত হয় পুরো লাল রঙে। এক পাশে গমের ছবি দিয়ে ঘেরা একটি শব্দ। যার অর্থ ‘জনগণ’। আরও কয়েকবার পতাকা বদলের পর ১৯৯২ সালে কাবুলের দখল নেয় মুজাহিদিনরা। প্রথমে সিবগাতুল্লাহ মোজাদ্দেদি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট; দুই মাস পর বুরহানুদ্দিন রব্বানি হন নতুন প্রেসিডেন্ট। তাঁর আমলে সবুজ, কালো ও সাদা- এ তিন রঙে সাজে পতাকা।

১৯৯৬ সালে সাদা কাপড়ের মাঝে কালো হরফে কলমা শাহাদাত লেখা পতাকা ওঠে কাবুলে তালেবানের হাত ধরে।

২০০১ সালে আমেরিকার সেনারা আফগানিস্তানের দখল নেয়। রব্বানি ফের ক্ষমতায় ফিরে পতাকা বদল করেন। এরপর প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের আমলে ২০০৪ ও ২০১৩ সালে, আশরাফ গনির আমলে ২০১৪ সালে পতাকা বদলায়।

এবার আবারও কাবুলে নিজেদের পতাকা তুলেছে তালেবান। বারবার পতাকা বদল হয়েছে কিন্তু আফগানিস্তানকে নিয়ে সবাই যেমন আফগান হয়ে উঠতে পারেনি, তেমনি সাধারণ আফগানদের ভাগ্য বদল হয়নি।

৪. বিশেষজ্ঞ সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য : কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের ওপর বসে থেকেও বর্তমানে আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। প্রায় ৬ লাখ ৫২ হাজার বর্গকিলোমিটারের আফগানিস্তানকে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ খনিজসমৃদ্ধ দেশ বিবেচনা করা হয়। দেশটিতে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি বিভিন্ন খনিজ ক্ষেত্র রয়েছে। খনিজ ক্ষেত্রগুলোর আনুমানিক মূল্য ১ থেকে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার; মতান্তরে সেটা ৭ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। সোনা, রুপা, প্লাটিনাম, ইউরেনিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, তামা, লোহা, ক্রোমাইট, লিথিয়াম ছাড়াও রয়েছে উচ্চমানের পান্না, রুবি, নীলকান্তমণি, ফিরোজা ইত্যাদি রত্নপাথরের মজুদ।

যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপের (ইউএসজিএস) গবেষণা অনুযায়ী আফগানিস্তানে ৬০ মিলিয়ন মেট্রিক টন তামা, ২.২ বিলিয়ন টন লোহা, ১.৪ মিলিয়ন টন দুর্লভ বস্তু (যেমন ল্যান্থানাম, সেরিয়াম, নিউডিমিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম) রয়েছে। আর রয়েছে সোনা, রুপা, দস্তা, পারদ ও লিথিয়াম। দেশটিতে এত বেশি পরিমাণে লিথিয়াম আছে যে দেশটি বিশ্বের লিথিয়ামের রাজধানী হয়ে উঠতে পারে।

দুর্লভ বস্তু বা রেয়ার আর্থ ইলিমেন্ট (REE) হচ্ছে বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বস্তু। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে  REE- এর আবেদন বাড়ছে। হাতের মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ থেকে শুরু করে মহাকাশে পাঠানো স্যাটেলাইট, এমনকি হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরি ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে আরইইর ব্যবহার করা হয়। হাই-টেক শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আরইইর প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে।

বর্তমান পৃথিবীতে বলিভিয়ায় লিথিয়ামের সর্বোচ্চ মজুদ রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু পেন্টাগনের তথ্যানুযায়ী আফগানিস্তানের শুধু গজনি প্রদেশেই বলিভিয়ার চেয়ে বেশি লিথিয়ামের মজুদ রয়েছে। ইউএসজিএসের তথ্যানুযায়ী দেশটির হেলমান্দ প্রদেশে আনুমানিক ১.১ থেকে ১.৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন আরইইর মজুদ আছে।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) ও আফগানিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপের (এজিএস) একটি যৌথ গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, শুধু দেশটির উত্তরাঞ্চলেই বিভিন্ন তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রে আনুমানিক ১.৬ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল, ১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস ও ৫০০ মিলিয়ন তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। এখানে প্রচুর অনাবিষ্কৃত পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র রয়েছে বলে অনুমান করা হয়।

বেশির ভাগ অপ্রকাশিত অপরিশোধিত তেল ও গ্যাসের অবস্থান দেশটির উত্তরাঞ্চলে আফগান-তাজিক এবং আমু দরিয়া অববাহিকায়। ১৯৫৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যৌথভাবে সেখানে অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল। এরপর সোভিয়েত যুগে আমু দরিয়া অববাহিকায় ছয়টি তেল ক্ষেত্র ও আটটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এগুলোয় আনুমানিক ৯৬৩ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ও ৫২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

আমু দরিয়া অববাহিকার মতোই একটি হচ্ছে আফগান-তাজিক অপরিশোধিত তেল অববাহিকা। এ অববাহিকায় অপরিশোধিত তেল দেশটির উত্তর ও উত্তর-পুবের প্রায় ৩১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় অবস্থিত। ১৯৫৮ সালে আফগান-তাজিক অপরিশোধিত তেল অঞ্চলটি আবিষ্কৃত হয়। সে সময় সেখানে আনুমানিক ৯৪৬ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ও ৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ছিল। আফগান-তাজিক পাললিক অববাহিকায় তেল ও গ্যাস অঞ্চল ১২টি ব্লকে বিভক্ত। তার মধ্যে শুধু দুটি ব্লকেরই ৫১৪ মিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল ও ৯১ বিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। শুধু এ দুটি ব্লক দিয়েই আফগানিস্তানের জ্বালানি চাহিদা পূরণ সম্ভব।

দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে ইরান সীমান্ত থেকে ৯৫ কিলোমিটার দূরে প্রায় ২৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় অবস্থিত ত্রিপুল তেল অববাহিকা। আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পুবে ৪৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় রয়েছে কাটোয়াজ তেল ও গ্যাস অঞ্চল। এখানেও যথেষ্ট পরিমাণ তেল ও গ্যাসের মজুদ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে মরুভূমিতে প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে বিশাল অপরিশোধিত তেল অববাহিকা।

আফগানিস্তানে খনন করা প্রায় ৯৫ শতাংশ রত্নপাথর অবৈধভাবে উত্তোলিত হয় এবং তা কাটা ও বিক্রির জন্য অবৈধভাবে পাকিস্তানে চালান করা হয়। এরপর অবৈধভাবে পাকিস্তানের মাধ্যমে এসব রত্নপাথর বিশ্বজুড়ে রপ্তানি করা হয়।

মূল্যবান রত্নপাথরের পাশাপাশি আফগানিস্তানে সোনারও যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। শতাব্দীকাল ধরে আফগানিস্তানের গজনি, জাবুল, কান্দাহার, তাখার প্রদেশসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে সোনা উত্তোলন করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাদাখশান ও হেলমান্দ প্রদেশেও সোনার বিশাল মজুদ রয়েছে। পাহাড়সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি নদীর উপত্যকায় বিশেষ করে আনজির, হাসার, নুরাবা ও পাঞ্জ নদীর উপত্যকায় সোনার মজুদ রয়েছে। পাঞ্জ নদীর উপত্যকায় অবস্থিত সমতি খনিতে আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ মেট্রিক টন সোনা রয়েছে। এ ছাড়া গজনিতে থাকা সোনা ও তামার মজুদের আনুমানিক মূল্য ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পুবে অবস্থিত আয়নাক তামা খনিটি দেশটির অন্যতম মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত ভূতাত্ত্বিকরা কাবুলের আশপাশে খনিজসম্পদ খোঁজার জন্য ম্যাপ করেন। সে সময় আয়নাক, দারবান্দ ও জাওখর তামা খনিগুলো পুনরাবিষ্কার করা হয়। সে সময়ের জরিপ অনুযায়ী শুধু আয়নাক খনিতেই ২৪০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ২.৩ শতাংশ মানের তামা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আয়নাকের তামা বিশ্ববিখ্যাত।

কাবুল থেকে ১৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে বামিয়ান প্রদেশে বিখ্যাত হাজিগাক নামক লোহার খনির অবস্থান। ১৯৬০ সালে একটি সরকারি জরিপ অনুসারে হাজিগাক খনিটিতে ৬২ শতাংশ ঘনত্বের প্রায় ১.৮ বিলিয়ন টন লোহা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যা সেটিকে বিশ্বমানের লোহার খনি হিসেবে চিহ্নিত করে। এ ছাড়া হেলমান্দ প্রদেশে বেরিলিয়ামের একটি খনি পাওয়া গেছে, যা অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে হালকা এবং বিমান, হেলিকপ্টার, জাহাজ, মিসাইল ও মহাকাশযানে ব্যবহৃত স্টিলের চেয়ে শক্তিশালী। সেখানে আনুমানিক ৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের বেরিলিয়াম রয়েছে।

দেশটির খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ প্রদেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি অস্থিরতা। দেশটির বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন ও মিলিশিয়া গ্রুপের অর্থের প্রধান উৎস হচ্ছে অবৈধভাবে খনিজ উত্তোলন। ফলে বিভিন্ন খনির নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সংঘর্ষ ঘটে।

তালেবান ও আইসিস আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। এক তথ্যানুযায়ী শুধু তালেবান বছরে আড়াই থেকে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের খনিজ সম্পদ উত্তোলন করে; যা আফিমের পর তাদের আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস।

মাইনিং কোম্পানিগুলোর আফগানিস্তানের প্রতি অনাগ্রহের অন্যতম প্রধান কারণ যেখানে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্যাক্স দিয়েই পার পাওয়া যায় না, দিতে হয় স্থানীয় বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও মিলিশিয়া গ্রুপকেও।

একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞের মতে আফগানিস্তানে শাসকদের যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, দেশটিতে যদি টানা অন্তত ১৬ বছর স্থিতিশীল পরিবেশ থাকে, যদি আধুনিক বিজ্ঞানবিশেষজ্ঞরা দায়িত্ব পান; যদি পর্যাপ্ত বিদেশি বিনিয়োগ মেলে তাহলে নিজস্ব সম্পদেই আফগানিস্তান একটি স্বনির্ভর দেশ হতে পারবে। কিন্তু এতগুলো ‘যদি’ সহজ সমীকরণ নয়। আর শুধু আফগান দুর্নীতিবাজরা নয়, পাকিস্তানের দুর্নীতিবাজ সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন এ ‘যদি’গুলোর সামনে প্রধান বাধা হয়ে থাকবে।

৫. নিজেরা এত সম্পদশালী হয়ে আফগানরা কখনই আফগান হতে পারেনি। তাজিক, উজবেক, হাজারা, পশতুন তো ছিলই; রুশদের হঠাতে তারা হয়েছে মুজাহিদিন, মুজাহিদিনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তালেবান, এখন তালেবানের বিরুদ্ধে লড়ছে আইএস-কে, প্রতিরোধ যোদ্ধা বা নর্দান অ্যালায়েন্স। এর পেছনে বড় শক্তিগুলোর কলকাঠি তো ছিলই। রাশিয়ানদের তাড়াতে মুজাহিদদের সহায়তা দিয়েছে আমেরিকা, সৌদি আরবের সহায়তায় সেই মুজাহিদ তালেবান হয়ে তাড়াল আমেরিকাকে। দূর নেপথ্যে চীন থাকলেও নিকট প্রতিবেশী পাকিস্তান খেলেছে সব খেলা। তালেবানের ‘গডফাদার’ খ্যাত আইএসআই প্রধান জেনারেল হামিদ গুল ভারতবিরোধী জু জু দেখিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, সিভিল প্রশাসন এবং তালেবান ও পাকিস্তানের হোম গ্রোন জঙ্গিদের একাকার করে ফেলেছেন। এই হামিদ গুলকে যখন জাতিসংঘ সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল তখন সেখান বাদ সেধেছে চীন। অন্যদিকে তালেবানবিরোধী লড়াইয়ে পাকিস্তান যে আমেরিকার ভাড়া খাটা দেশ ছিল তার প্রমাণ মিলবে পারভেজ মোশাররফের আত্মজীবনীতে। সবশেষ প্রমাণ : তালেবানের শীর্ষনেতাদের জন্ম পাকিস্তানে বলে দাবি করেছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ। পাকিস্তানেই তালেবান নেতারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। পাকিস্তানের হাম নিউজকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে ইমরান খান সরকারের এই মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তালেবান নেতাদের অভিভাবকের মতো। দীর্ঘদিন ধরে আমরা তাদের খেয়াল রাখছি। পাকিস্তানে তারা আশ্রয় ও শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ পেয়েছে; আমরা তাদের জন্য সবকিছুই করেছি।’ তালেবানের সব প্রথম সারির নেতার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে। তারা পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখনো অনেক তালেবান সদস্য পাকিস্তানে পড়াশোনা করছেন বলে ওই সাক্ষাৎকারে দাবি করেন তিনি। পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তালেবান নেতা মোল্লা বারাদার পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রই তাঁকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করেছিল। পাকিস্তান তালেবানের কাছে সেকেন্ড হোমের মতো বলে এর আগে সংগঠনটির মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছিলেন। দুই দেশের মানুষ বলতে গেলে একে অন্যের সঙ্গে মিশে আছে। তবে পাকিস্তান যে সাপের লেজে পা দিয়ে বসে আছে তা হয়তো তারা এখনো বুঝতে পারছে না। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের হোম গ্রোন জঙ্গিরা তালেবানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাশ্মীর মুক্ত করতে। এ দুই জঙ্গিগোষ্ঠী যদি একসঙ্গে হয়, তার সঙ্গে প্রকাশ্যে নেপথ্যে যদি যুক্ত হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আশঙ্কা করি তাহলে প্রথম পতন হবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির। কারণ এ জঙ্গি ঐক্য পাকিস্তানের প্রথাগত রাষ্ট্রকাঠামো [যা নানা কারণে এমনিতেই ঠুনকো] পুরোপুরি ভেঙে দেবে। দ্বিতীয় আশঙ্কা, ভারতের ধর্মভিত্তিক শাসনে অতিষ্ঠ সংখ্যালঘুদের ক্ষুব্ধ অংশ, জঙ্গিগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের জঙ্গি ও তাদের ওপর ভর করে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে চায় তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। চাঙা হবে তাদের কার্যক্রম, যা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার জন্য যথেষ্ট। ইরানকে কেন্দ্র করে দোহার শাসক, বৈরুতের হিজবুল্লাহর যে সমীকরণ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বলয় তৈরি করেছে তার সঙ্গে বর্তমান কাবুলের তালেবান ঐক্য সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়েই থাকবে।

আপাতত চীন তালেবানের বড় ভরসাস্থল হলেও উইঘুর ইস্যু নিয়ে তালেবানের অবস্থান একসময় চীনকেও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে তা খুব সহজেই ধারণা করা যায়।

৬. মার্কিন বাহিনীর হাতে তালেবানের পতনের পর নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ওসামা ২০০৩’ যতবার দেখি ততবার চোখ ভিজে ওঠে। দড়ি লাফানো এক উচ্ছল কিশোরী কীভাবে তালেবানের হাত থেকে রক্ষা পেতে চুল কেটে বালক সেজে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে, কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। বালিকা কেন বালক সাজার চেষ্টা করেছিল এ অপরাধে তার সাজা হয়। তাকে তার চাইতে পাঁচ গুণ বয়সী এক বৃদ্ধের সঙ্গে যেতে হয় চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে।

আজ থেকে চার দশক আগে নমস্য খান আবদুল গাফ্ফার খান যে পরামর্শ দিয়েছিলেন : ... ভুলে যাও উজবেক, তাজিক, হাজারা বা পশতুন পরিচয়... যদি নিজেদের আফগান ভাবতে না পার তাহলে আফগানিস্তান টিকবে না।

তাঁর সঙ্গে যোগ করে বলি, আফগানদের আধুনিক মানুষও হতে হবে, মানবিক হতে হবে। তা না হলে শুধু অস্ত্র, শুধু যুদ্ধ, শুধু রক্ত ঝরিয়ে; নারীদের বোরকায় আবদ্ধ রেখে আফগানিস্তান একটি আধুনিক দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না। আফগানিস্তান এ রকম একটি দেশ না হলে; দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হয়তো তাদের জন্মভূমিকে নিয়ে বলতে পারবে না ‘ইনহাস্তরয়াতানম’- এই তো আমার জন্মভূমি। বরং নতুন প্রজন্ম হয়তো অন্যভাবে বলবে- এই কি আমার জন্মভূমি?

তথ্য : বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে নেওয়া।

                লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর