বুধবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আর কত লাঞ্ছিত হবে নারী

সুমন পালিত

আর কত লাঞ্ছিত হবে নারী

মানবসভ্যতার শুরু সম্ভবত ৭ হাজার বছর আগে। কোথায় প্রথম সভ্যতার বিকাশ ঘটে তা হলফ করে বলার সুযোগ নেই। অনুমিত হিসাবে মিসরের নীল নদের তীরে সম্ভবত প্রথম সভ্যতার বিকাশ। সিন্ধু, সুমের, পারস্য, ব্যাবিলন, রোমান ও ইজিয়ান সভ্যতাও প্রাচীনত্বের দাবিদার।

কালের বিবর্তনে আফ্রিকা আজ পিছিয়ে পড়া মহাদেশ। অথচ এ আফ্রিকার মিসরেই সম্ভবত প্রথম মানবসভ্যতার উন্মেষ। মিসর, সুদান এমনকি ইথিওপিয়াও ছিল সভ্যতার দিক থেকে এগিয়ে। মিসরের দুই রানী ক্লিওপেট্রা ও নেফারতিতি যেমন ছিলেন ভুবনমোহনী সুন্দরী তেমন বিদুষী। বীর নারী হিসেবেও তাঁদের সুনাম সুবিদিত। রানী ক্লিওপেট্রা ছিলেন প্রাচীন মিসরের টলেমিক বংশের সবচেয়ে মশহুর শাসক। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের সেনাপতি টলেমির বংশধর। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর টলেমি মিসরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। টলেমিদের আমলে মিসরে গ্রিক ও মিসরীয় ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে ক্লিওপেট্রার আগে যেসব টলেমি শাসক ছিলেন তাঁরা মিসরীয় ভাষা জানতেন না, এমনকি মিসরীয় ভাষা শেখারও চেষ্টা করেননি। এ ক্ষেত্রে ক্লিওপেট্রা ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি মিসরীয় ভাষায় দক্ষ ছিলেন। বাবা ফারাও টলেমি অলেটেসের সঙ্গে তিনি যৌথভাবে মিসর শাসন করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই ত্রয়োদশ টলেমি ও চতুর্দশ টলেমির সঙ্গে যৌথভাবে দেশ চালাতেন ক্লিওপেট্রা। আপন দুই ভাইয়ের সঙ্গে বিয়েও হয় তাঁর। এটি ছিল সে সময়কার মিসরীয় রাজ পরিবারের প্রথা। পরে ক্লিওপেট্রা তাঁর দেশের একক শাসকে পরিণত হন।

মিসরের শাসক বা ফারাও হিসেবে ক্লিওপেট্রা তৎকালীন বিশ্বের শক্তিকেন্দ্র রোমের শাসক জুলিয়াস সিজারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। এ সম্পর্ক ক্লিওপেট্রার অবস্থান আরও শক্তিশালী করে। ক্লিওপেট্রা তাঁর বড় ছেলের নাম রাখেন সিজারের নামের সঙ্গে মিলিয়ে সিজারিওন।

প্রাচীন মিসর এবং রানী নেফারতিতি দুটি যেন অবিচ্ছেদ্য। মিসরের ব্র্যান্ড নেম হিসেবে ভাবা হয় পিরামিড ও মমিকে। একইভাবে রানী নেফারতিতিও প্রাচীন মিসরের এক ব্র্যান্ড নেম। খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭০ থেকে ১৩৩০ পর্যন্ত মিসর শাসনে নেফারতিতির সরব উপস্থিতি ছিল। রহস্যময় এ রানী সম্পর্কে অসংখ্য রটনা রয়েছে। তিনি বিয়ে করেন ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের সন্তান আখেনাতেনকে। যিনি মিসরের চতুর্থ ফারাও হিসেবে আবির্ভূত হন।

রানী নেফারতিতি ছিলেন প্রভাবশালী শাসক। সুন্দরী হিসেবেও তাঁর তুলনা ছিলেন তিনি নিজেই। ফারাও আখেনাতেন ও রানী নেফারতিতি যৌথভাবে দেশ শাসন করতেন। যেহেতু ফারাওদের মধ্যে ভাই-বোনের বিয়ের প্রচলন ছিল সেহেতু আখেনাতেন ও নেফারতিতি ভাই-বোন ছিলেন এমনটিও মনে করেন অনেকে। আবার অনেকের ধারণা, নেফারতিতি ফারাও রাজদরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আয়ের কন্যা।

রানী নেফারতিতি ও ফারাও আখেনাতেন মিসরের ধর্মব্যবস্থাকে নিজেদের কবজায় আনেন। মিসরীয়রা ছিল বহু ঈশ্বরের ধারণায় বিশ্বাসী। কিন্তু ফারাও আখেনাতেন ও নেফারতিতি শুধু সূর্যদেবতার উপাসনার প্রবর্তন করেন। এর আগে মিসরীয়দের ধর্মাচার হতো অন্ধকারে। রানী নেফারতিতি ও ফারাও আখেনাতেনের প্রবর্তিত ধর্মব্যবস্থায় প্রকাশ্য দিনের আলোয় অনুষ্ঠিত হতো সূর্যদেবের উপাসনা। ফারাওর নির্দেশে রাজ্য থেকে সূর্যদেবতা ছাড়া অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়। এর ফলে পুরোহিতদের আয় ও সামাজিক প্রভাব কমে যায়। তারা ফারাও ও রানীর ওপর ক্ষুব্ধ হলেও তাদের প্রবল প্রতাপের সামনে ছিলেন অসহায়। রানী নেফারতিতি ও ফারাও আখেনাতেনের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় ক্ষেত্রেও ফারাওদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। এ উদ্দেশ্যে শুধু সূর্যদেবতার আরাধনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফারাও আখেনাতেনের নামের অর্থ ছিল সূর্যের পুত্র। সূর্যদেবতার কৃপা পেতে তার পুত্র ফারাও আখেনাতেন ও রানী নেফারতিতির পূজার বিধান চালু করা হয় মিসরে। সূর্যদেবতার মহিমা প্রচারে তিনি এক শহর নির্মাণের কাজও শুরু করেন। কিন্তু সে শহর তৈরির আগেই মারা যান আখেনাতেন। এরপর একক ফারাও হিসেবে মিসর শাসন করেন নেফারতিতি। সূর্যদেবতার শহর তৈরির কাজ তিনি আরও জোরেশোরে শুরু করেন। কিন্তু সে শহরের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগে নেফারতিতিও মারা যান। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন মিসরের পুরোহিতরা। ফারাও আখেনাতেন ও রানী নেফারতিতির কোনো পুত্রসন্তান ছিল না, ছিল ছয় কন্যা। ফলে ফারাও আখেনাতেনের আরেক রানীর শিশুপুত্র  তুতেনখামেনকে সিংহাসনে বসান পুরোহিতরা। শিশু ফারাওকে সামনে রেখে তাঁরা নিজেরাই ক্ষমতার চালিকাশক্তিতে পরিণত হন। মিসর থেকে নেফারতিতির সব স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা করেন পুরোহিতরা। এমনকি তাঁর মমিও উধাও করে ফেলা হয়।

সেই প্রাচীনকালে শিবা দেশের রানীর সুনাম ধারেকাছের সব দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে রয়েছে শিবার বিদুুুুুষী রানীর কথা। সে সময় জেরুজালেমের রাজা ছিলেন সুলেমান। ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের কাছে তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত পুরুষ বা নবী হিসেবে সম্মানিত। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্যানুযায়ী রাজা সুলেমানের বীরত্ব, ধনসম্পদ ও বাগ্মিতার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল সব দেশে। শিবার রানীর কাছেও সে সুনাম পৌঁছে ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের মাধ্যমে। তিনি রাজা সুলেমানের ঐশ্বর্য এবং প্রজ্ঞা নিজের চোখে দেখার জন্য সুদূর শিবা থেকে জেরুজালেমে আসেন। সঙ্গে ছিল বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র প্রহরী ও দাসদাসী। উটগুলোর পিঠে ছিল রাজা সুলেমানের জন্য উপহার হিসেবে আনা ১১০ মণ সোনা। মণিমুক্তার পরিমাণও ছিল বিশাল। ছিল বিপুল পরিমাণ সুগন্ধি মশলা।

শিবার রানীকে রাজা সুলেমান সংবর্ধনা জানান তাঁর দরবারে। রানীর দেওয়া উপহারও তিনি গ্রহণ করেন বেশ সন্তুষ্টচিত্তে। রাজা সুলেমানের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরীক্ষা নিতে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেন শিবার রানী। রাজার দেওয়া জবাবেও তিনি সন্তুষ্ট হন। জেরুজালেম থেকে রাজা সুলেমানের বিভিন্ন উপহার নিয়ে ফিরে যান স্বদেশে।

মিসর দুনিয়াজুড়ে সবচেয়ে জনবহুল আরব দেশ হিসেবে পরিচিত। সবারই জানা, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের আরবীয় সময়কে আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ বলে অভিহিত করা হয়। সে যুগেও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের ছিল অবাধ অংশগ্রহণ। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথমা স্ত্রী বিবি খাদিজা ছিলেন সে সময়ের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। প্রাক-ইসলাম যুগে এমনকি ইসলামী যুগেও মেয়েদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের নজির রয়েছে। এমনকি রসুল (সা.)-এর সম্মানিতা স্ত্রী হজরত আয়েশা (রা.) হজরত ওসমান (রা.) হত্যার বিচার না হওয়ার প্রতিবাদে হজরত আলী (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। উটের পিঠে বসে সে যুদ্ধের নেতৃত্বও দেন তিনি। যা ইতিহাসে জঙ্গে জামাল বা উটের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।

সোজা কথায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার পরও সমাজে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফত আমলে অনেক নারী সমাজসেবা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিশিষ্ট ভূমিকা রেখেছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, মানবসভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল যে দেশটিতে সেই মিসর আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ‘থাইল্যান্ড’ নামে পরিচিতি লাভ করছে। থাইল্যান্ডের মতো মিসরেও চলছে নারীকে ভোগের পণ্য হিসেবে ব্যবহারের অপমানজনক ঘটনা। থাইল্যান্ডে পতিতাবৃত্তিকে বাঁকা চোখে দেখা হয় না। আরব দেশগুলোয় যা কল্পনা করাও কঠিন। আইনগতভাবে মিসরে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ। ইসলামে কোনোভাবেই পতিতাবৃত্তিকে অনুমোদন করা হয় না। কিন্তু মিসর শুধু নয়, ইরাক এমনকি সৌদি আরবেও মুতা বিয়ে এবং মিসইয়ার বা সংক্ষিপ্ত বিয়ের নামে যা ঘটছে তার সঙ্গে পতিতাবৃত্তির কোনো পার্থক্য আছে কি না বিবেচ্য বিষয়। মিসরে নারীর মর্যাদা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার প্রমাণ মেলে এক সমীক্ষায়। বলা হয়েছে, শিশু ধর্ষণের দিক থেকে ১১৮টি দেশের মধ্যে মিসরের স্থান দ্বিতীয়। দেশটিতে গড়ে প্রতি বছর ২ লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হন। মিসরীয় নারীদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে মুতা বা সাময়িক বিয়ে। দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাদের বাধ্য করা হয় মুতা বিয়েতে। বিদেশি পর্যটকের অনেকেই মিসরে এসে নারীভোগের জন্য মুতা বিয়েতে আবদ্ধ করেন কোনো না কোনো তরুণীকে। মিসরের গরিব মা-বাবারা তাদের কন্যাকে অনেক সময় বিদেশি পর্যটকদের সঙ্গে মুতা বিয়েতে বাধ্য করেন। ইসলামে একপর্যায়ে মুতা বিয়ে জায়েজ বা বৈধতা পেলেও পরে তা রহিত হয়। সুন্নি মুসলমানরা মুতা বিয়েকে অনুমোদন না করলেও শিয়াদের মধ্যে এ বিতর্কিত বিয়ে আজও বিদ্যমান। তবে সুন্নি মুসলমানদের দেশ মিসরে মুতা বিয়ে চালু রয়েছে ব্যাপক হারে।

মানবসভ্যতার আরেক পাদপীঠ দজলা-ফোরাতের দেশ ইরাকের ধর্মীয় নেতার অনেকে মুতা বিয়ের নামে মেয়েদের দেহব্যবসায় উৎসাহিত করেন। বিবিসি আরবি নিউজের ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবরের এক প্রতিবেদনে মুতা বিয়ের নামে কীভাবে যৌন ব্যবসা চলছে তা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ইরাকের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাজারের আশপাশে ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা পরিচালিত কাজি অফিসগুলোয় মুতা বিয়ে অহরহ ঘটে। মাত্র এক ঘণ্টার জন্যও তারা মুতা বিয়ে দেন। কথিত ধর্মীয় নেতাদের কেউ কেউ বিয়ের নামে উপভোগের জন্য অল্প বয়সী মেয়ে সরবরাহের প্রস্তাবও দেন বিবিসির প্রতিবেদককে। প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, ধর্মীয় নেতারা নারী ব্যবসার দালাল হিসেবে কাজ করছেন।

৫ জুলাই ২০২১ এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি সমাজে নামমাত্র বিয়ে ‘মিসইয়ার’-এর সংখ্যা বাড়ছে। গড়পড়তা ১৪ থেকে ৬০ দিনের জন্য থাকে এ বৈবাহিক সম্পর্ক। তারপর হয়ে যায় বিচ্ছেদ। সৌদি আরবে এ ধরনেরে বিয়ে বছরের পর বছর ধরে বৈধতা পেলেও  ইসলামী চিন্তাবিদরা এমন বিয়েকে উচ্ছৃঙ্খলতাকে বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা বলে সমালোচনা করেছেন। শুধু সৌদি নাগরিকরা নন, প্রবাসীরাও ঝুঁকছেন মিসইয়ার বিয়ের দিকে। এ ব্যাপারে এগিয়ে সৌদিতে অবস্থারত অন্যান্য আরব দেশের নাগরিকরা। সমালোচক কেউ কেউ এ ধরনের বিয়েকে সৌদি ঘরানার লিভ টুগেদার বলে অভিহিত করেন। সৌদিসহ আরব দেশগুলোয় বিয়ে মানেই এক ব্যয়বহুল প্রথা। আরব যুবকদের বিয়ের সময় কনের বাবাকে বিপুল পরিমাণ সোনা উপহার হিসেবে দিতে হয়। ফলে অনেক যুবকের পক্ষে সময়মতো বিয়ে করা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে ধনাঢ্য যারা তারা একাধিক স্ত্রী রাখা শুধু নয়, মিসইয়ার হিসেবে পরিচিত নামমাত্র বিয়েতে আবদ্ধ হয়ে ভোগবাদের গড্ডালিকায় গা ভাসান।

সংক্ষিপ্ত বিয়ের নামে নারীকে যৌনপণ্য হিসেবে ব্যবহার ইসলামী চেতনার পরিপন্থী হলেও তা অবাধে ঘটছে আরব দেশগুলোয়। এ ব্যাপারে ধর্মনেতরা নিন্দা করেই খালাস! এ কুপ্রথা বন্ধে তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। পাশাপাশি আরব আইনপ্রণেতা তথা সরকারগুলোকে নারী লাঞ্ছনা রোধে দাঁড়াতে হবে নারীর পাশে।

                লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

Email : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর