রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

কুমিল্লাকেন্দ্রিক কিছু কথা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

কুমিল্লাকেন্দ্রিক কিছু কথা

আমার জন্ম কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র মনোহরপুরের পৈতৃক নিবাসে। ব্যাংক এবং ট্যাংক বা পুকুরের জন্য বিখ্যাত কুমিল্লা শহর একসময় শান্ত, সৌম্য ও সৌন্দর্যের মূর্তপ্রতীক ছিল। আমার জন্মভিটার চারদিকে ৫০০ গজের মধ্যে পাঁচটি এবং ১ হাজার গজের মধ্যে ১০টি দিঘি ও পুকুর ছিল। দিঘি বা পুকুরের স্বচ্ছ জলে দল বেঁধে গোসল করে আর সাঁতার কেটে একতাবদ্ধ হয়ে চলতে শিখেছি। ছাত্রাবাস জীবন, চাকরি জীবন আর দীর্ঘ প্রবাস জীবনে কুমিল্লার মানুষের ঐক্য অনেকেরই হিংসার কারণ ও আলোচনার বিষয় ছিল। ঈদে কুমিল্লার ছেলেদের দড়ি দিয়েও অন্য কোথাও বেঁধে রাখা যায় না বলে অনেক গিন্নির অভিযোগ পাওয়া যায়। সেই কুমিল্লা পরপর বেশ কিছু বিরূপ বা ‘কু’ সংবাদের জন্ম দেওয়ায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে কাঁদছি। ২২ নভেম্বর সোমবার টেলিভিশনের পর্দায় ‘ব্রেকিং নিউজ’ হিসেবে কাউন্সিলর সোহেলের খুন হওয়ার সংবাদ দেখে দ্রুতই টিভি অফ করে দিই। কারণ আমাদের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার সোহেল আমাদের পাড়ারই ছোটভাই। আমাদের চোখের সামনে ওর বেড়ে ওঠা। তাই এমন সংবাদের ধকল নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। পরে বাসায় ফোন করে জানলাম আমাদের সোহেল নয়, খুন হয়েছেন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সোহেল। তাকেও চিনতাম যেমনটা মফস্বলের ছোট শহরের সবাই একে অন্যকে চেনে। পরে জানা গেল মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে এ খুন বলে ধারণা করছেন কুমিল্লার মানুষ, যা বিশ্বাস করার অনেক কারণ আছে।

কুমিল্লা শহরের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের অবস্থান ভারত সীমান্ত আর শহরের প্রাণকেন্দ্রের মধ্যে। আর কুমিল্লা শহরের আধিপত্যের অর্থ হলো বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইফলাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও রেলসড়কের ওপর আধিপত্য। ২০০৩-০৪ সালে সেনা অফিসার হিসেবে কুমিল্লা শহরে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছি। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের যেখানে কাউন্সিলর সোহেল খুন হয়েছেন সেই পাথুরিয়া ও পাশের জগন্নাথপুর, অরণ্যপুর, বিবিরবাজার সড়ক, টিক্কারচর, চকবাজার প্রভৃতি এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সীমান্ত থেকে অনেক মাদক রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার গোপন তথ্য প্রায়ই পাওয়া যেত তখন। এ ছাড়াও গোমতী নদীর বালু বিক্রির ভাগবাটোয়ারা-কেন্দ্রিক বহু দল ও উপদল ছিল এ ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে। সুতরাং কাউন্সিলর সোহেলকে খুন করে এ মাদক সাম্রাজ্যের নতুন অধিপতি কে হন তা-ই হয়তো লক্ষ্য করবেন অনেকে। অথচ কুমিল্লা এমন ছিল না। কুমিল্লা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থভূমি। শহরের পশ্চিমে অবস্থিত ময়নামতি ও শালবন বৌদ্ধ বিহার ছিল মূলত একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধরনের বিদ্যাপীঠ। তখনকার দিনে শিক্ষা ছিল মূলত গুরুমুখী ধর্মীয় শিক্ষা। তাই দেশ-বিদেশের শত শত জ্ঞানপিপাসু বৌদ্ধ ভিক্ষু কুমিল্লার শালবনের বৌদ্ধ বিহারে বছরের পর বছর ধ্যান করতেন শান্ত পরিবেশে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কুমিল্লার শালবন বৌদ্ধ বিহারে জ্ঞানচর্চা শুরুর অন্তত ৪০০ বছর পর ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয় এবং প্রথম দিকে সেখানে ধর্মই পড়ানো হতো। তারও ১০০ বছর পর চালুু হয় ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয় ১৬৩৬ সালে, অর্থাৎ কুমিল্লায় শালবন বৌদ্ধ বিহারে বিদ্যা অন্বেষণ শুরুর প্রায় ৮০০ বছর পর। দুঃখের বিষয় এই যে, কালের বিবর্তনে এ শালবন বিহার মাটির নিচে তলিয়ে যায়। সেই সঙ্গে তলিয়ে যায় কুমিল্লার স্বর্ণযুগ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাটির নিচে এ বিহারের সন্ধান মেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন কুমিল্লার বহু বীর সেনানী। দেশত্যাগের পর কুমিল্লার কৃতী সন্তান মেজর আবদুল গনি এই সেনাদের নিয়েই গড়ে তোলেন ‘দি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাঙালি সেনাদের নিয়ে গড়া বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাঞ্জাব, বেলুচ বা আজাদ কাশ্মীর রেজিমেন্ট থেকে কোনো অংশে কম ছিল না, তা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেই প্রমাণিত হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের বীজ বপন করেছেন কুমিল্লার আরেক কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্য হিসেবে তিনিই ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় গণপরিষদের কার্যবিবরণী চালুর দাবি উত্থাপন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরপরই কুমিল্লা আলোচনার কেন্দ্রে আসে খাদি বা খদ্দর কাপড়ের কারণে। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে ‘স্বদেশী পণ্য গ্রহণ ও বিদেশি পণ্য বর্জন’ নীতি সমর্থন করে উপমহাদেশে খাদি কাপড়ের প্রচলন শুরু হয়েছিল। মাঝে তা স্তিমিত হলেও ভাষা আন্দোলনের পর কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ও পরে কোটবাড়ীর পল্লী উন্নয়ন একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান কুমিল্লার চান্দিনায় ‘দি খাদি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর শুরু হয় দেশি খদ্দর কাপড়ের স্বর্ণযুগ। পল্লী উন্নয়ন, কৃষিতে আধুনিকায়ন ও সমবায় আন্দোলনেরও পথিকৃৎ কুমিল্লা।

আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯২১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে কুমিল্লায় এসেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কুমিল্লার মানুষ নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মনে কাঁপন ধরিয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে থেকে নজরুল কুমিল্লার মুরাদনগরের বাঙ্গুরা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের আলী আকবর খাঁ এবং শহরের কান্দিরপাড়ে বন্ধু ও সহপাঠী বীরেন্দ্র কুমার সেনের আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আলী আকবর খাঁর নিঃসন্তান বোন ইফতেখারুন্নেসা এবং ধীরেন্দ্রর মা বিজয়াসুন্দরী দেবী- উভয়কেই তিনি ‘মা’ বলে ডাকতেন এবং তাঁদের কাছে বসে ভাত খেতেন। কুমিল্লার মুসলমান কন্যা সৈয়দা নার্গিস আসার খানমকে নজরুল বিয়ে করেন ১৯২১ সালের ১৮ জুন। তবে অজানা অভিমানে বিয়ের রাতেই কবি সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ২৩ এপ্রিল কবি কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তকে বিয়ে করেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও ব্রিটিশদের সমালোচনার দায়ে কুমিল্লা শহরের ঝাউতলা রাস্তায় নজরুলকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৩ সালে কলকাতা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নজরুল আবার কুমিল্লায় আসেন। কুমিল্লার বিভিন্ন স্থান জাতীয় কবির স্মৃতি বহন করে পরম অহংকারে। এসব স্থানের অন্যতম কুমিল্লা শহরের দারোগাবাড়ী মাজার ও নানুয়ার দীঘির পাড়ের মজুমদারের বাড়ি। প্রায় ১০০ বছর পর সেই দারোগাবাড়ির মাজার ও নানুয়ার দীঘির পাড় স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সংবাদ শিরোনাম হলো। তবে কুমিল্লায় অসাম্প্রদায়িক নজরুলের আগমনের শতবর্ষ পালনের জন্য নয়, বরং কোরআন অবমাননা তথা সাম্প্রদায়িকতার বিষবীজ বপনের জন্য। আজ দেশবাসী জানে বিগত দুর্গাপূজা চলাকালে জনৈক ইকবাল হোসেন দারোগাবাড়ী মাজার ও মসজিদ কমপ্লেক্স থেকে কোরআন শরিফ সংগ্রহ করে নানুয়ার দীঘির পাড়ে স্থাপিত অস্থায়ী দুর্গাপূজা মণ্ডপে একটি মূর্তির পায়ের কাছে রেখে আসেন। এর ফলে দ্রুতই সারা দেশে মুসলমানের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ ঘটে এবং লুটতরাজ ও ভাঙচুর শুরু হয়। প্রশ্ন উঠেছে- কেরআন অবমাননার কারণে এ বিক্ষোভ না বিক্ষোভ ঘটানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে কোরআন অবমাননা? ইতিমধ্যে গ্রেফতার ইকবাল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন তিনি পাগল, নেশাখোর ইত্যাদি। অনেকের প্রশ্ন, পাগল পৃথিবীর এত বইপুস্তক ফেলে একখণ্ড কোরআন কেন রাখতে গেলেন মূর্তির পায়ে? এ প্রশ্নের উত্তর কোনো দিন মিলবে কি না জানা নেই। তবে নজরুল এ প্রশ্নের উত্তর লিখে গেছেন তাঁর প্রিয় মানুষকে উৎসর্গ করা ‘সঞ্চিতা’ কাব্য সংকলনে। তাঁর প্রিয় এই মানুষটি ছিলেন হিন্দু। নজরুল সঞ্চিতার উৎসর্গ পত্রে তাঁর প্রিয় কবিগুরুর প্রতি সম্মান জানিয়ে লিখেন, ‘বিশ্বকবি সম্রাট শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রীশ্রী চরণা রবিন্দেষু।’ সঞ্চিতা কাব্যগ্রন্থের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় নজরুল লিখেছেন :

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।’

এই রেশ ধরে বলব কুমিল্লায় মানুষ ডুবছে। কেউ নেশায়, কেউ ধর্মান্ধতায়, কেউ লোভে, কেউ ক্ষমতার বাসনায়। তারা শুধু নিজেরাই ডুবছে না, ডোবাচ্ছে সমগ্র কুমিল্লাবাসীকে। যে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি পল্লীর মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের পথপ্রদর্শক, সেই একাডেমিতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার গোপন বৈঠকের তথ্য রয়েছে ইতিহাসের পাতায়। কুমিল্লায় জন্ম নেওয়া দুই খন্দকার (খন্দকার মোশতাক আহমদ ও কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ) বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কুমিল্লাবাসীর হাজার বছরের অহংকার ও সারল্যকে খন্দকে পুঁতে গেছেন। আজ ‘কু’ দিয়ে ভালো কিছু হয় না বলে অপবাদ শুনতে হয়। তাই কুমিল্লা নামে বিভাগ সৃষ্টিতেও আপত্তি উঠেছে। তবে কুমিল্লাবাসীকে হতাশার বদলে আশায় বুক বাঁধতে হবে। আজকের তরুণদের মাদক, সন্ত্রাস, অর্থলোভ আর যেনতেনভাবে ক্ষমতা দখল ও ভোগের রাজনীতি থেকে ফেরাতে পারলে আবারও জেগে উঠবে পথিকৃৎ কুমিল্লা। নজরুল এ তরুণদের উদ্দেশেই তো তাঁর ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’ কবিতায় লিখে গেছেন, ‘যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির চূড়া,

সেই লাঠি কালই প্রভাতে করিবে শত্রুদুর্গ গুঁড়া।

প্রভাতে হবে না ভায়ে ভায়ে রণ,

চিনিবে শত্রু চিনিবে স্বজন।’

লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর