শনিবার, ২ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

শব্দদূষণ : উৎস ও ফলাফল

ড. দিলীপ কুমার সাহা

শব্দদূষণ : উৎস ও ফলাফল

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘Only One Earth’ (কেবল একটিই পৃথিবী) প্রকৃতির সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে টেকসই জীবনযাপন করাই এর মূল উদ্দেশ্য। পরিবেশ দূষণ প্রধানত চার প্রকার- বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ ও শব্দদূষণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে যানবাহন, কলকারখানা, মানুষের শৌখিনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সঙ্গে বাড়ছে পরিবেশ দূষণের আর একটি মূল নিয়ামক শব্দদূষণ। শব্দের তীক্ষèতার ওপর নির্ভর করে শব্দদূষণ নির্ণয় করা হয়। শব্দ মাপের একক ডেসিবেল। শব্দের মাত্রা ৭৫ ডেসিবেল অতিক্রম করলেই সেটা দূষণের পর্যায়ে পড়ে।  যান্ত্রিক সভ্যতার অপব্যবহারের বিষপাষ্পে ও নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার কারণে শহরের দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে জনসংখ্যার মাইগ্রেশন হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে তাদের প্রয়োজনেই বাড়ছে যানবাহন। এ কারণে প্রতিদিন সড়ক-মহাসড়কে ঢুকছে অসংখ্য নতুন নতুন যানবাহন। ফলে যানবাহনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে হর্নের মাত্রাও, যা শব্দদূষণের প্রধান কারণ।

হর্নের উচ্চমাত্রার শব্দে পথচলা দায়। এ ছাড়া আছে হাইড্রোলিক হর্ন। আজকাল ট্রফিক সিগন্যালে কিছু অ্যাম্বুলেন্স, বিশেষ কিছু গাড়ির উচ্চশব্দের হর্ন কিংবা সাইরেনের শব্দে আকাশ-বাতাস কম্পিত হয়। তার ওপর নতুন আরেক ধরনের ফ্যাশন শুরু হয়েছে, হাজার হাজার বাইকের ট্রাফিক সিগন্যালে থাকাকালীন ও সিগন্যাল-পরবর্তী উচ্চশব্দে হর্ন বাজানো, এ ছাড়া কিছু যান্ত্রিক রিকশা অনবরত উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে চলায় শব্দদূষণ বাড়ছে। জেলা ও বিভাগীয় শহরসহ রাজধানী ঢাকায় সাধারণভাবে যানবাহন ও হর্নের শব্দই শব্দদূষণের মূল কারণ; যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উচ্চশব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার, এ ছাড়া বাজি ও পটকার আকস্মিক উচ্চশব্দ; লঞ্চ, জাহাজ, ট্রেন ও বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ শব্দও শব্দদূষণের কারণ। ইনডোর শব্দদূষণের ক্ষেত্রে টাইলস লাগানো ও যান্ত্রিকভাবে টাইলস কাটা, মিউজিক সিস্টেমে উচ্চশব্দে গান বাজানো, ড্রিলিংয়ের কাজসহ ইনটেরিয়র ডেকোরেশনের কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে। খুব দুঃখজনক এই যে, কিছু জনপ্রতিনিধিও প্রচারণার কাজে অনেক সময়ই শব্দদূষণের মাত্রা অতিক্রম করেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ -এর ক্ষমতাবলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। পরিবেশ আইনজীবীদের মতে, বাংলাদেশে যে পরিবেশ আদালত রয়েছে তাতে আছে তিন ধরনের আদালত, যার একটি হচ্ছে মোবাইল কোর্ট। শুধু এ কোর্টের মাধ্যমেই একটু কিছু করার সুযোগ থাকলেও বাকি দুটো আদালতে শব্দদূষণের অভিযোগে মামলার নজির কম। 

শব্দদূষণের ক্ষেত্রে কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। কয়েকদিন আগে পুরান ঢাকায় এক ট্যাক্সি ডাইভার তার সামনে থাকা ধীরগতির রিকশাচালককে অনবরত  উচ্চেঃস্বরে হর্ন দিয়ে যাচ্ছিলেন। পাশে যখন এক পথচারী ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এত জোরে হর্ন বাজাচ্ছ কেন?’ ড্রাইভারের উত্তর হলো, ‘আমার প্রয়োজন হয়েছে তাই বাজাচ্ছি’। কিছুদিন আগে সহকর্মীসহ আমরা একটি ট্রেনিং প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে তুরস্ক যাওয়ার সুযোগ পাই। তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে আঙ্কারা, আঙ্কারা থেকে ক্যাপাডোকিয়া, ক্যাপাডোকিয়া থেকে বুশরা। সেখান থেকে পরবর্তীতে বাসযোগেই আবার ইস্তাম্বুলে ফেরত আসি। এতে কমবেশি ১৪০০-১৫০০ কিলোমিটার বাস ভ্রমণ করি। আমাদের এ পথ চলাকালে ড্রাইভারকে একবারের জন্যও হর্ন বাজাতে দেখিনি। ইস্তাম্বুলে এসে খাবারের এক ফাঁকে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কি একবারের জন্যও হর্ন বাজানো প্রয়োজন পড়েনি? দোভাষীর মাধ্যমে জানলাম সে বলল, ও-দেশে অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজানো দন্ডনীয় অপরাধ, প্রয়োজন ছাড়া কেউ হর্ন বাজায় না।

বাংলাদেশ পুলিশের জরুরি সেবা ৯৯৯-এ টেলিফোন করে শব্দদূষণের ভুক্তভোগীরা শব্দদূষণ থেকে অনেক ক্ষেত্রে রেহাই পেয়েছেন। উপরন্তু শব্দদূষণ সৃষ্টির ডিভাইসগুলো জব্দ করা হয়েছে, এ ধরনেরও অনেক উদাহরণ আছে। এ ছাড়া ২০১৮ ও ২০১৯ সালে সরকারের পরিবেশ অধিদফতর শব্দদূষণ প্রতিরোধে অনেক জনসচেতনতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ অনুযায়ী, নীরব এলাকা, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা ও মিশ্র এলাকা- এ পাঁচটি জোনে দিন ও রাতে আলাদা করে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নীরব এলাকার জন্য দিনের বেলা ৫০ এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল মাত্রা দেওয়া হয়েছে। শিল্প এলাকায় সর্বোচ্চ ৭০ এবং রাতে ৭৫ ডেসিবেল মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের কোথাও এ মাত্রা মেনে চলা হয় না। কয়েক বছর আগে পরিবেশ অধিদফতরের এক জরিপে দেখা যায়, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে গেছে; যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে আড়াই থেকে তিন গুণ বেশি।

শব্দদূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। পরিবেশ অধিদফতরের এক জরিপে উঠে এসেছে, মাত্রাতিরিক্ত শব্দের কারণে ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দেশে ২০ শতাংশ মানুষ বধিরতায় আক্রান্ত। এর প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু। আর যারা ট্রাফিক পুলিশ, তাদের ১১ শতাংশের শ্রবণ সমস্যা আছে। অন্য এক রিপোর্টে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের ৬১ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের জন্য হতাশা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য, আচার-আচরণ উভয় ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি হয়। অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত শব্দের কারণে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাভাবিক কার্যকলাপ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শব্দদূষণের কারণে দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, টিন্নিটাস, শ্রবণশক্তি হ্রাস (এমনকি বধিরও হতে পারে), ঘুমের ব্যাঘাতসহ অন্যান্য ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রভাব পড়ছে। অন্যান্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ ইত্যাদিও হতে পারে।

বর্তমানে পরিবেশ দূষণের অন্যতম নিয়ামক শব্দদূষণ একটি সামাজিক সমস্যা। এ ধরনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে যুগোপযোগী কঠোর আইন জরুরি। এ ব্যাপারে সব সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। বাড়াতে হবে জনসচেতনতা। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানে ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রচেষ্টাই পারে শব্দদূষণকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে নিয়ে যেতে।

লেখক : প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর