অবশেষে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটল। গত ৫ আগস্ট সোমবার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যান। এরকম একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি শেখ হাসিনার ভাগ্যে আছে এক মাস আগে হয়তো কেউ কল্পনাও করেনি। কিন্তু রাজনীতি এমনই। গত সংখ্যায় আমি লিখেছিলাম, ‘রাজনীতিতে ক্ষমতা আর ঘৃণা পাশাপাশি চলে। এই দেশ জোয়ার-ভাটার দেশ এই দেশের মানুষ প্রচন্ড আবেগপ্রবণ।’ এ কথাগুলো মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে বাস্তবতার ভিত্তি পাবে তা আমিও ভাবতে পারিনি। এক মাস আগে কে ভেবেছিল শেখ হাসিনা সরকারের এমন করুণ পতন হবে। এভাবে তাঁকে একটি অপমানজনক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বিদায় নিতে হবে?
এই প্রস্থান রাজনীতির জন্য একটি শিক্ষা। টানা সাড়ে ১৫ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ চালিয়েছেন ২০ বছরের বেশি সময়। ৪৩ বছরের বেশি সময় আওয়ামী লীগের সভাপতিত্ব করেন। তাঁর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কি একটিবারের জন্যও ভেবেছেন, তাঁর এরকম পরিণতি হবে? সম্ভবত না। রাজনীতি বোধহয় এমনই। রাজনীতির কিছু হিসাবনিকাশ অঙ্কের চেয়েও জটিল। কিন্তু আমরা যদি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করি তা হলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারব পতন কেন শেখ হাসিনার হলো?
শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার এক নবযাত্রার সূচনা হয়েছিল। ইতিহাস নিশ্চয়ই তাঁকে মনে রাখবে। তাঁর হাত ধরে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, নানা উন্নয়ন স্থাপনাগুলো বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে কিছু ব্যাধি তাঁকে প্রচন্ডভাবে পেয়ে বসেছিল। তার মাশুল দিতে হলো শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী লীগকে। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। এই সরকার গঠনের পর আন্তর্জাতিক মহল থেকে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সরকার টিকে গেল এরকম একটি আত্মতুষ্টি এবং অহংকার পেয়ে বসে আওয়ামী লীগের সবাইকে। আর এই আত্মতুষ্টি এবং অতি অহংকারই আওয়ামী লীগের পতনের পথ। আমরা যদি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করি কেন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটল? কেন শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে তছনছ হয়ে গেল শেখ হাসিনার ক্ষমতার দুর্গ তাহলে বেশ কয়েকটি কারণকে সামনে আনতে পারি। তবে আমার বিবেচনায় সবচেয়ে বড় কারণ - জনবিচ্ছিন্নতা। আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। জনপ্রিয়তা নেমে গিয়েছিল শূন্যের কোঠায়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় পেয়েছিল। এই নির্বাচনে ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এরপর দেশ পরিচালানায় তিনি ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। মহাজোটের সব দলকে নিয়ে তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে সরকার পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর যে আন্দোলন শুরু হয় সেই আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপে ফেলেছিল তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই চাপ শেখ হাসিনা উতরে গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করেনি। ১৫০টিরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ভোট ছাড়া এমপি হওয়ার পর সবাই আশা করেছিল দ্রুত আরেকটি নির্বাচন হবে, একটি জাতীয় সংলাপের পথ উন্মুক্ত হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে পথে হাঁটেনি। তারপরও দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে মেনে নিয়েছিল মন্দের ভালো হিসেবে। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে যখন বিরোধী দলগুলো কোনো রকম শর্ত ছাড়াই অংশগ্রহণ করতে রাজি হয় তখন গণতন্ত্রকে একটি সঠিক রাস্তায় নিয়ে আসার ঐতিহাসিক সুযোগ পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। সেই সুযোগ তিনি কাজে লাগাননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে কোনো ভোট হয়নি। রাতের ভোটে গণতন্ত্রকে লজ্জিত করা হয়। সেই লজ্জার ভার বহন করতে হয়েছিল গোটা জাতিকে। ২০১৮ সালের নির্বাচন যদি ন্যূনতম অবাধ সুষ্ঠু হতো না। তাহলে আজকে এই পরিণতি হতো। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের মাধ্যমে যে কলঙ্ক রোপিত হয়েছিল তারপরও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল আরও পাঁচ বছর। ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রায় দুই বছর আগে থেকেই বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনের দাবি ছিল একটি অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু আওয়ামী লীগ অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের ধারে কাছে যায়নি। বরং বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ক্ষমতায় থাকার কৌশল অবলম্বন করেছিল। সেই কৌশলে কিছু সময়ের জন্য জয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু কূটকৌশল করে জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে হয়তো কিছুদিন ক্ষমতায় থাকা যায়। চিরকাল না। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ভোট আতঙ্কে ভুগতে থাকে। ভোটার ছাড়া পুলিশ-প্রশাসন দিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার এক ব্যাধি আওয়ামী লীগকে ভয়ংকরভাবে পেয়ে বসে। এটিই আসলে সংকটের উৎসস্থল। এই ভোটারবিহীন এমপিরা, জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন। এই তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরাই আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করেছে। এরা জনবিচ্ছিন্ন। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন থেকে তারা লুটপাটে মত্ত হয়েছিলেন। তারা নিজেদের আখের গোছানোর কাজেই ছিলেন গভীর মনোযোগী। যে কারণে জনগণ যে ক্রমশ তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল, সেটি তারা বুঝতেই পারেনি।
দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় লুণ্ঠনের রাজত্ব। একদিকে যেমন উন্নতি হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় লুণ্ঠন। রীতিমতো উৎসব হয় দুর্নীতির। যে যেভাবে পেরেছে দুর্নীতি করেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তার পিয়নও ৪০০ কোটি টাকার মালিক। জনগণ প্রশ্ন করেছে, দুর্নীতি করে পিয়ন যদি ৪০০ কোটি টাকার মালিক তাহলে বড় ‘কর্তা’ কত টাকার মালিক? আমলা আছে, পুলিশ আছে ক্ষমতা আমাদের - এই সহজ ফর্মুলা দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছিল। কিন্তু এভাবে যে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না ৫ আগস্ট তার প্রমাণ।
জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্যই আওয়ামী লীগ জনগণের কণ্ঠস্বর শুনতে পারত না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত না। দুর্নীতিবাজদের উৎসব আওয়ামী লীগ উপভোগ করেছে, ব্যবস্থা নেয়নি। বেনজীর-মতিউর কিংবা এরকম নাম না জানা এরকম অনেক দুর্নীতিবাজের ফিরিস্তি দেখে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সরকার ছিল প্রতিকারহীন। দুর্নীতি যেমন বেড়েছিল তেমনি বেড়েছিল অর্থ পাচার, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংখ্যা। ব্যাংকগুলো ফোকলা হয়ে গেছে। আর্থিক খাতে নেমে এসেছে এক ভয়ংকর নৈরাজ্য।
আওয়ামী লীগের হাত ধরেই অর্থনীতি একটা সম্মানজনক স্থানে এসেছিল, সেই আওয়ামী লীগের হাত ধরেই অর্থনীতির ধ্বংস যজ্ঞ শুরু হয়। লুটপাটের কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি চলে যায় সীমাহীন পর্যায়ে। কয়েকজন মন্ত্রী-এমপির লুণ্ঠনের ফিরিস্তি রূপকথাকেও হার মানিয়েছিল। অথচ এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসার পর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিলেন। আসলে গত ১৫ বছর তিনি একাই দেশ চালিয়েছেন। কোনো মন্ত্রী বা কোনো এমপির দায়িত্ব ছিল না। সব সিদ্ধান্তের জন্য তারা তাকিয়ে থাকতেন প্রধানমন্ত্রীর দিকে। শেখ হাসিনা কী করবে সেটার অপেক্ষায় থাকতেন সারাক্ষণ। এরকম একটি সার্কাসের শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল গত প্রায় দেড় দশক ধরে। সবকিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু লুণ্ঠন-বাণিজ্যে মনোযোগী ছিলেন মন্ত্রীরা। আর এ সময় শেখ হাসিনা কঠোর হতে পারেননি। তিনি মন্ত্রীদের দায়িত্ব দিতে পারেননি। বরং তিনি চাটুকার, মোসাহেব এবং স্তাবকদের চারপাশে রেখেছিলেন। এরা চারপাশ থেকে শেখ হাসিনাকে বিভ্রান্ত করেছে, জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। প্রকৃত বাস্তবতা উপলব্ধি করতে দেয়নি। এদের কারণেই শেখ হাসিনার পতন। এই সমস্ত চাটুকার এবং স্তাবকরা শুধু শেখ হাসিনাকে জনবিচ্ছিন্ন করেনি, আওয়ামী লীগ সংগঠনকেও ভেঙে চুরমার করেছে। বাস্তবে আওয়ামী লীগ বলে এখন কোনো সংগঠন নেই।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় আমলা এবং পুলিশের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি সংগঠনকে শক্তিশালী বা গতিশীল করার দিকে একদম মনোযোগ দেননি। আওয়ামী লীগের অথর্ব, অযোগ্য সাধারণ সম্পাদক হিসেবে টানা তিনবার দায়িত্ব পালনের রেকর্ড করেছে ওবায়দুল কাদের। তার কথা জনবিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি কথা বললে মানুষ বিরক্ত হতো। শেষ পর্যন্ত এটি মানুষের জন্য ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তারপরও আওয়ামী লীগ সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের পরিবর্তন করেননি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে শেখ হাসিনা পরিবর্তন বিরোধী হয়ে ওঠেন। চতুর্থ মেয়াদে তিনি এমন সব আনকোরা-হাইব্রিডদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন যারা ক্রমশ গণশত্রুতে পরিণত হয়েছিল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন একটি নমুনা মাত্র। যে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া থেকে বোঝা যায় সরকার কীভাবে চলত। কোটা সংস্কার নিয়ে যখন প্রথম আন্দোলন শুরু হয় ২০১৮ সালে তখন শেখ হাসিনা এক পরিপত্রের মাধ্যমে কোটা বাতিল করেন। তারপর আওয়ামী লীগের লোকজনই কোটা বাতিলের বিরুদ্ধে রিট আবেদন করেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা রিট আবেদনটি ছিল আওয়ামী লীগেরই সৃষ্ট একটি নতুন সমস্যা। আওয়ামী লীগ যে কূটকৌশলের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার অভ্যাস রপ্ত করেছিল ঠিক একই কূটকৌশল করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল করতে চেয়েছিল। এটির কোনো দরকার ছিল না। হাই কোর্টে যখন রিট পিটিশনটি দাখিল করা হয় তখন সরকারের পক্ষ থেকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেওয়া হয়েছিল। হাই কোর্ট কোটা সংক্রান্ত পরিপত্রটি বাতিল করে এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দেয়। শিক্ষার্থীরা এত বোকা নয়। তারা বুঝে ফেলে এটা সরকারের চাল। সরকার কোটা পরিপত্র জারি করেছিল তাদের সামলানোর জন্য। আবার সরকারই হাই কোর্টে মামলা করিয়ে এই পরিপত্রটি বাতিল করেছে। এতেই বিশ্বাসের জায়গাটি ভেঙে যায়। যেভাবে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে ঠিক একই ঘটনা ঘটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। এরপর সরকার ধাপে ধাপে ভুল করেছে এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পুঞ্জীভূত হয়েছে। এ যেন এক ‘টম অ্যান্ড জেরি’ খেলা। যখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে তখন সরকার তাদের অবজ্ঞা করেছে। সরকার তাদের সঙ্গে বসার প্রয়োজনটুকুও অনুভব করেনি। আর এই পরিস্থিতিতে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এক সময় আপিল বিভাগে বিষয়টি যায় এবং সরকারের তৎপরতাই প্রমাণ করে দেয় যে, নেপথ্যের কলকাঠি আসলে সরকারের হাতেই ছিল। কারণ আপিল বিভাগে রায় স্থগিত না করা, তারপর মামলার শুনানির দিন এগিয়ে নিয়ে আসা এবং পরবর্তীতে দ্রুত শুনানি করে কোটার ব্যাপারে একটি নীতিনির্ধারণী নির্দেশনা দেওয়াটাকে শিক্ষার্থীরা মনে করেছে একটি সাজানো নাটক। এ কারণেই তারা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। সেই ক্ষুব্ধতাই গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়।
আমরা দেখেছি, গত ১৫ বছরে একটি চাটুকার শ্রেণি গড়ে উঠেছে সব জায়গায়। সর্বক্ষেত্রে গড়ে উঠেছিল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের বাইরে কেউই শেখ হাসিনার দরজা পর্যন্ত যেতে পারেনি। তাঁর কাছে পৌঁছানোর দরজা যেন সবার জন্য বন্ধ ছিল। সেরকমই একজন চাটুকার সিন্ডিকেটের সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অনভিপ্রেত এক প্রশ্ন করে বিতর্ক উসকে দেন। আর এখান থেকেই বিস্ফোরণ। এ সময় আওয়ামী লীগের কান্ডজ্ঞানহীন সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করলেন, শিক্ষার্থীদের দমন করার জন্য নাকি ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তিনি জনবিচ্ছিন্ন, ধানমন্ডি-৩ নম্বর, ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এবং তাঁর নিজস্ব মন্ত্রণালয়ের অফিস ছাড়া জনগণের সম্পর্কহীন। যেখানেই তিনি যান চাটুকাররা তাকে ঘিরে রাখে। চাটুকাররা তাকে ‘সাধু সাধু’ বলে। আর তিনি মনে করেন তিনি বোধহয় এ কালের নতুন জমিদার। আর সেই কারণেই বাস্তবতা বিবর্জিত বক্তব্য দিয়ে আন্দোলনে ঘি ঢাললেন। আন্দোলন বিস্ফোরিত হলো। তারপরও একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই সময় অনেকে অনুরোধ করেছিল যে মন্ত্রিসভার রদবদল দরকার। ৫-৬ জন অযোগ্য, অথর্ব, দুর্নীতিবাজ, দায়িত্ব জ্ঞানহীন মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীর মতো দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য, চাটুকাররা শেখ হাসিনাকে ঘিরে রেখেছে। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলন চলে গেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। জনগণ আগে থেকেই ক্ষুব্ধ ছিল। সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থ পাচার মানুষের জীবনে এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা লোকজন বুঝতেই পারেনি জনগণ কী ভাবছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখে নিরীহ মানুষ উৎসাহিত হয়েছে। তারা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। এক সময় তারা এক দফা ঘোষণা করেছে এবং শেখ হাসিনার অপমানজনক প্রস্থান হয়েছে। শেখ হাসিনার এই দুর্ভাগ্যজনক বিদায় কেউ হয়তো চায়নি। কিন্তু রাজনীতিতে এটি হলো নির্মম বাস্তবতা। একজন শাসককে কীভাবে দুর্নীতিবাজ, চাটুকাররা জনবিচ্ছিন্ন করে তার উদহারণ শেখ হাসিনা। এর ফলে জনবিচ্ছিন্ন শাসকের কি পরিণতি হয় তার উদহারণ ৫ আগস্ট। আমরা জানি, যে আওয়ামী লীগ ফিনিক্স পাখির মতো একটি রাজনৈতিক দল। এর চেয়েও বড় দুর্যোগ আওয়ামী লীগ সামাল দিয়েছে। আওয়ামী লীগে রয়েছে অনেক ত্যাগী, পরীক্ষিত সাহসী মানুষ। যারা দুঃসময়ে দাঁড়াবেন। আবার দুঃসময় এসেছে। এ মানুষগুলো হয়তো আবার সামনে এসে দাঁড়াবেন। সুসময়ের চাটুকাররা এখন পালিয়ে যাবে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল : [email protected]