বাঁশি নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনার ক্ষেত্রে আগে হালকা-পাতলা কিছু কথা বলে নিই। এই বাংলায় বাঁশির সুরে সর্প নাচে-আবার সেই বাঁশি প্রেমিকের ঠোঁটের স্পর্শে যখন সুর তোলে তখন প্রেমিকার মনে যে সুনামি শুরু হয় তা অমর শিল্পী আবদুল আলীমের কালজয়ী কণ্ঠে ‘অসময়ে বাঁশি বাজায় কেরে- পরান আমার বাইরাম বাইরাম করে’ সুরের মাধ্যমে আমরা আন্দাজ করতে পারি। একইভাবে শচীন দেব বর্মণের সেই গান ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি’ কিংবা লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ‘বাঁশি কেনো গায় আমারে কাঁদায় কে গেছে হারায়ে- স্মরণের ও বেদনায় কেনো মনে এনে দেয়’ কথামালার মাধ্যমে মানব মনের যে আকুতি ফুটে ওঠে তা রাজনীতির অঙ্গনে কীভাবে ঝড় তোলে সে কথা বলার জন্যই আজ হাজির হয়েছি। আমাদের শৈশবে বাঁশির ফুরুৎ ফুরুৎ শব্দে লেফট রাইট করার স্মৃতির সঙ্গে সামরিক ট্রেনিংয়ে লেফট রাইট ও বাঁশির আওয়াজের গুরুত্ব আমার চেয়ে সেনাকর্তারা ভালো বলতে পারবেন। তবে পুলিশের মুখে বাঁশির শব্দ যে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মনে কী প্রলয় তৈরি করে তা ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের সৈনিকরা যেভাবে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন ঠিক একইভাবে গণ অভ্যুত্থানের ফলে যারা জাতির নতুন কান্ডারি রূপে বঙ্গভবনের রাজকীয় অনুষ্ঠানে ছিলেন তাদের জন্য বাংলার রাজপ্রাসাদের সানাই-নহবত বেজেছে কি না বলতে পারব না- তবে আদিকালে বাঁশিরূপী সানাই-নহবতের সুর ছাড়া রাজার অভিষেক হতো না। রাজার আগমন-বহির্গমন, রাজকীয় মেহমানকে বরণ করে নেওয়া, রাজকীয় আনন্দ ও রাজকীয় দুঃখ প্রকাশ করা হতো সানাই এবং নহবতের সুর দ্বারা।
রাজাকে খুশি করার জন্য যেভাবে বাঁশিতে সুর তোলা হতো তদ্রুপ কোনো কোনো রাজা নিজের আকুতি ইচ্ছা-অনুভূতি-সিদ্ধান্ত ইত্যাদি জানান দেওয়ার জন্য বাঁশি বাজাতেন। রাজকীয় সেসব বাঁশির সুরের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাতি অর্জনকারী সুরটি তৈরি করেছিলেন রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস নিরো। রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। রাজার স্বেচ্ছাচার-দায়িত্বহীনতা-কান্ডজ্ঞানহীনতা বোঝানোর জন্য সারা দুনিয়ায় গত প্রায় ২ হাজার বছর ধরে নিরোর বাঁশি বাজানোকে কেন্দ্র করে যত গল্প-কবিতা-উপন্যাস রচিত হয়েছে তা অন্য কোনো প্রেক্ষাপট নিয়ে হয়নি।
বাংলাদেশের চলমান বিশৃঙ্খলা-অনিয়ম-সন্ত্রাস যা কি না পুরো দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে তার নেপথ্যে কে বা কারা বাঁশি বাজাচ্ছে তা নিয়ে আলোচনার আগে বিখ্যাত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা- গল্পটি আপনাদের সামনে নতুন করে তুলে ধরতে চাই। শৈশবে পড়া সেই গল্পটির পেছনে কত যে ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে তা যদি বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে একটু মিলিয়ে নেন তবে অনেকের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাবে। পুরস্কারের লোভে জনৈক বংশীবাদক হ্যামিলন শহরের মেয়রের কাছে প্রস্তাব দেন যে বাঁশি বাজিয়ে তিনি পুরো শহরের ইঁদুরগুলোকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। শহরের মেয়রের প্রতিশ্রুতি পেয়ে বংশীবাদক বাঁশিতে সুর তুললেন। গর্ত থেকে একে একে সব ইঁদুর বের হয়ে এলো, তারপর বাদক ইঁদুরের দল নিয়ে নদীর কিনারে গেলেন। বাঁশির সুরে ইঁদুরেরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করল। শহর ইঁদুরমুক্ত হওয়ার পর বংশীবাদক পুরস্কার চাইলেন- কিন্তু মেয়র মোনাফেকি করার কারণে তার ভিতর প্রতিশোধ স্পৃহা জাগ্রত হলো।
দ্বিতীয় পর্বে এসে বংশীবাদক তার বাঁশিতে ভিন্ন একটি সুর তুললেন। সেই সুরে মুগ্ধ হয়ে শহরের সব শিশু বংশীবাদকের পেছনে ছুটল। শহরের সবাই দেখলেন- কিন্তু কেউ কিছুই করতে পারলেন না। কারণ তারাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাঁশির সুরে বিমোহিত হয়ে চিন্তাশক্তি হারিয়ে তামাশা দেখতে আরম্ভ করলেন এবং শহরবাসীর মধ্যে তাদের নেতা মেয়র সাহেবও ছিলেন। বংশীবাদক শিশুদের নিয়ে হ্যামিলন শহরের সীমানা পেরিয়ে একটি পাহাড়ের দিকে গেলেন। বাঁশির সুরে পাহাড় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বংশীবাদকের জন্য নতুন গিরিপথ বা রাস্তা তৈরি করে দিল। তিনি শিশুদের নিয়ে সেখানে ঢুকলেন- পাহাড়ের তৈরি গিরিপথটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। পরবর্তীতে শহরবাসী তাদের সন্তানদের খোঁজ পেল না। ফলে হ্যামিলন শহরের একটি প্রজন্ম চিতররে হারিয়ে গেল।
উল্লিখিত গল্পের সময়কাল হিসেবে ১২৮৪ সালের ২২ জুলাইকে বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে গল্পটি কেবল নিছক-গল্প হিসেবে পরবর্তীকালে বিবেচিত হয়নি। কারণ জার্মানিতে হ্যামিলন নামে একটি শহর রয়েছে এবং ১২৮৪ সালেও সেখানে পৌরসভা ছিল এবং সেই জমানার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র এখনো সংরক্ষণ করা আছে। ফলে ইতিহাসের পথপরিক্রমায় বহু গবেষক, ইতিহাসবিদ, দার্শনিক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা গল্পের মধ্যে সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন এবং গল্পের পেছনের অনেক গল্প খুঁজে বের করেছেন যা কি না সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। গল্পটির সঙ্গে ইতিহাসের বাস্তবতা ও যেসব সত্য কাহিনির মিল রয়েছে তা বর্ণনার পাশাপাশি এই গল্পের অন্তর্নিহিত বক্তব্য পেশ করলেই ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্ট মাসের অনেক ঘটনার সঙ্গে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা গল্পের মিল খুঁজে পাবেন। জার্মানির হ্যানোভার শহরের ৩৩ মাইল দক্ষিণের একটি শহরের নাম হ্যামিলন। একাদশ শতাব্দীতে শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয় যখন ইউরোপজুড়ে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের উন্মাদনা চলছিল।
পবিত্র জেরুজালেম নগরে খ্রিস্টান রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপের খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপ যে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন তা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুরের মতো উঠতি বয়সি কিশোর-কিশোরীদের পাগল বানিয়ে ফেলেছিল। ঠিক এই সময়ে হ্যামিলন শহরে অর্থাৎ ১২১২ সালে নিকোলাস নামক এক যুবকের অভ্যুদয় হয়। যে নানা গল্প বলে শহরের কিশোর-যুবকদের জেরুজালেমের যাত্রী বানিয়ে ফেলে, যারা কেউ পরবর্তীতে ফিরে আসেনি।
হ্যামিলনে একটি জাদুঘর রয়েছে। সেখানে রক্ষিত পঞ্চদশ শতাব্দীর লেখা কয়েকটি বইয়ে জাদুকর বাঁশিওয়ালার কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। ফ্রাউ ডন নামক ১৩ বছর বয়সি এক কিশোরের বক্তব্য মতে, বাঁশিওয়ালার বয়স ছিল ৩০ বছর। তিনি খুবই সুদর্শন ছিলেন এবং তার বাঁশিটি ছিল রুপা দিয়ে তৈরি। হ্যামিলনের মতো জার্মানির একটি শহরে ১২৩৭ সালে ১ হাজারেরও বেশি ছেলেমেয়ে হঠাৎ দলবদ্ধ হয়ে শহর থেকে বের হয়ে যায় এবং তারা নাচতে নাচতে পৌঁছায় আর্নস্টার্ড নামের এক জায়গায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন তাদের পাওয়া গেল তখন দেখা গেল বেশির ভাগ শিশু অসুস্থ, বেশির ভাগ মানসিক ভারসাম্যহীন এবং ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে তারা মূর্ছা যেত। প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল জার্মানির সোয়াডিয়া অঞ্চলের হাল নামক শহরে ১৪৫৮ সালে। শহরের হাজার হাজার কিশোরের মধ্যে হঠাৎ উন্মাদনা শুরু হয়। শহর ছেড়ে ফ্রান্সের মিশেল নামক একটি তীর্থস্থানে হিজরত করে বেহেশত লাভের বাসনা তাদের এতটাই পাগল বানিয়ে ফেলে যে, তাদের পিতামাতার পক্ষে সেই পাগলামো বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। এতক্ষণ ধরে শিরোনাম প্রসঙ্গে যে আলোচনা করলাম তার সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশের কী সম্পর্ক তা বলার আগে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা গল্পের মর্মকথা বলে নিই। মধ্যযুগে ইঁদুরের যন্ত্রণা এবং ইঁদুর দ্বারা সৃষ্ট ভয়াবহ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষ অনেক ভ- পীর ফকিরের আশ্রয় নিত। আমাদের দেশের সাপের কামড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাবিজ মন্ত্র কিংবা সাপ নাচানোর বীণ বা বাঁশি অথবা সাপের বিষ নামানোর মন্ত্রের মতো মধ্যযুগের ইউরোপে অনেক কুসংস্কার চালু ছিল, কোনো সমস্যা সমাধানের বাস্তব বুদ্ধি যখন থাকে না-কিংবা মানুষ যখন পরিবেশ পরিস্থিতির কাছে অসহায় হয়ে পড়ে তখন সাধারণ মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে ফায়দা হাসিলের জন্য হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো বহু পীর-ফকির ওঝা বৈদ্য যুগে যুগে পৃথিবীর শহর বন্দর জনপদে এসেছে এবং মানুষের সর্বনাশ ঘটিয়ে কীভাবে গা-ঢাকা দিয়েছে সে কথা বলে- উপসংহারে চলে যাব।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা গল্পের দ্বিতীয় অংশের মর্মকথা হলো- ইঁদুর নিধনের কথা বলে বাঁশির সুর তুলে বাঁশিওয়ালা যে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেছিল সেখানে ব্যর্থ হয়ে পুরো শহরের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করার জন্য বাঁশিওয়ালা তার বাঁশিতে নতুন সুর তোলেন। তারপর সেই সুরে মহাবিষ্ট করে পুরো একটি প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেন।
আমাদের দেশের রাজনীতির হালহকিকত যদি পর্যবেক্ষণ করেন তবে ১৯৮২ সাল থেকে এরশাদ জমানা-পরবর্তীতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ জমানা এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে আপনি দেখতে পাবেন যে, ধুরন্ধর রাজনীতিবিদরা তরুণদের ব্যবহার করেছে এবং অনেক সম্ভাবনাময় তারুণ্যকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। ফলে সেই আশির দশক থেকে- দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ুয়া মেধাবীদের অধঃপতন দেখে তাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে যে হতাশা এবং আর্তচিৎকারের ধ্বনি যুগের পর যুগ ধরে ক্রমশ যেভাবে গগণবিদারী রূপ নিয়েছে তা কি হাল আমলে বেড়েছে নাকি কমেছে তা বিচার করার ভার সম্মানিত পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিলাম।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক