শেখ হাসিনা সরকারের পতনের জন্য অনেকে তাঁর অতিকথনকে দায়ী করেন। তাঁর মুখে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ঘটনা দীর্ঘ। সেটা দলের নেতা-কর্মীদের নিয়েও যেমন আছে, তেমনি দলের বাইরের লোকদের নিয়েও আছে। সে তালিকায় ড. কামাল হোসেন, তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ, এ বি এম মূসা, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, হাসানুল হক ইনু প্রমুখসহ বহু প্রখ্যাত ব্যক্তিও রয়েছেন। কিন্তু তাঁর এসব আচরণের পেছনের কারণটা অনেকে খোঁজেন না। এর পেছনে রয়েছে সামন্ত মনোভাব। সামন্ত মনোভাব বোঝার আগে আমাদের সামন্ততন্ত্র বুঝতে হবে। মধ্যযুগে কেন্দ্রীয় সরকারের শিথিল শাসন ব্যবস্থার কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূ-স্বামীদের শাসন শুরু হয়। তাঁদের মহারাজা, রাজা, রায়, মালিক, চৌধুরী, নবাব, খান প্রভৃতি নামে উপাধি দেওয়া হতো। সামন্ত রাজারা খাজনা আদায়ের পাশাপাশি জনগণের নিরাপত্তাও দিত। তাঁদের হাতে বিচারিক ক্ষমতা ছিল। জনগণ তাদের রক্ষাকর্তা মনে করত। অনেকে প্রভু হিসেবেও মান্য করত। উদাহরণ হিসেবে নাটোরের রানী ভবানীর নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি বাংলার তেরো চাকলার এক চাকলার মালিক ছিলেন। তাঁদের অধীনে ছোট ছোট জমিদার থাকতেন। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালু হলে জমিদাররা জমির স্থায়ী মালিক হয়ে যান। জমিদারের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা বেশি ছিল। জমিদাররা তাদের খাজনা আদায়ের স্বার্থে বহু সংখ্যক জোতদার শ্রেণি সৃষ্টি করেন। আমরা যাদের জমিদার হিসেবে চিনি। তারা অনেকেই ছিলেন মূলত জোতদার। তখন জমিদার-জোতদাররা জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলতেন। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেছে বহু কাল আগে; কিন্তু সামন্ত মানসিকতা রয়ে গেছে আমাদের মাঝে। আমরা এখনো যারা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত; তথা কৃষক, তাঁতি, কুলু, জেলে, কামার, কুমোর, কর্মকার ইত্যাদি পেশার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সম্মান দেই না। কখনো বলি না, আমার বাবা কিংবা দাদা চাষি ছিলেন। বলি না তাঁতি ছিলেন। শেখ হাসিনার মুখে একাধিকবার শোনা গেছে তাঁর পূর্ব-পুরুষরা ইরাক থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য বাংলায় এসেছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা আশরাফ গোত্রের। দলের সভানেত্রী সামন্ত মানসিকতা দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় তারা কখনো দ্বিমত পছন্দ করতেন না। কেউ তাঁর বিকল্প হোক কিংবা সমান হোক- এটা কখনই কামনা করতেন না। তাঁকে ঘিরে অনুগত নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবী, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী, পুলিশ বাহিনীর এক দুর্ভেদ্য চক্র গড়ে ওঠে। সভানেত্রী যেখানে সামন্ত মনোভাব দ্বারা পরিচালিত, সেখানে দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে জনবান্ধব আচরণ আশা করা যায় কীভাবে! এমন একজন মন্ত্রীকে চিনতাম যার সমস্ত কথার মধ্যে থাকত বংশ গৌরব (অথচ তাঁর পিতা মাত্র ৩০ বিঘা জমি রেখে মারা গিয়েছিলেন)। তাঁর কাছে গিয়ে অপমানিত হননি, এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাঁর মুখে কখনো জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা শোনা যেত না। তাঁর এক অনুসারীকে চিনি, তাঁর পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা; অথচ তিনি তাঁর নানার পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। এ রকম উদাহরণ লাখ লাখ রয়েছে। আমির হোসেন আমুর কাছে কেউ গেলে পায়ে কদমবুচি বাধ্যতামূলক ছিল। শুধু তাই নয়, রাজা-বাদশার আমলের মতো তাঁকে সামনে করে সালাম দিতে দিতে পেছাতে হবে; অর্থাৎ পশ্চাৎদেশ প্রদর্শন করা নিষিদ্ধ। সামন্ত মনোভাব থেকেই পরিবারতন্ত্রের উদ্ভব হয়। দলের নেত্রী ৩৫ জন আত্মীয়কে এমপি বানিয়েছিলেন, তাঁর দেখাদেখি সমস্ত দেশে পরিবারতন্ত্র বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়। পিতা এমপি, পুত্র পৌর মেয়র, ভাগনে চেয়ারম্যান। এখন প্রশ্ন হলো- আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কি কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো পরিবারকে প্রতিষ্ঠার জন্য হয়েছিল? সেই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হননি, এমন পরিবার এ দেশে নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য, শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় এবং কাক্সিক্ষত সাংস্কৃতিক আন্দোলন না হওয়ায় আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার- কোনোটাই পাইনি। একই কারণে সামন্ত মানসিকতারও বিলুপ্তি ঘটেনি। আমি এক সময় ৬০ জন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতা-কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়েছি। আওয়ামী লীগ নেতাদের সারা দিনের কথার মধ্যে থাকে বংশগৌরব আর পরনিন্দা। পক্ষান্তরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের আচরণে থাকে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতি বেয়াদবি।
আওয়ামী লীগ নেতারা ভুলে যান, এ দেশের ৯০% মানুষের কোনো বংশগৌরব নেই। তাহলে কি তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক? শুধু আওয়ামী লীগ কেন? সব দলের নেতা-কর্মীদের মাঝেই কম-বেশি সামন্ত মনোভাব রয়েছে। আমরা আরও ভুলে যাই, আমাদের বংশের বয়স ২০০ বছরের বেশি নয়। কারণ বিভিন্ন দুর্ভিক্ষ ও মহামারির কারণে বহু বংশ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বড় পরিবার গড়ে ওঠার কোনো পরিবেশ ছিল না। পরিশেষে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ‘বংশগৌরব’ নামক ছোটগল্পের সারাংশ তুলে ধরা যেতে পারে। চারণ বাবু একটি সওদাগিরি অফিসে কারণিক পদে চাকরি করেন। কিন্তু তিনি যখনই সময় পান, তখনই বানিয়ে বানিয়ে ঠাকুরদার জমিদারি আমলের গল্প বলা শুরু করেন। গল্পের শুরুতে কবি বলেছেন- বাঙালিদের নামে একটি কথা বড়ই প্রচলিত যে, তারা বর্তমানে যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন, অতীতের গৌরব গায়ে মেখে নিজেকে মহিমান্বিত করে থাকেন। তা যদি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে বাড়িয়ে শোনানো যায়, তা কি এমন দোষের!
লেখক : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক