অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স এক মাসের কাছাকাছি হতে চলল। এই সামান্য সময়ের মধ্যে অনেক কিছু দেখেছি আমরা। দেখেছি দিনের পর দিন সচিবালয় আর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাও। পাহাড়সমান দাবিদাওয়া। ভেবে অবাক হই, এত দাবিদাওয়া এত দিন কোথায় ছিল? এত দিন তো কাউকে উঁচুগলায় কোনো দাবি পেশ করতে দেখিনি। ছাত্রদের দাবি, পদোন্নতি বঞ্চিতদের দাবি, পুলিশের দাবি, আনসারের দাবি, বিজিবির দাবি, মাস্টাররোলের কর্মচারীদের দাবি, রিকশাওয়ালাদের দাবি, সিএনজিচালকদের দাবি, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দাবি। দাবির পর দাবি। সরকার দাবি শুনবে, সামলাবে, না দেশের কাজ করবে! অদ্ভুত একটা অবস্থা!
নরম মাটি পেলে সবাই বুঝি আঁচড় বসাতে চায়। সবাই বুঝি ভাবছে, এত দিন তো কোনো দাবি করিনি, পাইওনি, নতুন সরকার এসেছে। এখনই যা নেওয়ার নিয়ে নিতে হবে। কেউ ভাবছে না দাবি পূরণ করার জন্য সময় দরকার, পর্যালোচনা করা দরকার, মতামত নেওয়া দরকার। তার মধ্যে শুরু হয়েছে সর্বগ্রাসী বন্যা। বন্যার পানিতে ডুবছে দেশের অর্ধেক জনপদ। এ অবস্থায় বন্যা সামাল দিতে হচ্ছে সরকারকে। করতে হচ্ছে উদ্ধারকাজ। পাঠাতে হচ্ছে ত্রাণ। অনেক মন্ত্রণালয় দিন-রাত এক করে কাজ করছে। তার মধ্যেও দাবি কিন্তু থেমে নেই।
এইচএসসির কয়েকটি বিষয় পরীক্ষা হয়ে দেশের উত্তাল পরিস্থিতির কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সরকার চেয়েছিল অর্ধেক মার্কে পরীক্ষা নিতে। হলো না। শিক্ষার্থীরা সচিবালয়ে প্রবেশ করে ১৮ তলায় উঠে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও করে অটোপাস নিয়ে এলো। অটোপাস চাই এটাই ছিল তাদের দাবি। এতে ভালো ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রী/উপদেষ্টার কার্যালয়, বঙ্গভবন সংরক্ষিত এলাকা। এসব এলাকা অরক্ষিত করা ঠিক না। তাই হলো। অনুমতি ছাড়া সচিবালয়ে ঢুকে নিয়ম ভঙ্গ করা হলো। আনসাররা সচিবালয় ঘিরে ফেলল। এমনভাবে ঘিরল যে, কোনো গেট দিয়েই কর্মকর্তা-কর্মচারী, উপদেষ্টারা বের হতে পারলেন না। সবার সবকিছু তাৎক্ষণিকভাবে চাই। অবশেষে ছাত্ররা সেখানে জমায়েত হলো। শুরু হলো মারপিট। আনসাররা সরে গেল। তবে আহত হলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ অনেকেই। বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। শোনা যায়, আনসারের ছদ্মবেশে সেখানে ছিল কোনো কোনো দলীয় কর্মী এবং দুষ্কৃতকারী।
সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন এটা ঠিক। দলীয় বিবেচনায় অনেককে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, যোগ্য হওয়ার পরও অনেকে পাননি, এটাও সত্য। কিন্তু তাই বলে সরকার ভালোভাবে বসার আগেই পদোন্নতির এতটা জোরালো দাবি কি সঙ্গত! দুই সপ্তাহে উপসচিব থেকে সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি হয়েছে ৪৭৯ জন কর্মকর্তার। আরও পদোন্নতি হবে বলে শুনছি। এমন তো নয় যে, যাদের পদোন্নতি দেওয়া হলো পদোন্নতি না দিলে দু-এক দিনের মধ্যে তারা অবসরে চলে যেতেন। এত তাড়া কীসের? এই তাড়ায় যে পদোন্নতিবঞ্চিতদের সঙ্গে সঙ্গে যারা সত্যিই পদোন্নতির অনুপযোগী ছিলেন তারাও পার পেয়ে গেলেন সেটা কি ভেবে দেখেছেন! অন্তত পত্রিকায় সেটাই এসেছে। এই ‘গণ-পদোন্নতিতে প্রশাসনের পিরামিড লন্ডভন্ড’ এমন খবরও বেরিয়েছে পত্রিকায়। পিরামিড বলতে আমরা বুঝি ওপরের পদে কম কর্মকর্তা নিচে বেশি। কিন্তু বাস্তবে অবস্থা ভিন্ন। নিচের দিকে কর্মকর্তা কম ওপরে বেশি। পদ ছাড়াই পদোন্নতি হচ্ছে। এটা যে কেবল এই সরকারের আমলে হলো তা নয়, আগেও হয়েছে। আগেও একই চিত্র ছিল। বিষয়টি হচ্ছে ৪১ বছর আগের জনবল কাঠামোতেই চলছে প্রশাসন। সবার আগে দরকার বাস্তবতার নিরিখে জনবল কাঠামোর সংস্কার। কিন্তু সে সময় সরকারকে দিচ্ছে কে! সবাই দরখাস্ত নিয়ে ছুটছে সচিবালয় অভিমুখে। যেন সচিবালয়ই তাদের মঞ্জিলে মকসুদ। এখন সচিবালয়ে যদি এত পদোন্নতি হয় অন্য দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পদোন্নতির দাবি তুলবেন-এটাই স্বাভাবিক। তখন কিন্তু সামলানো কঠিন হবে। তাই পদোন্নতির রাশ টেনে ধরা দরকার। দেখেশুনে বিবেচনা করে তবেই পদোন্নতি দেওয়া উচিত। এখন যিনি বঞ্চিত হয়েছেন তিনিও দৌড়াচ্ছেন, যিনি হননি, আগের সরকারে সর-ঘি খেয়েছেন, তিনিও দৌড়াচ্ছেন সচিবালয়ের দিকে আরও কিছু পাওয়ার আশায়। সচিবালয় এখন সবারই মোকাম। কাজেই রয়ে-সয়ে কাজ করা দরকার। এক পক্ষকে খুশি করলে অন্যরা বিরাগভাজন হতে পারে, সেটাও দেখার।
একদিকে চলছে পদোন্নতির হিড়িক অন্যদিকে চলছে পদত্যাগ। খুব অল্পজনই নিজ ইচ্ছায় পদত্যাগ করছেন। পদত্যাগ করানো হচ্ছে। আমি আমার জীবদ্দশায় শিক্ষকদের এমন মানহানি আর দেখিনি। আগের সরকারে কাজ করেছেন বলেই সব শিক্ষক খারাপ এমনটা তো নয়। প্রতিটি শিক্ষকই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন এমনও নয়। যারা বয়স্ক, অবসরে যাওয়ার কাছাকাছি সময়ে যারা চলে এসেছেন তারা তো অনেক আগেই নিয়োগ পেয়েছেন। তাহলে তাদের নিয়ে এই টানাটানি, এত হেনস্তা কেন? একজন শিক্ষিকাকে গাছের সঙ্গে বাঁধা হয়েছে আর একজনকে টেনেহিঁচড়ে নামানো হচ্ছে, একজন জোর-জবরদস্তিতে হার্ট স্ট্রোক হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এগুলো কি সঙ্গত! আর এসব করছে ছাত্ররাই। ভাবতে অবাক লাগে এরা কি আসলে ছাত্র, নাকি ছাত্র-নামধারী অন্য কেউ! ভবিষ্যতে এরাও তো কেউ কেউ শিক্ষক হবেন। তখন যদি এদের এ অবস্থা হয় সেটা কেমন হবে ভেবেছে কি কেউ? কে কোন দলের তা কি গায়ে লেখা আছে। চাকরি বাঁচানোর জন্য অনেককেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক কিছু করতে হয়। বিশেষত বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার মতো মনোবল বা আর্থিক অবস্থা সবার থাকে না। সে কথাটাও তো ভাবা দরকার। এসব স্কুল-কলেজ পরিচালিত হয় গভর্নিং বডির দ্বারা। যাদের মধ্যে সভাপতি থাকেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন এমপি বা দলীয় লোক। তখন একজন অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকের করার কী থাকে! তারা কিছু বললে না শুনে উপায় থাকে কোনো? অবিবেচনাপ্রসূত কাজ করলে হবে না। একসময় আমাদের ছাত্রদের সুনাম ছিল শিক্ষকদের সম্মান করার জন্য। এখন আমাদের ছাত্ররা হয়েছে শিক্ষকের যম। এসব ঠিক না। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয় কথা বলেছেন, নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে। আমরা এমন বাংলাদেশ দেখতে চাই না, যে দেশে ছাত্র শিক্ষকের গায়ে হাত তোলে। সে শিক্ষক যদি চরম অন্যায়কারীও হন, তাও না। তার কাজের প্রতিবিধান করার জন্য আইন আছে, নিয়ম-কানুন আছে। আমি ভেবে অবাক হই, ছাত্ররা শিক্ষকদের অবমাননা করে, অন্য শিক্ষকরা তা চেয়ে চেয়ে দেখেন। প্রতিবাদ করেন না, অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রদের সমর্থনও করেন। এটা কলিকাল নাকি!
আর একটা বিষয়ও দেখছি প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন অসংখ্য মামলা হচ্ছে। সেসব মামলার আসামির অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের আদালতে নেওয়ার সময় অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, আইনজীবীরা পর্যন্ত জুতা-স্যান্ডেল ডিম হাতে হামলা করছেন। জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য আসামিদের হেলমেট পরানো হচ্ছে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আদালতে নেওয়া হচ্ছে। তারা যদি দোষী হন তার বিচার করবেন আদালত। দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগে কাউকে দোষী বলা যায় না। বিচারের আগেই দোষী সাব্যস্ত করে তাদের বিচার করতে পারে না জনগণ। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি ছিল সব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হয়েছে। এক একজন সাত আটবার করে চুক্তি পেয়েছেন এমন চুক্তিও বাতিল করা হয়েছে। ক্রমান্বয়ে হয়তো আরও হবে। তবে ইতোমধ্যে কয়েকজনকে চুক্তি দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকজন সত্যিই বঞ্চিত ছিলেন। তাদের নিয়োগ যথার্থ। অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিকে চুক্তি দেওয়ার বিধান আছে।
আরও একটা বিষয় দেখছি প্রতিনিয়ত। দেশে অন্তর্বর্তী সরকার। তারা হইচই না করে নিঃশব্দে কাজ করছেন। অথচ সরকার পতনের পর থেকেই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে অন্যান্য দল। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে তারাই যেন সরকারে। তারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে হুমকি দিচ্ছে, ক্যান্টিন বরাদ্দ চাচ্ছে, বাজারে, পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি করার চেষ্টা করছে। এ এক মহাসমস্যা। কয়জনের দাপট সইবে সাধারণ মানুষ!
ইতোমধ্যে বন্যা ত্রাণ তহবিলে টাকা দিয়েছে সরকার। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের দীর্ঘদিন দাবি ছিল বিমানবন্দরে কিছু সুযোগ-সুবিধা। সেটা করে দিয়েছে সরকার। সবকিছু হচ্ছে ঢাকঢোল না পিটিয়ে, কোনো রকম প্রচারণা ছাড়া। পত্রিকায় পড়েছি ইতোমধ্যে বিমানবন্দরের চেহারা বদলে গেছে। যে হেল্প ডেস্কে কোনো দিনই মানুষ পাওয়া যেত না, এখন সেখানে সর্বক্ষণ লোক কাজ করছে। বেশ কয়েকটি টেলিফোন বুথ খোলা হয়েছে। সেখান থেকে যাত্রীরা বিনামূল্যে ফোন করতে পারছেন। এক ঘণ্টার ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। লাগেজ কেটে চুরি-চামারি আগের মতো হয় না, কারণ সর্বক্ষণ আছে সিসিটিভি। লাগেজ খালাস হচ্ছে দ্রুততম সময়ে। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা সুবিধা চেয়েছিলেন। তাদের বদৌলতে সুবিধা পাচ্ছে সমগ্র দেশবাসী। আমরা চাই এই সুবিধা যেন এমনটাই থাকে। যেন আবার আগের অবস্থায় ফিরে না যায়। তা ছাড়া পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে এয়ারপোর্টের ভিতরে প্রবেশ করা যায়। তাতে বৃদ্ধ এবং অসুস্থ যাত্রীদের সঙ্গে তাদের আত্মীয়স্বজন ইমিগ্রেশনের আগ পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু আমাদের বিমানবন্দরে যাত্রী ছাড়া অন্যদের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। ভিতর পর্যন্ত যাত্রীদের আত্মীয়স্বজনের যাওয়ার সুবিধা দিলে উপকৃত হবে জনগণ। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। দেশে সমস্যা আছে, সমস্যা থাকবে। সমস্যার সমাধানও আছে। কিন্তু সেজন্য নতুন সরকারকে সময় দিতে হবে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমাদের কাজ করতে দিন। আমরাও বলি, সরকারকে কাজ করতে দিন।
লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক