এই উর্বর মানবগোষ্ঠী আর উর্বর চিন্তা-চেতনায় স্নাত বাংলার উর্বর ভূমি কত যুগ আর কত কাল থেকে একে একে জন্ম দিয়ে গেছে অগণ্য প্রতিভার। কিন্তু সেই প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের আগেই তা হয়তো কখনো হারিয়ে গেছে, কখনো প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশ বিঘ্নিত হয়ে তা বিনষ্ট হয়ে গেছে, অনেক প্রতিভা আজীবন সাধনার সুফল আবাদ করতে না পেরে ব্যর্থতার জ্বালায় পুড়ে খাক হয়ে গেছে। খুবই গণ্য সংখ্যায় প্রতিভার পূর্ণ পরিস্ফুটনে দেশ ও জাতি হয়েছে উপকৃত। সমাজ তার খেই-হারা পথ ছেড়ে উঠে এসেছে সত্য ও যথার্থ জীবনের পথ বেয়ে; তাদের সংখ্যা খুব সীমিত বলেই প্রতিভার গণস্ফুরণ হয়নি। তেমনি এক প্রতিভা ছিলেন শিক্ষাজগতের শিক্ষাঅন্ত মানুষটি- যিনি নীরবে সারাটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন মানুষ গড়ার মোহনমায়ায়। মোহাম্মদ নোমান। বাংলার শিক্ষাঙ্গনে এই সুপরিচিত নামটির পেছনে যে ব্যক্তিত্ব নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন তাঁর প্রত্যক্ষ দর্শন লাভ করার সৌভাগ্য ঘটেছে ওপরতলার খুব কম মানুষেরই। যদি তাঁরা ভাগ্যবান হতেন তাঁর সান্নিধ্যে আসার, তবে হয়তো মানবসম্পদ উন্নয়নের বিদেশি ভাবনায় আজ আমরা গড়াগড়ি খেতাম না। স্বকীয় চেতনায়, নিজেদের ধারণায়, নিজস্ব চিন্তাধারায় শিক্ষা-দীক্ষায় ও মানুষ গড়ার সাধনায় আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য নিয়েই জাতিকে সঠিক পথপ্রদর্শনের সুযোগ আমরা খুঁজে পেতাম। সহজ-সরল সাধারণ বাঙালি জীবনের ধারক ও বাহক হিসেবে মোহাম্মদ নোমান নিজেকে চিহ্নিত করে রেখে গেছেন। তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণের যারা সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের ভাগ্যবান। আমার আলমা ম্যাটার ঢাকা কলেজকে তিনি নিজের হাতে গড়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতার মূল মহলে নৈরাজ্যের ধ্বজাধারীদের প্রাধান্যের কারণে তাঁর সেই স্বপ্ন স্থায়ী হতে পারেনি। সুখী পরিবারকে কেন্দ্র করেই সুখী ব্যক্তি ও সমাজজীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আপনা থেকেই জন্ম নেবে এই দর্শনে ছিল তার প্রগাঢ় আস্থা। তাই তাঁকে আমরা দেখেছি সারাটা জীবন ছত্রিশ সদস্য বিশিষ্ট একটি একান্ন পরিবারের পুরোধায়- যে পরিবার শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানার্জন ও সমাজসেবায় পেশাগত সাফল্যে এবং স্বাভাবিক সুদৃঢ় সমাজগোষ্ঠী সংগঠনে এক আদর্শ স্থাপন করতে পেরেছিল। আজকের সন্ত্রাসী প্রভাবিত অশান্ত সমাজব্যবস্থায় আমরা যে সুখ ও জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে মুহূর্ত কাটাচ্ছি অসম্ভব মানসিক যাতনায়-শিক্ষাবিদ নোমান তাঁর সমাধান আমাদের জন্য রেখে গেছেন। কিন্তু তাঁর শিক্ষা ও পথনির্দেশকে হৃদয়াঙ্গম করতে হলে আমাদের সন্তানদের তাঁর আঁকা শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতির ছকে দীক্ষিত করতে হবে। তাই আজ আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি মোহাম্মদ নোমানের কয়েকজন যোগ্য অনুসারীকে আমাদের প্রতি শিক্ষাঙ্গনে। কেবল শুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে ন্যায় ও সত্যের উচ্চারণ নিয়ে তাঁরা আসবেন এবং আজকের এই বিপর্যস্ত সমাজব্যবস্থার সামনে নোমানের আলোকবর্তিকা তুলে ধরবেন। যার আলোকে উদ্ভাসিত দেখতে পাব একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন সমাজ- একটি আনন্দমুখর পরিবেশ; হাসিখেলা আনন্দ-উচ্ছলতার মধ্য দিয়ে বিকশিত হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্বের গুণাবলি। আর ‘সুখ’, ‘সুখ’ করে সুখের স্বপ্নে উদ্ভ্রান্ত হচ্ছে না বিব্রত মানবগোষ্ঠী। মসির তেজ ছিল মোহাম্মদ নোমানের খুবই প্রবল। ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য, দর্শন অপূর্ব ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠত তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান, ডক্টর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ ইংরেজির জ্ঞানসাগর যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও ছুটে আসতেন সঠিক ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য নানা বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁর কাছে। এই অনন্য প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বকে যথার্থই চুরানব্বই সালে শিক্ষাক্ষেত্রে একুশে পদক প্রদান করে সম্মান দান করা হয়েছে। দুর্দান্ত ছাত্রকে সঠিক পথে নিয়ে আসা থেকে শুরু করে সুপ্ত প্রতিভাকে উৎসারিত করে সর্বসমক্ষে উপস্থাপন করার প্রবণতা ছিল তাঁর মধ্যে প্রবল। তাঁর সময়কালে ঢাকা কলেজের বোর্ড পরীক্ষায় ফলাফলসমূহ নিঃসন্দেহে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে সযত্নে লালিত শিক্ষাঙ্গন এবং ছাত্রগোষ্ঠী কি সুফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে। শখের ফুলের বাগানে ফুল ফোটাবার নেশা যাঁদের তাঁরা বুঝবেন যে মানুষের মনে শিক্ষার ফুল ফোটানোর মতো আনন্দের আবেগ তাঁর মধ্যে উৎসারিত হতো। তাঁর হাতে গড়া অনেক প্রতিভা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের কেবল কামনা যে আদর্শবান শিক্ষক প্রতি স্তরে প্রতি বিদ্যায়তনে প্রতি শিক্ষা প্রাঙ্গণে জন্ম নিক যেন উইপোকায় খেয়ে যাওয়া আমাদের নীতিবোধ, শিক্ষাব্যবস্থা আর সমাজব্যবস্থাকে আমরা তাঁদের নীতি, আদর্শ, ত্যাগ ও মহিমায় নতুন করে মনের মতো গড়ে তুলতে পারি। কিন্তু এই কামনা চরিতার্থের উপায় কী? এই উপায় উদ্ভাবনের কথাই আজ আমাদের ভাবতে হবে- শিক্ষাব্যবস্থা নীতি-নির্ধারণী চূড়ায় যাঁরা উপবিষ্ট, তাঁদের এ নিয়ে জোরালো বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই তাঁদের অনেক ওপরের সিঁড়ি ছেড়ে দিয়ে নেমে আসতে হবে মাটির ধরণিতে, যে মাটি পঙ্কিল-শ্যাওলা ভর্তি পিচ্ছিল, বিপদসংকুল সমাজপতি, শিল্পপতি, বুদ্ধিজীবী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত অধিকর্তা, রাজনীতির কর্ণধার আর শিক্ষক ও শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে, বিভিন্ন স্তরের গণপ্রতিনিধিকে বেশ কিছু স্বার্থের সময় ত্যাগ করে এগিয়ে আসতে হবে; সম্মিলিতভাবে ভাবতে হবে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলো সম্পর্কে, শিক্ষা কারিকুলাম সম্পর্কে, তরুণদের শিক্ষার ফাঁকে ফাঁকে অবসর মুহূর্তগুলো যথার্থই আনন্দ উচ্ছ্বাসের মধ্যে নিয়োজিত রেখে ওদের সুঠাম চরিত্র গঠনে কার্যক্রম তৈরি করার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষক গোষ্ঠী গঠন করতে হবে মোহাম্মদ নোমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত করে- যেন তাঁরা দৃপ্ত শপথ নিয়ে মানুষের বসবাসযোগ্য পৃথিবীর এই ছোট্ট অংশটুকু গড়ে তুলতে পারেন।
আপনারা কি ঠিক এভাবে ভাবতে পারেন না, পা বাড়াতে পারেন না-সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আপনার সন্তানকে আপনার সংসারকে, আপনার সমাজকে তথা আপনার দেশকে বাঁচাবার জন্য ব্রতী হতে পারেন না? আসুন, আজ মোহাম্মদ নোমান আর তাঁর মতো ত্যাগী শিক্ষকদের কথা স্মরণ করে সেই পথেই আমরা পা বাড়াই।
লেখক : প্রধান স্কাউট কমিশনার ও সাবেক সচিব