দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি অংশ সুকৌশলে সংস্কার ও নির্বাচনকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। তারা বলছেন, আগে সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে। সংস্কারের পর নির্বাচনের প্রশ্ন আসবে। পায়ের তলায় যাদের মাটি নেই তারাই এমন তত্ত্বে বেশি আগ্রহী। একইভাবে যারা ক্ষমতা ছেড়ে জনরোষের ভয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন অথবা দেশে আত্মগোপন করে আছেন তারাও চান যে কোনো অজুহাতে নির্বাচন বিলম্বিত হোক। নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখতে পারলে অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হবে। তাদের প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস পাবে। আর তা সম্ভব হলে ১৫ বছরের লুটপাটের টাকা ব্যবহার করে তারা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস ইত্যাদি ইস্যু ব্যবহার করে প্রতি বিপ্লবের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে এমন দিবাস্বপ্নেও মগ্ন। রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জরুরি সংস্কার শেষে সরকারকে নির্বাচনের দিকে পা বাড়াতে হবে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কাজ অন্তর্বর্তী সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। তার মধ্যে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সত্যিকার মানবিক করে তোলা অন্যতম। এর পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব বিগত সরকারের যারা হত্যা, নিপীড়ন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের জন্য দায়ী তাদের বিচার শুরু করতে হবে। সাম্প্রতিক স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ এবং আহতদের পরিবারকে সহায়তা দান ও পুনর্বাসন কার্যক্রম গ্রহণ সরকারের আশু কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। দেশবাসীর সিংহভাগ খেটে খাওয়া মানুষ; এদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার লক্ষ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী ও কঠোর আইনি ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সুষ্ঠু পথে পরিচালনায় অবিলম্বে ব্যাংকিং খাতের ডাকাত-দস্যুদের আটক করে বিচার শুরু করাও জরুরি। পতিত সরকারের অপকর্মের সহযোগী দালাল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাষ্ট্রের প্রতিটি দপ্তর থেকে বিতাড়ন ও তাদের অপরাধের যথাযোগ্য বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। শিল্পকারখানা ও কৃষি খাতে ব্যাপকভাবে উৎপাদন কার্যক্রম সচল করা সরকারের কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। রক্ত পানি করা শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান যেসব প্রবাসী রেমিট্যান্সযোদ্ধা তাদের বিমানবন্দর থেকে সর্বত্র সম্মানিত করার মাধ্যমে হুন্ডি-দস্যুদের প্রতিরোধ এবং রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অগ্রাধিকারের দাবি রাখে। পতিত সরকারের দালালদের দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থায়ীভাবে বাতিল ও অবৈধ সব আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা সময়ের দাবি। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে পাচার লাখ লাখ কোটি টাকা অবিলম্বে বিভিন্ন দেশের ব্যাংক থেকে ফেরত আনার উদ্যোগও নিতে হবে।
আতঙ্কের ব্যাপার হচ্ছে, সরকারি প্রতিটি দপ্তরে স্বৈরাচারী গোষ্ঠীর চাটুকার-মোসাহেব ও তাদের প্রেতাত্মারা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য : শিক্ষার্থী-গণমানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সাফল্যকে কালিমা লিপ্ত করে সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়া। এজন্য চক্রান্তকারীরা দুনিয়াব্যাপী তৎপরতা চালাচ্ছে। সবারই জানা যে, পলাতক প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি মদতদানের ফলে তার পরিবার-পরিজন ও দলীয় নেতা-কর্মীরা ও তাদের মোসাহেব-চাটুকার আমলারা সাড়ে ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রকে খাবলে খেয়েছে। অনুমান করা হয়, রাষ্ট্রের কয়েক লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠিত হয়েছে। বিশে^র অন্য কোনো দেশে এরকম লাগামহীন অনৈতিক কাজ খুব কমই হয়েছে। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী গণ আন্দোলন যত জোরদার হয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার ততই তার দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন চালায়। এতে তিন সপ্তাহেই কমপক্ষে ১৮০০ মানুষের প্রাণ যায়। আহত হন কমপক্ষে ১৮ হাজার শিক্ষার্থী-গণমানুষ। তাদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন।
এসব শহীদের আত্মত্যাগের মূল্য জাতি কীভাবে দেবে? কীভাবে শহীদ আহত আর পঙ্গুত্ববরণ করা আত্মত্যাগী বীরের ওপর ফ্যাসিবাদী হামলার প্রতিশোধ নেবে? এজন্য দৃষ্টান্তমূলক বিচারের উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে বিচার কার্যক্রম ঝুলে যাবে। তখন ফ্যাসিস্ট দানবরা লুণ্ঠিত অর্থের একাংশ ঘুষ বাবদ খরচ করে রেহাই পাওয়ার জন্য ব্যয় করবে। দেশের ৫৩ বছরের ইতিহাস প্রমাণ দেয়- হত্যাকান্ডসহ অগণন অপরাধের বিচার হয়নি, টাকার জোরে, ক্ষমতার জোরে নানাভাবে অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে বিচারপ্রার্থী অসহায় মানুষের ওপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আরও অপরাধ করতে থেকেছে। শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা কেঁদে মরেছে, প্রতিকার পাননি। লাখো মানুষের আত্মত্যাগকে স্বার্থক করতে নির্বাচনের পথে হাঁটতে হবে জাতিকে। এ বিষয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অভিভাবকের ভূমিকা পালনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। যিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। ধন্যবাদ মাননীয় উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে।
গত বৃহস্পতিবার রাতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ে সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঞ্চালনায় ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল নির্বাচন নিয়ে মতামত রেখেছেন। বলেছেন, তাঁর মনে হচ্ছে আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করা হয়তো সম্ভব হবে। এটা অবশ্য তাঁর অনুমান। তাঁর মতে, ‘নির্বাচনের জন্য অনেক ধাপ রয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য সার্চ কমিটি লাগবে। সার্চ কমিটি করতে হলে পিএসসির চেয়ারম্যান লাগবে। সেটার নিয়োগ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। সঠিক ভোটার তালিকা করতে হবে। নির্বাচনের জন্য এসব ধাপ চিন্তা করতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে সার্চ কমিটি হবে। এরপর নির্বাচন কমিশন গঠন হবে।’ তিনি বলেছেন, ‘ভুয়া নির্বাচন কমিশন থেকে নির্বাচন করা হোক, সেটা কেউ চান না। নিশ্চয়ই কেউ চায়নি হাবিবুল আউয়াল কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেবে। এটা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।’ আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর প্রথম কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। ফ্যাসিস্ট সরকার ২০২৪ সালের ভুয়া নির্বাচনে ভোটার তালিকা নিয়ে ব্যাপক অরাজকতা করেছিল। হয়তো ভয় ছিল, নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে কী অবস্থা হবে।’ আইন উপদেষ্টা মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা অনুসন্ধান করুন, ২০২৪ সালের ভোটার তালিকার নামে কী করা হয়েছিল। সুতরাং ভোটের আগে একটি সুষ্ঠু ভোটার তালিকা করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ছাড়া এ ভোটার তালিকা তৈরির আদেশ কেউ দিতে পারে না। প্রধান উপদেষ্টার আদেশে ভোটার তালিকা হবে না। নির্বাচন কমিশনের আদেশে হবে।’
পরদিন শুক্রবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতির বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে বর্তমানে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা। নিত্যপণ্যের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে দেশে কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর এবং স্বল্প আয়ের মানুষ দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও মানুষের আয় সেভাবে বাড়েনি। সরকারকে বলব- জিনিসপত্রের দাম কমাতে পদক্ষেপ নিন। পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাস্তব ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। মাফিয়া সিন্ডিকেট ভাঙতে প্রয়োজনে উপদেষ্টা পরিষদের আকার বাড়াতে হবে। সংস্কার অনেক প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংস্কার ধারাবাহিক ও চলমান প্রক্রিয়া। যে কোনো সংস্কারে জনগণের সম্পৃক্ততা না থাকলে তা ভালো ফলাফল দেয় না। স্বৈরাচার সরকারের সুবিধাভোগীরা ঘরে-বাইরে, প্রশাসনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে চায়। ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে না পারলে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের অর্জন বিপন্ন হবে। রাষ্ট্রকে জনগণের প্রত্যাশিত কাজ করতে হবে। স্বৈরাচারের দোসরদের বসিয়ে রেখে কোনো উপকার মিলবে না।
দেশের ভোট পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আনুপাতিক ভোটের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। পৃথিবীর অনেক দেশ এ পদ্ধতি চালু করে ফিরে এসেছে। একটা নতুন পদ্ধতি তৈরি করতে হলে সমাজ এবং জনগণের আকাক্সক্ষার মিল থাকতে হবে। সুশীল সমাজ এটার ওপর বক্তব্য রাখছেন, আর এটার ওপর ভিত্তি করে আপনারা যদি মনে করেন এটা সঠিক, তাহলে নির্বাচনব্যবস্থা আরও ভেঙে যাবে। এখন এই আনুপাতিক পদ্ধতিটা বুঝতেই চলে যাবে ৫-১০ বছর। পতিত স্বৈরাচার বসে নেই। বৃহস্পতিবার প্রতিবেশী দেশের স্টেটমেন্টে তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন- ‘শেখ হাসিনা সেখানে আছেন, সেখানেই থাকবেন।’ ভারতের সঙ্গে তো আমাদের প্রত্যর্পণ চুক্তি আছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যর্পণ বিষয়ে সমাধান করতে পারে, এ সরকার তাকে ফিরিয়ে আনতে পারে। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে না আনা হলে বাংলাদেশে যত শীর্ষ সন্ত্রাসী আছে তারা ভারতে আশ্রয়ের সুযোগ নেবে। বিভিন্ন দেশে এভাবে আশ্রয় পাওয়ার সুযোগ পাবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রত্যেকটা দল সমর্থন করেছে। এটা গণতন্ত্রকামী মানুষের সমর্থিত সরকার। তবে তাদের জনগণের অন্তরের ভাষাটা আগে বুঝতে হবে।
♦ লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক