যমুনা নদীর পাড়ে সম্রাট শাহজাহানের বিশ্বনন্দিত অমর প্রেমের কীর্তি তাজমহল। বাগিচাঘেরা শ্বেতমর্মরে মমতাজ মহলের সমাধিসৌধ। ভারত তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্মৃতিসৌধ এ তাজমহল। সম্রাট শাহজাহানপত্নী আরজুমান বানু বেগম (মমতাজ) ১৬৩১ সালে বুরহানপুরে চতুর্দশ সন্তানের জন্ম দিয়ে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মারা যান। সাময়িকভাবে বুরহানপুরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ছয় মাস পর সেখান থেকে তাজমহলের সমাধিতে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁর লাশ। ১৬৩১ সালে তাজমহলের নির্মাণ শুরু হয়ে ১৬৫২ সালে শেষ হয়। এতে মোট ব্যয় হয় ৫০ লাখ স্বর্ণমুদ্রা। তুরস্কের স্থপতি ওস্তাদ ঈসা আফান্দির পরিচালনায় ২০ হাজার শ্রমিক ২০ বছর পরিশ্রম করে সম্রাট শাহজাহানের কল্পনার বাস্তব রূপ দেন এবং গড়ে ওঠে অদ্বিতীয় স্মৃতিসৌধ তাজমহল। তাজের স্বপ্নময় রূপে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ণনা করেছেন- ‘কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহল’।
দক্ষিণের লাল পাথরের সুদৃশ্য তোরণ পেরিয়ে তাজে প্রবেশ করতে হয়। তাজে প্রবেশ করতে ভারতীয়দের জন্য ৫০ রুপি পর্যকটদের জন্য ৭০০ রুপি দিয়ে টিকিট করতে হয়। ভারতের প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে এ ধরনের পার্থক্য দেখা যায়। অদূরেই যমুনার তীরে নীল আকাশের পটভূমিকায় শ্বেতশুভ্র মায়াময় তাজ। সামনে পাথরে বাঁধানো জলাশয়। মাঝে ফোয়ারা। পানিধারায় স্থির পানিতে তাজের প্রতিবিম্ব। দুই পাশে ঝাউগাছের সারি, পাশে পাশে ফুলের কেয়ারি, নরম ঘাসে ছাওয়া পুরো প্রান্তর। আর এরই মাঝে পাথর বাঁধানো পথ গেছে তাজ পর্যন্ত। বেলেপাথরের ভিত্তিমঞ্চের ওপর ৯৫ বর্গমিটারের মর্মর পাথরের বেদির ওপর শ্বেতপাথরের তাজমহল। চার কোণে চারটি ৪৩ মিটার উঁচু অভ্রভেদী সুদৃশ্য মিনার। মাঝে কেন্দ্রীয় গম্বুজের উচ্চতা ২৪ মিটার, ব্যাস ১৮ মিটার, চারপাশে ছোট ছোট গম্বুজ। মূল গম্বুজের নিচেই সমাধিকক্ষ। শ্বেতমর্মরে আটকোনা জালির কাজ করা প্রাচীর। অপূর্বচিত্রিত সিলিং। কক্ষের সর্বত্রই ফুল-লতাপাতা প্রভৃতির নকশায় সাজানো। মাঝে মমতাজের সমাধি। পাশেই শাহজাহানের সমাধি। মসৃণ শ্বেতপাথরের ওপর লতাপাতা-ফুল শোভা পাচ্ছে। নকল কবর এই দুটি। সমাধির ওপর ঝুলন্ত বাতিদান ইংরেজ গভর্নর লর্ডের শ্রদ্ধাঞ্জলি। এর নির্মাণকৌশল এমনি যে জালির মধ্য দিয়ে আলো এসে আলোকিত করে সমাধি। আধুনিক বৈজ্ঞানিক উন্নতির সময়ে এর সংযোজন লক্ষ করার মতো। এখানে যে কোনো শব্দ ৫০ সেকেন্ড ধরে প্রতিধ্বনি হতে থাকে। তাজ প্রাঙ্গণে এবং তাজের পশ্চিমে মসজিদ ও পূর্বে মেহমানখানা। দিনের প্রতিটি মুহূর্তে তাজের রূপ বদল হয়। ভোরে সূর্যকিরণে রঞ্জিত হয়ে ওঠা তাজ মধ্যাহ্নের প্রখর কিরণে চোখধাঁধানো শুভ্ররূপ ধারণ করে। আবার অস্তগামী সূর্যের ম্লান আলোয় স্বর্ণরূপ ধারণ করে। তবে সবচেয়ে সুন্দররূপে তাজকে দেখা যায় পূর্ণিমার রাতে। জ্যোৎস্না রাতে বিমোহিত তাজ দেখতে পর্যটকরা জড়ো হয় দলে দলে। তাই পূর্ণিমার দুদিন আগে/পরে অর্থাৎ মোট পাঁচ দিন সূর্যোদয় থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে তাজ। আর অন্য সময়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা থাকে তাজমহল। তাজের অপরূপ সৌন্দর্য আজও বিশ্বের সব প্রেমিক- প্রেমিকার জন্য স্বর্গরূপে দৈদীপ্যমান। তাজের দুই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে যমুনার কিনারে আগ্রা কেল্লা। মুঘল সম্রাট আকবরের হাতে আগ্রা কেল্লার গোড়াপত্তন এবং পুত্র জাহাঙ্গীর ও পৌত্র শাহজাহানের হাতে সমৃদ্ধি ঘটে এর। আগ্রা দুর্গে ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়ে আকবর মহল। পাশেই জাহাঙ্গীর মহল। এরপর মহারানি যোধাবাঈ মহল। কাছেই আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দি শিবাজীর কক্ষ। এরই উত্তর ভাগে শাহজাদী মহল। পাশেই খাসমহল। খাসমহলের উত্তরে যমুনার দিকে মুসম্মান বুরুজ। রত্নখচিত দোতলা এ মহলটি শাহজাহান নির্মাণ করান তাঁর বেগম মমতাজের জন্য। আর পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দি হয়ে এ মহলে শুয়ে শুয়ে অশ্রুসজল চোখে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সম্রাট শাহজাহান।
এর বাঁয়ে শীষমহল হামাম, বাতি জ্বালালে লাখ লাখ আয়নায় প্রতিফলন হয় আলোর শিখা। আর এভাবেই একদা আলোকিত হতো স্নানাগার। শীষমহলের উত্তরে মিনা মসজিদ। সামনে সম্রাট শাহজাহান নির্মিত দেওয়ানি আম। লাল পাথরের থাম ও খিলানের কারুকার্য দেখার মতো। এ দেওয়ানি আমেই ছিল মণিমাণিক্যখচিত ময়ূর সিংহাসন। পারস্যের সম্রাট নাদের শাহ লুট করে নিয়ে যান এটি। এর অদূরেই মোতি মসজিদ, সম্রাটের পারিবারিক মসজিদ। প্রাঙ্গণের দক্ষিণে সূর্যঘড়িতে সময় নির্ণয় করা হতো। আরও রয়েছে মিনাবাজার মচ্চি ভবন ও সলিমগড় আগ্রা দুর্গ।
লেখক : কলামিস্ট