সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিজ্ঞ নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘মার্কিন প্রশাসন শুল্কহার বৃদ্ধিতে কোনো নিয়মকানুনের ধার ধারেনি।’ সত্যই কি তাই? মার্কিন প্রশাসন কি এতই অবুঝ? প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে প্রশাসন দ্রুত কোনো ধরনের গবেষণার সুযোগ না পেয়ে শুল্কহার নির্ধারণ করেছে। বুড়ো আঙুলের (রুল অব থামব) নিয়ম অনুযায়ী মার্কিনিদের ওপর যে শুল্ক নির্ধারিত আছে, মার্কিন প্রশাসন তার ৫০ পারসেন্ট সে দেশের ওপর আরোপ করেছে। মার্কিনিদের ওপর বাংলাদেশের শুল্ক ৭৪ পারসেন্ট, আমাদের ওপর আরোপ ৩৭ পারসেন্ট।
বাংলাদেশ প্রশাসন শুল্ক হ্রাসের যে আবেদন করেছে, সেখানে উল্লেখ করা উচিত ছিল আমেরিকা থেকে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর গড়ে ১০ পারসেন্ট শুল্ক ধার্য করা হবে। কম্বোডিয়া শুল্ক আরোপের পরদিনই মার্কিন পণ্যের ওপর ৫ পারসেন্ট আরোপের ঘোষণা দেয়। আশ্চর্য হব না তাদের ওপর শুল্ক ২০ পারসেন্ট নামিয়ে আনা হলে।
কার বুদ্ধিতে আমরা আমেরিকার পণ্যের ওপর ৭৪ পারসেন্ট শুল্ক ধার্য করেছিলাম। ঠেলার নাম বাবাজি। এখন আমরা শুল্ক কমাতে প্রস্তুত। মনে রাখতে হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট একজন সফল ব্যবসায়ী বটে এবং তাঁর পরামর্শদাতা এলন মাস্ক শুধু সফল ব্যবসায়ী নন, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। এতদিন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশকে অপরাপর দেশ ছিঁড়ে খেয়েছে, এখন সময় এসেছে আমেরিকার নিজের দেশের দিকে নজর দিতে। আমেরিকায় যে কোনো পণ্যের ওপর হাত দাও সেটি হয় চীনের তৈরি নতুবা অন্য কোনো দেশের। আমেরিকায় প্রস্তুত খাদ্য ছাড়া সব পণ্যই বিদেশ থেকে আমদানি করা। আমেরিকানরা জেনারেল মোটরের তৈরি কোনো গাড়ি কিনবে না। অথচ যে একবার কেডিলাকে চড়েছে সে অন্য কোনো বিলাসবহুল গাড়ি কিনবে না। ঢাকা শহরে মার্সিডিজ বেনজ, বিএমডব্লিউ, অডির ছড়াছড়ি কিন্তু আমেরিকার তৈরি কোনো গাড়ি নেই। লজ্জার ব্যাপার। এক আমদানিকারক জিপ চেরোকি আমদানি করেছে কিন্তু অস্বাভাবিক শুল্কের দরুন বিক্রয় করতে পারছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমাদের দেশের বিজ্ঞ থিংক ট্যাংকগুলো দেশের অর্থনীতির সিম্পটমগুলো কেবল পরিবেশন করে। রোগের বিপরীতে কোনো প্রেসক্রিপশন দেয় না। পিসিডি আমাদের ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র প্রধান উপদেষ্টার কাছে দাখিল করেছে। আমার ধারণা কেবল মুখবন্ধটুকু পড়া হয়েছে। বাকি ৩৯৯ পৃষ্ঠা ধুলা আহরণ করছে।
আমাদের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে অভিজ্ঞ কনসালট্যান্ট। প্রতিটি মন্ত্রণালয় এবং অধীনস্থ সংস্থাগুলোয় নিয়োগ দিতে হবে অভিজ্ঞ কনসালট্যান্ট। যারা দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সঠিক নির্দেশনা দেবে কীভাবে দুর্বলতা কাটিয়ে সক্ষমতা বাড়ানো যায়, ব্যয় সংকোচন করা যায় এবং ক্ষেত্র বিশেষে লাভ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, আমার ছেলে (কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ) আমেরিকার বস্টন শহরের মেয়র অফিসে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করে, তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে ৫০ ভাগ ব্যয় হ্রাস করেছে। যে ৫০ ভাগ সাশ্রয় হয়েছে, তা বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে ব্যয় করতে পেরেছে। আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছেন। যদি জুলাই বিল্পব আর মাস দুই পেছনে সংঘটিত হতো, তত দিনে হাসিনা সরকার এক বিলিয়ন ডলার ঘুষ নিয়ে ১০টি এয়ারবাস ক্রয়ের চুক্তি করে ফেলত এবং ফলে বর্তমান আমেরিকা প্রশাসন বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিত।
আর একটি বিষয়, আমাদের বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা অর্থনীতিতে সর্বনাশ হওয়ার পর পোস্টমর্টেমপূর্বক ব্যয়বহুল সেমিনার করে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইংরেজি বাংলায় নিবন্ধ প্রকাশ করেন। কিন্তু অর্থনীতিতে সর্বনাশ এক দিন, এক মাস কিংবা এক বছরে সংঘটিত হয় না। এতদিন তারা মুখ বন্ধ করে থেকেছিলেন কেন? বলা হচ্ছে, গত ১৬ বছরে ৪ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এত বছর পর আমরা এটা উপলব্ধি করতে পারলাম। সর্বকালের মহাবিজ্ঞ খনার বচন উদ্ধৃত করে বলতে হয়, ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।’
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য