‘সন্ধ্যার দিকে বাতাস জোরদার হতে হতে রাত ১০টায় ঝোড়ো হয়ে যায়। মধ্যরাতে ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নেয়। ঘণ্টায় একশ মাইল বেগে বইতে থাকে। প্রবল বাতাসের ঝাপটা তার সঙ্গে তীব্র বৃষ্টিপাত। ঝড়ের ছোবলে বিনষ্ট হলো ফসলের খেত, উৎপাটিত বৃক্ষরাজি, বিধ্বস্ত পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর। ঝড়ে প্রাণ হারায় অর্ধশতাধিক মানুষ, আহত শতাধিক। গত শনিবার দিকশূন্যপুর গ্রামে ঘূর্ণিঝড়ের এই ঘটনাটি ঘটেছে।’
এ কথাগুলো প্রার্থী বাছাই পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের অংশ। প্রার্থীকে বলা হয়েছিল- ‘বাক্যগুলো সংক্ষিপ্ত সংবাদ আকারে লিখুন।’ অধিকাংশ প্রার্থী মনে মনে হেসেছেন। প্রশ্নপত্রে যা রয়েছে, তা তো সংক্ষিপ্তই। এটাকে আবার সংক্ষিপ্ত করতে বলাটা হয় মূর্খামি, নয়তো ফাজলামি!
এক প্রার্থী লিখলেন, আরও বাক্য যোগ কর বললে খুশি হতাম। কিন্তু ইঙ্গিতে বলা হয়েছে, কিছু বাক্য বিয়োগ কর। চাকরির অভাবে ধুঁকছি বলে আমাকে যোগ-বিয়োগের ধাঁধায় ফেলে দেবেন? স্যরি! ওরকম নোংরা কাজে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারলাম না স্যার।
ওই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন দৈনিক ‘বাংলার মুখ’-এর বার্তা সম্পাদক শহীদুল হক। পত্রিকাটি এখন আর নেই, শহীদ ভাইও বেঁচে নেই। সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে যাঁরা সাংবাদিকতা পেশায় ঢুকেছেন তাঁদের অনেককেই খুব যত্নের সঙ্গে কাজ শিখিয়েছেন তিনি। নীতিনিষ্ঠ, কড়ামেজাজি, ইংরেজি সাহিত্যে এমএ, চাঁদপুরের সন্তান শহীদুল হক আমারও অন্যতম কর্মগুরু।
নবিশিকালে ভয়ার্ত আমরা তাঁর কাছ থেকে শত হাত দূরত্বে থাকতে চাইতাম। দিনে দিনে যখন বুঝতে পারি যে ‘এ ধরনের শুদ্ধাচারীর সঙ্গ পাওয়া পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার’ তত দিনে শহীদ ভাই মুখময় সাদা-কালো দাড়ি আর কপালে সেজদাজনিত দাগবাহী অতিশয় মিতবাক এক পুরুষ হয়ে গেছেন। জরাগ্রস্ত শরীর তাঁর। তবু স্নেহভাজনদের দেখলে চেহারায় ফুটে ওঠে প্রসন্নতার দ্যুতি।
অহংবিদ্ধ গাম্ভীর্য প্রদর্শক ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা ‘আমার মতো বিশেষত্ব নেই কাহারও এই ভবে’ প্রমাণের পর্যায়ে আনন্দ-বেদনা সংকট-সম্পদে নির্বিকার একটা ভঙ্গি ফুটিয়ে রাখে তাদের একটুও সহ্য করতেন না শহীদুল হক। দুঃখ-শোকে যারা কাঁদে না তাদের তিনি চালকুমড়া দিয়ে বানানো, ঝোলা গুড়ে চুবানো পচা কাঁঠালের আমসত্ত্ব বলে আখ্যায়িত করে বলতেন, ওদের রোদনধ্বনি কি ঘেউ ঘেউ সদৃশ? বদখত আওয়াজ আড়াল করার কৌশল নিয়েছে? তা যদি করে থাকে তাতে অবশ্য কোনো অন্যায় তিনি দেখেন না।
এই কনসেশন কেন দিচ্ছেন? শহীদুল হক বলেন, ‘দেবই। আমি তো বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো গোঁয়ার না।’ আমাদের চিন্তা পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্য তিনি বঙ্কিমমানস তুলে ধরেছিলেন, যা বর্ণনার মাধ্যমে আজকের এ নিবন্ধের ইতি ঘটানো হবে।
প্রার্থী যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যে তিনজনকে শহীদুল হক সাব-এডিটর পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন তাঁরা সংক্ষিপ্ত সংবাদ আকারে লিখেছেন, ‘দিকশূন্যপুরে একশ মাইল বেগে বয়ে যাওয়া ঝড়ে অর্ধশতাধিক নিহত ও শতাধিক আহত হয়।’ তিনি বলতেন : শুধু সংবাদ গঠনের বেলায় নয়, জীবনের প্রতিটি ধাপে, সমাজের প্রতিটি স্তরে যোগ আর বিয়োগের গান গাইতে হয়। আঁকতে হয় যোগ-বিয়োগের ছবিও। সংযোজন-বিয়োজনের ধারাস্রোতই এগিয়ে নিচ্ছে সভ্যতা।
কলকব্জার সুরক্ষা : সভ্যতা, ধারাস্রোত, সংযোজন-বিয়োজনের গুরুত্ব বোঝাতে গেলে ‘ব্যস্ত আছি, অন্য সময় শোনা যাবে’ বলে যারা কেটে পড়তে চান, আমাদের মহল্লার ইরফান আওরঙ্গ সে কিসিমের নন। তিনি কোনো সময়েই শুনবেন না। তিনি ‘যোগ’ করতে যতটা আগ্রহী ‘বিয়োগ’ করতে বললে ততটাই আগ্রাসী। শ্রোতাকে ভীষণ আনাড়ি জ্ঞান করা আওরঙ্গের ঐতিহাসিক অভ্যাস। ভাষণ শুরু করা জানেন, থামতে জানেন না। আমরা ইরফান আওরঙ্গকে এড়িয়ে চলি। তবু হঠাৎ হঠাৎ তাঁর কবলে পড়ি। তখন মনে মনে বলি, পরওয়ার দিগার রাব্বুল আলামিন! এই কথকের সঙ্গে পাঁচ বছরে একবার মিলিত হওয়ার বন্দোবস্ত করতে কেউ কি তোমারে মানা করেছে?
সাক্ষাৎ ঘটে যাওয়ার দুঃখে কলিজা ফাটিয়া যায়, তবু হাস্যবদনে বলতে হয়, আরে আওরঙ্গ সাহেব! কত দিন পর দেখা। আছেন কেমন? তিনি বলেন, আর কয়েন না ভায়া। ঝামেলায় পড়ে গেছলাম। ওই যে আমার চাচাতো শালা ইস্রাফিল, শুয়োরের বাচ্চা! (কথাটার মানে দাঁড়ায়, তিনি শুয়োর বংশে বিবাহ করেছেন)। ভাড়া নিয়ে তর্ক লাগায়ে দিছিল এক ইজিবাইকচালকের লগে। তা মন চাইলে দিনভর তর্ক কর। কার বাপের গরজ পড়ছে তোরে থামায়। বাট, থিংস টুক আ সিরিয়াস টার্ন। তর্ক করতে করতে বাস্টার্ড ইস্রাফিলটা হয়া গেল মাসলম্যান। ঘুসি মেরে ইজিবাইকঅলার নাক ফাটিয়ে দিছে। ব্যস গরিবের নাক ফাটানোর বিরুদ্ধে শুরু হয়া গেল মব মবিলাইজেশন!
উন্মত্ত জনতার মধ্য থেকে মাস্তানমার্কা একটা মর্দ এসে কানে কানে বলেছিল, ‘স্যার, আমগোরে পাঁচ হাজার টাকা দেন কেস ফিনিশ কইরা দিতাছি।’ সঙ্গে সঙ্গে ইস্রাফিল কনুইয়ের গুঁতোয় ওই মর্দকে ন্যূনপক্ষে সাত ফুট দূরে কীভাবে নিক্ষেপ করেছিল তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিলেন ইরফান আওরঙ্গ। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে এবং ইস্রাফিলকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। তাকে থানায় নেওয়া, কোর্টে চালান দেওয়া, জামিনমুক্ত করার জন্য মহাচতুর এক লইয়ারের শরণ নেওয়া ইত্যাদির পেছনে যে কঠোর মেহনত করেছেন তার বিশদ ৪৫ মিনিট ধরে শোনালেন আওরঙ্গ। আমরা তাঁর পরিচিত তিন শ্রোতা। শুনতে শুনতে আমাদের প্রত্যেকের মাথার ভিতর তিন লাখ পোকা কিলবিল করতে থাকে।
যন্ত্রণায় অস্থির শ্রোতাদের একজন কথার মোড় ঘোরানোর মতলবে বললেন, শুনলাম রিজাইন করেছেন। কেন, কী হয়েছিল? আওরঙ্গ বলেন, আর কয়েন না ভায়া। কোম্পানির নতুন সিইওর যন্ত্রণায় জীবনটা কয়লা হয়া গেছিল। ব্যাডায় কোনো একটা ডিরেকশন দেওনের সুমায় এমন বকবক করে! দুই মিনিটে যেটা বলন যায়, সেটা দেড়-দুই ঘণ্টা ধরে বলে। তার বকবকানিতে আমার মাথার কলকব্জা সব বিকল হওনের দশা। বলতে পারেন ওই কলকব্জার সিকিউরিটির স্বার্থেই দিলাম রিজাইন কইরা।
চলমান ট্র্যাডিশন : আমার সঙ্গে একই দিনে পেশাজীবনে প্রবেশ করে সাতক্ষীরার সন্তান প্রয়াত সুনীল ব্যানার্জি। উচ্চতায় সে আমার প্রায় দ্বিগুণ। ওর আর আমার নিবিড় সখ্যকে অনেকে ‘বকপক্ষী আর চড়ুইয়ের মাখামাখি’ বলে মজা পেত। মজা নেওয়াদের দোষ নেই। লম্বুর সঙ্গে তো লম্বুর দোস্তিই প্রত্যাশিত। যেমন প্রত্যাশিত ‘বকবকানিযন্ত্র’ আওরঙ্গের সঙ্গে আরেক বকবকানিযন্ত্রের সখ্য। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার! আওরঙ্গের প্রাণসখা সফদর শেখ অতি অল্পকথার মানুষ। তিনি চোখ দিয়ে হাসেন, মুখ দিয়ে কথার সঙ্গে কথা যোগ করেন। সবই অর্থবহ। ‘দয়াময় আল্লাহ! আপনি নারীকে সৃষ্টি করেন। যৌবনে ওরা কত সুন্দরী। কালক্রমে তারা বউ হয়। বউ হয়ে কেন তারা নানাভাবে স্বামীর জীবন অস্বস্তিকর করে তোলে। প্রভু! তুমি স্বামীদের জীবনে শান্তি দাও।’-সফদর শেখ জানান, এক স্বামী এরকম প্রার্থনা করছিল। প্রার্থনার জবাবে প্রভু বলেন, ‘সুন্দরী নির্মাণ করেছি আমি। ওদের বউ বানিয়েছে পুরুষ। যার যা কর্মফল, তাকে তো ভোগ করতেই হবে।’
মতলববাজ এক আত্মীয় সফদর শেখের নরম হৃদয়ের সুযোগ নেওয়াটা অভ্যাসে পরিণত করেছেন। ভদ্রলোক বানিয়ে বানিয়ে করুণ কাহিনি শুনিয়ে টাকা শিকার করতেন। দেরিতে হলেও বিষয়টি টের পেলেন সফদর। আত্মীয়টি একবার এসে সাম্প্রতিক টর্নেডোয় তাঁর ঘরবাড়ি ধসে যাওয়া আর জমির ফসলহানির ঘটনা মিনিট দশেক ধরে বর্ণনাপূর্বক আর্থিক অনুদান চাইলেন। সফদর শেখ বললেন, ‘দিবার পারুম না।’ এরপর যোগ করেন, ‘একটু প্রবলেমে আছি।’
কথাশিল্পী তারাপদ রায়ও একই কায়দায় সামান্য কথা যোগ করে পুরোনো গল্পের ভিতর নতুন রস ঢুকিয়ে দিতেন। আমরা তো অনেকেই সেই কাহিনি জানি, যেখানে রাজা রওনা দিচ্ছিলেন হরিণ শিকারে। ধোপা বলল, যাবেন না হুজুর। ঝড় হবে আজ। পথে কষ্ট পাবেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় ধোপার পরামর্শ অগ্রাহ্য হলো। কিন্তু জঙ্গলে ঢুকেই ঝড়ের কবলে পড়লেন রাজা। বুঝলেন, ধোপাটা জ্ঞানী। আগেভাগে সব বলে দেয়। তিনি ধোপাকে বলেন, তোকে আবহাওয়ামন্ত্রী করলাম। ধোপা বলে, আমার কোনো কেরামতি নেই মহারাজ। যেদিন ঝড় হয় সেদিন খুব ভোর থেকেই আমার গাধাটার লেজ খাড়া হয়ে থাকে। এটা দেখেই আমি ভবিষ্যদ্বাণী করি। রাজা বলেন, ‘অ! ঠিক আছে। তা হলে তোর গাধাকেই মন্ত্রী নিযুক্ত করলাম।’ এ কাহিনির সঙ্গে তারাপদ রায় যোগ করলেন : সেই যে উচ্চ পদে গাধারা বসতে শুরু করল সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে।
চোরের গুরুত্ব : দুঃখ-সংকটে যারা কান্নাকাটি করেন তাদের সম্পর্কে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের মনোভঙ্গিকে ‘গোয়ার্তুমি’ মনে করতেন শহীদুল হক। কেন? কারণ বঙ্কিমচন্দ্র বলে গেছেন, ‘যে কখনো রোদন করে নাই, সে মনুষ্য মধ্যে অধম। তাহাকে কখনো বিশ্বাস করিও না। নিশ্চিত জানিও সে পৃথিবীর সুখ কখনো ভোগ করে নাই, এর সুখ কখনো তার সহ্য হয় না। এমন হইতে পারে যে কোনো আত্মচিত্ত বিজয়ী মহাত্মা বিনা বাষ্পমোচনে গুরুতর মনঃপীড়া সহ্য করিতেছেন এবং বিন্দু অশ্রুজলে পৃথিবী সিক্ত না করিয়া থাকেন তবে চিত্তজয়ী মহাত্মা হইলেও হইতে পারেন, কিন্তু আমি বরং চোরের সহিত প্রণয় করিব তথাপি তাঁহার সঙ্গে নহে।’
লেখক : সাংবাদিক