বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফেরদৌস-গাজী নূরে বিতর্কের ঝড় ভারতে

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

ফেরদৌস-গাজী নূরে বিতর্কের ঝড় ভারতে

বাংলাদেশের দুই অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ ও গাজী আবদুল নূরকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের রাজনীতি এখন সরগরম। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- এ দুই বিদেশি নাগরিক ভারতের ভিসা আইন লঙ্ঘন করে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা অবিলম্বে ফেরদৌস ও গাজী নূরকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন।

গাজী নূর বলেছেন, তিনি কোনো প্রচারণায় অংশ নেননি। তিনি বলেন, আমি অরাজনৈতিক মানুষ। তৃণমূল নেতা মদন মিত্রের গাড়িতে উঠেছিলাম, তাই আমাকে ভুল বোঝা হয়েছে। এ ছাড়া মদনদা তো লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীও নন।’

টিভি সিরিয়াল ‘রানী রাসমনি’তে রাজা রাজচন্দ্রের চরিত্রে অভিনয় করায় পশ্চিমবঙ্গে গাজী নূরের জনপ্রিয়তা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি দমদম আসনে তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায়ের প্রচারণায় শামিল হয়েছেন।

‘মমতা পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীকেও আনবেন?’ বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দিলীপ ঘোষ ১৪ এপ্রিল রায়গঞ্জ (পশ্চিম দিনাজপুর) আসনের তৃণমূল প্রার্থী কানাইয়ালাল আগরওয়ালের পক্ষে প্রচারণা চালানোর তীব্র সমালোচনা করে বলেন, মমতা ব্যানার্জি তো দেখা যায়, তৃণমূলের হয়ে প্রচারণায় চালানোর জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকেও আনতে পারেন।

দুই অভিনেতার-২

বিরোধী দলগুলো বলছে, ভারতের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে তৃণমূলের এ ধরনের কার্যকলাপ কার্যত নজিরবিহীন। এ ঘটনার মাধ্যমে মমতা ব্যনার্জির দলটি বৈধতা, ভিসা আইন ও নীতি, রুপালি পর্দার সেলিব্রেটিদের গ্রেফতারিসহ একাধিক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। এমনকি গোটা ঘটনার সঙ্গে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী জড়িত কিনা, তা উদ্ঘাটনে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএকে দিয়ে তদন্তের দাবিও তোলে তারা।

একজন বিদেশি নাগরিক কীভাবে ভারতে ভোটের প্রচারে শামিল হতে পারেন এ প্রশ্ন তুলে ফেরদৌস ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজ্যের প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা আরিজ আফতাবের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগ জানায় বিজেপি। বিজেপির তরফে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করার পরই রাজ্যটির অতিরিক্ত প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা সঞ্জয় বসু জানিয়েছেন, ‘রুল বুকে এ সম্পর্কিত কোনো নির্দেশনামা নেই, তবে কেউ অভিযোগ জানালে আমরা অবশ্যই তা খতিয়ে দেখব।’

এটা নজিরবিহীন রাহুল সিনহা : বিজেপি নেতা রাহুল সিনহার অভিযোগ, ‘ভারতের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একজন বিদেশি নাগরিককে নিয়ে এসে তৃণমূল যেভাবে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে, তাতে তারা নির্বাচনে লড়াই করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। মমতা ব্যানার্জির উচিত তার সব প্রার্থীকে তুলে নেওয়া। তিনি এ বাংলার সুনাম কলঙ্কিত করেছেন। দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন ঘটনা।’

কালো তালিকায় ফেরদৌস : কলকতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন ফেরদৌসকে ফোন করে জানতে চেয়েছে- কেন তিনি প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন? জবাবে ফেরদৌস বলেন, শুটিংয়ের কাজে এ রাজ্যে তার ইউনিট রয়েছে। এখানকার অনেক অভিনেতাই প্রচারণায় অংশ নিয়ে থাকেন। তাই তিনিও নিয়েছিলেন।

সূত্র জানায়, উপ-হাইকমিশনে এক কর্মকর্তা ফেরদৌসকে বলেন, আপনি বিদেশি নাগরিক হয়ে প্রচারণায় অংশ নিয়ে অন্যায় করেছেন। নির্বাচন পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত সব শ্যুটিংয়ের কাজ বন্ধ রেখে আপনি দ্রুত দেশে ফিরে যান।

মঙ্গলবার দিনভর ফেরদৌসকে নিয়ে টানাপোড়েনের পর ভিসানীতি লঙ্ঘন করার অভিযোগে সন্ধ্যায় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে ফিরদৌসকে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করে তার বিজনেস ভিসা বাতিল করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে নোটিস জারি করে তাকে দ্রুত ভারত ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় নির্বাচন কমিশনের অভিমত, বিদেশি নাগরিকদের ভারতের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের বিষয়ে কোনো গাইডলাইন নেই। বিজেপির তরফে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করার পরই রাজ্যটির অতিরিক্ত প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা সঞ্জয় বসু জানিয়েছেন ‘রুল বুকে এ সম্পর্কিত কোনো নির্দেশনামা নেই, তবে কেউ অভিযোগ জানালে আমরা অবশ্যই তা খতিয়ে দেখব।’

যে তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে ফিরদৌস প্রচারণায় নেমেছিলেন সেই কানাইয়ালাল আগরওয়ালও দায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে জানান, ‘আমার কাছে এরকম (ফেরদৌস আমার হয়ে প্রচারণায় ছিলেন) কোনো তথ্য নেই। মমতা ব্যানার্জি ও শুভেন্দু অধিকারী- কেবলমাত্র এরা দ্জুনই আমার স্টার ক্যাম্পেনারস। এখন পর্যন্ত আমি মমতার দুটি র‌্যালিতে ছিলাম এবং শুভেন্দুর একটি র‌্যালিতে উপস্থিত ছিলাম।

তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতা মদন মিত্র বলেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে আমাদের (ভারত) অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তাই আমি মনে করি না যে ফেরদৌসকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আমরা কোনো ভুল করেছি। আমরা রাষ্ট্রবিরোধী, অবৈধ বা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন সম্পর্কিত কোনো কাজ করব না। যদি নির্বাচন কমিশন আমাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়, তবে বিজেপির বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নিতে হবে- কেন না নির্বাচনের সময় রামনবমীর মিছিলে তারা অস্ত্র, তরবারি হাতে শক্তি প্রদর্শন করেছে।’

আর মদন মিত্র সাফাই দিয়ে বলেন, ‘যে রাজা রাজচন্দ্রের অভিনয় করেন, সে তৃণমূলের পক্ষে একটা কথাও প্রচার করেননি। ওঁ আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। আমার কাছে আসার পর আমি তাকে আমার ফ্ল্যাক্স থেকে এক কাপ চা দিই ও এক গ্লাস পানি দিই। এরপর আমার সঙ্গে কথা বলে সে চলে যায়। তা ছাড়াও আমি নিজে প্রার্থী নই এবং প্রচারণা নিয়ে নূর একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি।’

বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, বিষয়টি ভিসা আইন লঙ্ঘনের নামান্তর। কারণ, যারা বিজনেস ভিসা নিয়ে ভারতে এসেছেন তারা কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘এটা মোটেই ছোট বিষয় নয়। এ ধরনের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে পারে।’

বুধবার বিকালে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বারাসতে জেলাশাসন কার্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে এসে বাংলাদেশিদের দিয়ে প্রচারণা বিষয়ে মনোজ তিওয়ারি বলেন, ‘এ ঘটনাতেই পরিষ্কার যে তৃণমূলের সঙ্গে দেশবিরোধীদের হাত রয়েছে। এবারের নির্বাচনে বাইরের দেশের লোক এনে প্রচারণা করার উদ্দেশ্য হলো ‘ডাল মে বহত কুচ কালা হ্যায়’। এ রাজ্যের মানুষ নরেন্দ্র মোদিকে যেভাবে সমর্থন দিতে যাচ্ছে তাতে মমতা ব্যানার্জি নিজেও জানেন না যে তিনি রাজ্যের যে অবস্থা করেছে তার কী ফল পান।’

রাজ্যের শাসক দলের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে ছাড়েনি জাতীয় কংগ্রেসও। দলের সাংসদ ও সিনিয়র নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমি নির্বাচন কমিশনকে বলেছি, যে দুই বাংলাদেশি অভিনেতা, রায়গঞ্জের তৃণমূল প্রার্থী এবং যারা যারা ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের সবাইকে এখনি গ্রেফতার করা এবং তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।’ কংগ্রেস নেতা ও খ্যাতনামা আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ অবশ্য বলছেন, ভারতীয় নির্বাচনে কোনো বিদেশি নাগরিক অংশ নিতে পারবেন না এমন কোনো সাধারণ নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত কোনো নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা তা সম্পূর্ণ       পৃথক বিষয়।

নির্বাচনী প্রচারণায় ফেরদৌস, অঙ্কুশ, পায়েল ও রাজনৈতিক কর্মীরা

সর্বশেষ খবর