ঈদ শেষ, তবুও ঈদের নাটক ও টেলিফিল্মকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা থামেনি। সেগুলো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চলছে নানারকম ইতিবাচক-নেতিবাচক মন্তব্য। টেলিভিশনে প্রচারের পর এখন ইউটিউবে দেখা যায় ঈদে প্রচারিত সব নাটক-টেলিফিল্ম। যদিও এবার ঈদে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা দেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিল দর্শক। তবুও বরাবরের মতো এবারও মাত্রাতিরিক্ত বিজ্ঞাপন ও একঘেয়েমি
নাটক দর্শকবিমুখতার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। টিভি ও ইউটিউবে প্রচারিত এ সময়ের নাটক ও টেলিফিল্ম নিয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল
প্রতিটি নাটকে হাসির প্রতিযোগিতা চলছিল
---- হানিফ সংকেত
এবারের ইত্যাদি যারা দেখেছেন তারা বলতে পারবেন, এবারের ইত্যাদিতে আমরা সিনিয়র শিল্পীদের ক্ষোভের একটি পার্ট রেখেছিলাম। সেখানে আমরা দেখাতে চেয়েছি, এখনকার নাটকে মা, বাবা, ভাই, বোন, মামা, খালু, দুলাভাই- এই চরিত্রগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমাদের নাটকে যে একটি পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল, তা এখন বিলীন হয়ে গেছে। ঈদ মানে আনন্দ আর এই আনন্দের মধ্যে মা, বাবা, ভাই, বোন, মামা, খালু, দুলাভাই থাকবে না- তা কি করে হয়! আর এবারের ঈদের নাটক দেখে আমার মনে হয়েছে, প্রতিটি নাটকে কেমন যেন একটা হাসির প্রতিযোগিতা চলছিল। মানুষকে জোর করে হাসানোর একটা প্রবণতা ছিল প্রায় সব নাটকে। এছাড়া নাটকের গল্প ও চরিত্রগুলো ছিল প্রায় একই রকম। চরিত্রে কোনো বৈচিত্র্য নেই। সব মিলিয়ে একটি অভিভাবকহীন নাটকের পরিবেশ ছিল এবারের ঈদে। তবে এরই মধ্য থেকে দুই-একটি নাটক ভালো হয়েছে। তবে অনেক নাটকের মধ্যে দুই-একটি ভালো নাটক যথেষ্ট নয়।
কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করা হয়
------ কুমার বিশ্বজিৎ
তেমন করে দেখার সময় হয় না! তবে ঈদে একটি নাটক দেখেছি। মোস্তফা কামাল রাজের ‘ক্রেজি লাভার’। নিশো ও তানজিন তিশা ভালো অভিনয় করেছেন। নাটকে কিছু মেসেজ ছিল, ভালো লেগেছে। দেখা যায়, একটি ছেলে একটি মেয়ের প্রেমে অন্ধ হয়ে যায়; ভালোবাসার কারণে মা-বাবার ভালোবাসাকেও ভুলে যায়। নাটকটি অবশ্যই শিক্ষণীয়! এ বিষয়টি প্রতিটি প্রেমিক-প্রেমিকার জীবনে ঘটে থাকে। নাটকটির মধ্যে ফান-ইমোশনও ছিল। তবে টেলিভিশনে নাটক দেখার কথা বলতে গেলে, তেমন করে দেখার ধৈর্য নেই। এমনিতেই অতিরিক্ত ও দীর্ঘ বিজ্ঞাপন, তার ওপর তুচ্ছ বিষয় নিয়ে নাটক! আর কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করা হয়।
নাটকে নেই পারিবারিক বন্ধন। সেই যৌথ পরিবারের দাদা-দাদী, মা-বাবা আর ভাই-বোন নিয়ে নাটক তৈরি হচ্ছে না। দুই-তিনজনকে নিয়েই একটা নাটক বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। একই চেহারা ঘুরেফিরে বারবার দেখানো যাচ্ছে। আমি তো মনে করি, কিছু মেসেজ থাকতে হবে, যা দেখে কিছু হলেও কেউ শিখতে পারবে, তাই না?
নাটকের সংখ্যা বেড়েছে, মান বাড়েনি
------ অনুপম হায়াৎ
নাটক এখন আর তেমন করে মনোযোগ আকর্ষণ করে না। আগের নাটকের মতো এখনকার নাটকে তেমন পরিশীলিত গল্প-নির্মাণ নেই। একটা সময় মোস্তাফিজুর রহমান, বরকতউল্লাহ কি সুন্দর সুন্দর নাটক বানিয়েছেন! হুমায়ূন আহমেদের ‘নিমফুল’-এ আসাদুজ্জামান নূরের কি দুর্দান্ত অভিনয়; তা এখনকার নাটকে ভাবাই যায় না। এখনকার নাটক ছ্যাবলামোতে ভরা। গল্পের বিষয়বস্তু হালকা, গভীরতা নেই। রোমান্টিসিজমে টানে না, যেন জোর করে প্রেম করা হচ্ছে। গল্পে-নির্মাণে নেই বৈচিত্র্য, নেই জীবনবোধ। আর পোশাকে শালীনতার অভাব সুস্পষ্ট; দেশের সংস্কৃতি ও সমাজ পরিপন্থী। নাটকের নাম মনে থাকে না। ‘এইসব দিনরাত্রী’, ‘অয়োময়’ কিংবা ‘বহুব্রীহি’ এখনো মনে দাগ কাটে। ঋত্বিক ঘটক অযান্ত্রিক ছবিটি বানাতে গিয়ে ১২ বছর ভেবেছিলেন! পত্রিকায় পড়লাম, তানজিন তিশা ঈদে ৩০টি নাটক করেছেন। তো একজন যদি এত নাটকে কাজ করেন তাহলে তিনি অভিনয়ের দিকে কীভাবে মনোযোগ দেবেন? আসলে, নাটকের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু মান বাড়েনি।
নাটকে নেই পারিবারিক আবহ
------ শহীদুল্লাহ ফরায়জী
এখন টেলিভিশনে নাটক দেখা হয় না; ইউটিউবে দেখি। আমার রুমে টেলিভিশন নেই। তবে গত কয়েক মাসে ইউটিউবে কয়েকশ নাটক দেখেছি। যদিও ইউটিউবে নাটকের মাঝে বিজ্ঞাপন চলে আসে যা আগে ছিল না। তবে বিজ্ঞাপনগুলো কিন্তু বাড়াবাড়ি মনে হয় না। আমি ইউটিউবে প্রচুর নাটক দেখি, গান শুনি ও ছবিও দেখি। ঘুমের আগে নাটক দেখি ও গান শুনি। গত একমাসে অনেক নাটক দেখেছি। এর মধ্যে কিছু নাটক ভালো লেগেছে। তবে এটা সত্যি, আমাদের এখনকার নাটকে তেমন করে পারিবারিক বন্ধন দেখানো হয় না। নাটকে বাবা থাকেন মা নেই, আবার মা থাকেন বাবা নেই। ‘আই লাভ ইউ’ জাতীয় নাটকের ছড়াছড়ি। আর দেখা যায় মোবাইলকেন্দ্রিক ভালোবাসা। পূবাইল বা একই লোকেশন ও একই মুখ বারবার। এটি বিরক্তিকর। মাঝে মাঝে কিছু নাটকে বৈচিত্র্য থাকে। শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। তখন হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত হয়। আসলে সব সময় সব কিছু পাওয়া যায় না। তবে জীবনমুখী ও ভালো গল্পের নাটক বেশি বেশি নির্মিত হোক- এটাই চাওয়া।