বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

এখনকার ছবি দর্শক দেখছে না কেন

আলাউদ্দীন মাজিদ

এখনকার ছবি দর্শক দেখছে না কেন

দর্শক পরিপূর্ণ এমন সিনেমা হল এখন শুধুই স্বপ্ন

১৯৫৬ সালে ঢাকায় প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মিত হওয়ার পর থেকে কমপক্ষে নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত ছবির গল্প মন্ত্রমুগ্ধের মতো দর্শকদের সিনেমা হলে টেনে নিয়ে যেত। জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের ছবিতে নিজের ও নিজের পারিপার্শ্বিকতার চিত্র দেখতে পেয়ে আপ্লুত দর্শক হেসে-কেঁদে সিনেমা হল থেকে বের হতো। একটি ছবি বারবার দেখত। এ দেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র প্রয়াত আবদুল জব্বারের ‘মুখ ও মুখোশ’। একজন ডাকাতের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলেও এটি ছিল পারিবারিক গল্পের ছবি। একটি সমৃদ্ধ ও সময়োপযোগী গল্প পেয়ে দর্শক সাদরে গ্রহণ করে ছবিটি। এই ধারাবাহিকতায় নির্মিত হতে থাকে আকাশ আর মাটি, মাটির পাহাড়, এ দেশ তোমার আমার, রাজধানীর বুকে, হারানো দিন, কখনও আসিনি, সুতরাং, বেহুলা, মনের মতো বউ, নয়নতারা, রূপবান, আলোর মিছিল, ওরা ১১ জন, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আবার তোরা মানুষ হ, নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, ভাত দে, সারেং বৌ, অবুঝ মন, ময়নামতি, ছুটির ঘণ্টা, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী, অশিক্ষিত, অশ্রু দিয়ে লেখা, স্বরলিপি, হাজার বছর ধরে, হাছন রাজা, নবাব সিরাজদ্দৌলা, জীবন থেকে নেয়া, সাতভাই চম্পা, মনপুরা প্রভৃতি। নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে এই চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। ওই সময় থেকে দেশীয় চলচ্চিত্রের গল্প দর্শকদের আর কাছে টানতে পারছে না। ফলে সিনেমা হল হয়ে পড়ে দর্শকশূন্য। কিন্তু কেন? সেই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন কয়েকজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব।

 

গল্পকারের আকাল চলছে : অনুপম হায়াৎ

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায় চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। চলচ্চিত্রে ফুটে উঠবে যাপিত জীবনের পারিপার্শি^কতা। যা দেখে দর্শক তার আশপাশের চিত্র খুঁজে পেয়ে মুগ্ধ, আবেগপ্রবণ বা আনন্দিত হবেন। এ জন্য সমসাময়িক জীবনের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। একসময় সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ জামান চৌধুরী, হুমায়ূন আহমেদ, আশীষ কুমার লোহ, এ টি এম শামসুজ্জামান, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, এস এম পারভেজ, আবদুল জব্বার খান, আমজাদ হোসেনের মতো গল্পকারদের গল্পে কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মিত হতো। এখন গল্পকারের আকাল চলছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখতে পাই সেখানেও বাণিজ্যিক এবং মৌলিক, উভয় ধারার সমৃদ্ধ সময়োপযোগী গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। যা ঢাকাই চলচ্চিত্রে নেই। মানে গল্প আর গল্পকারের সংকটে পড়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্র।

 

নকল আর অশ্লীলতাই দায়ী : গাজী মাজহারুল আনোয়ার

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার আক্ষেপ করে বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগের পর দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে গল্প উধাও হয়ে গেছে। এর কারণ তখন এ দেশে ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখা শুরু হয়। কতিপয় নির্মাতা মৌলিক গল্প বিবর্জিত হিন্দি ছবির অনুকরণ আর নকল করতে গিয়ে গাঁজাখোড়ি ছবি নির্মাণ করে দর্শকদের মনে বাংলা ছবির প্রতি বিরক্তি উৎপাদন করে ছাড়ে। এ অবস্থা এখনো চলছে। এরপর শুরু হয় অশ্লীলতার দাপট। মাঝে মধ্যে দুই-একটি পারিবারিক গল্পের জীবনঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ হলেও পরিমাণে তা খুবই স্বল্প।

 

জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের অভাব : আজিজুর রহমান

একটি পরিবারের অনুষঙ্গ হলো- নানা, নানি, দাদা, দাদি, মা, বাবা, ভাই-বোন, প্রেমিক-প্রেমিকা, কাজের লোক, খলনায়ক, আত্মীয়স্বজনসহ পূর্ণাঙ্গ আবহ। এমন পরিপূর্ণ চরিত্র আর গল্পে নির্মিত হতো সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র। এ কারণেই পঞ্চাশ থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের ছিল স্বর্ণালি যুগ। পরবর্তীতে মৌলিক গল্পকারের কাছে নির্মাতারা না গিয়ে বিদেশি ছবি নকল করা এখনকার জীবনঘনিষ্ঠ গল্প থেকে সরে আসায় দর্শক এসব ছবি প্রত্যাখ্যান করা শুরু করে।

 

গল্পের সংকট চলছে : নার্গিস আক্তার

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা নার্গিস আক্তার বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ছবিতে গল্প খুঁজে পাওয়া যেত। আর তাতে নিজেদের জীবনের প্রতিফলন দেখতে দর্শক সিনেমা হলে ভিড় করত। এখনকার ছবিতে গল্পের সংকট। এখন ছবিতে আর নানা-নানি, দাদা-দাদি তো দূরে থাক মা-বাবাই থাকে না। এখন একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা আর একজন খলনায়ক আর আইটেম গান থাকলেই নাকি ছবি হয়ে যায়। এসব ছবি দর্শক কখনো গ্রহণ করবে না।

 

গল্পকার কোথায় : শাকিব খান

শাকিব খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো গল্প আর গল্পকার কোথায়? দুই বছরের বেশি সময় আগে একজন গল্পকারকে গল্প লিখতে দিয়েছিলাম। সম্মানী হিসেবে তাঁকে ১ লাখ টাকাও অগ্রিম দেওয়া হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই গল্প হাতে পাইনি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে নানা অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করেন। এ অবস্থায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে দেশীয় গল্পের অভাবে বাধ্য হয়ে বিদেশি গল্প বা ছবির অনুকরণ করতে হয়। না হলে এই শিল্প টিকবে কী করে? যাঁরা চলচ্চিত্র পেশার সঙ্গে যুক্ত তাঁদের তো বেকারত্বের হাত থেকে বাঁচতে হবে।

 

মেধাহীনতাই দায়ী : হাসিবুর রেজা কল্লোল

বর্তমান প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতা হাসিবুর রেজা কল্লোল বলেন, এখনকার ছবিতে গল্পই নেই। বর্তমানে মেধাহীন কিছু লোক যেসব ছবি নির্মাণ করছেন তাতে সময়োপযোগী প্রযুক্তি ও যাপিত জীবনের উপকরণ নেই। এসব গল্প ও জীবনবোধের ছায়া নেই বলে দর্শক তা দেখে না। মানে মেধাহীনতাই এর জন্য দায়ী। এ কারণে দর্শক সিনেমা হলে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

সর্বশেষ খবর