শুধু অঢেল অর্থ আর ক্ষমতা থাকলেই কোনো অনুষ্ঠান সফল হয় না, প্রয়োজন একটি নান্দনিক মন, দেশপ্রেম এবং দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি মমত্ববোধ। গত ২৩ মার্চ সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত দেশবরেণ্য উপস্থাপক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেতের একমাত্র পুত্র ফাগুনের বিয়েতে আগত বিশিষ্টজনদের মন্তব্যে সেটাই প্রকাশ পেয়েছে।
এদের মধ্যে অনেকেই এর আগে একাধিকবার সেনাকুঞ্জে বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছেন কিন্তু সেদিন যেন সেনাকুঞ্জ সেজেছিল ভিন্ন সাজে। অসাধারণ সেই দৃশ্যসজ্জা। যা ইতোপূর্বে এভাবে কেউ দেখেননি। অর্থের প্রদর্শনী ছিল না, ছিল রুচির বহিঃপ্রকাশ। দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা। দেশ-বিদেশের তথাকথিত তারকাদের কোনো উদ্দাম নৃত্য নয়, ছিল দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে দেশের সুর, মাটির সুর। ২৩ মার্চ সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠিত ফাগুনের এ বিয়েতে যেমন সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল, তেমনি বসেছিল তারকাদের মিলনমেলা। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক, টিভি চ্যানেলের মালিক, টেলিভিশনের বিভিন্ন সংগঠনের নেতা থেকে শুরু করে অভিনয়, সংগীত, উপস্থাপক, মডেল, পরিচালক, প্রযোজক, লেখক, সাংবাদিক প্রত্যেকটি অঙ্গনের তারকাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ফলে বিয়ের অনুষ্ঠান পরিণত হয়েছিল যেন তারকা ও সুধীজনের মিলনমেলায়। দেখে মনে হয়েছে এটি যেন সবার পারিবারিক অনুষ্ঠান। মুহুর্মুহু ক্যামেরা ক্লিক আর মোবাইলের সেলফিতেই যেন ব্যস্ত ছিলেন সবাই। সবার সঙ্গে ছবি তুলতে গিয়ে বর ফাগুন আর কনে রাওনাককে ক্লান্ত-অবসন্ন মনে হলেও মুখে ছিল হাসি। শুধু বর-কনেই নয়, বাবা হানিফ সংকেত, মা সানজিদা হানিফ এবং তাদের কন্যা সিনদিদা হানিফ বর্ণনা এত ভিড়ের মধ্যেও হাসিমুখে অতিথিদের অভ্যর্থনা এবং আপ্যায়ন করছিলেন। ইত্যাদির মতোই সুপরিকল্পিত ও ছন্দময় ছিল পুরো অনুষ্ঠান। হানিফ সংকেতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুমার বিশ্বজিৎকেও পরিবারের সদস্যদের মতো অতিথি অভ্যর্থনায় বন্ধুকে সহযোগিতায় বেশ তৎপর দেখা গেছে। অনেক তারকার ভিড়ে দুজন অতিথির উপস্থিতি অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনেককেই করেছে আবেগাপ্লুত। তারা হলেন শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের পরিবার এবং সুরকার আলী আকবর রুপুর পরিবার। বন্ধুরা না থাকলেও হানিফ সংকেত তার বন্ধুদের পরিবারকে ভোলেননি।
সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানস্থলে ঢোকার পথেই ছিল কয়েক ধাপের মুঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী তোড়ন। হলের ভিতরেই তৈরি করা হয়েছে মুঘল ঐতিহ্যের আলোকে যেন এক স্বর্ণালি রাজপ্রাসাদ। সেখানে বসেছিল যেন এক রাজপুত্র ও রাজকন্যা- বর-কনে বেশি ফাগুন ও রাওনাক। শুধু মঞ্চ সজ্জাই নয়, কনের পোশাকেও ছিল মুঘল ঐতিহ্যের ছাপ। হলের বাইরে ডানে ছিল দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের এক অসাধারণ সংগ্রহ এবং পরিবেশনা। আজকালকার বিয়ের অনুষ্ঠানে যা কখনই চোখে পড়ে না। একতারা, দোতারা, কর্নেট, সানাই, এস্রাজ, খমক, বেহালা, বাঁশি, হারমোনিয়ামসহ প্রায় ১৫টি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিলেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা যন্ত্রশিল্পীরা। আর সংগীত তারকা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ‘যদি থাকে নসিবে...’ খ্যাত বাউল শিল্পী চিশতি বাউল। সেনাকুঞ্জে ঢোকার মুখে এসব দেশীয় বাদ্যযন্ত্র আগত অতিথিদের যেমন চমকে দিয়েছে, তেমনি দেশীয় সংগীতের বাদন আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানের পুরনো ঐতিহ্যকেই মনে করিয়ে দিয়েছে।
দেশের মিডিয়া জগতে ফাগুন অডিও ভিশন একটি প্রাচীন ও নন্দিত নাম। আর এ প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়েছে হানিফ সংকেতের পুত্র ফাগুনের নামে। ফাগুনের এই বিয়েটি নানা কারণে আলোচিত, প্রশংসিত এবং অনুকরণীয়। কারণ শুধু বিয়ের অনুষ্ঠানই নয়, বিয়ের আমন্ত্রণপত্রটি যারা পেয়েছেন তারা এর শিল্পরূপ দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিয়ের আমন্ত্রণপত্রের খাম খুললেই বেরিয়ে আসে আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য নকশীকাঁথার চিত্র। যেখানে রয়েছে গ্রামীণ পথে পালকি যাত্রার ছবি। জানা যায়, প্রায় দেড়শো নকশিশিল্পী তাদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় সুঁচের ফোঁড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন গ্রামীণ পথে বর-কনের এই পালকি যাত্রার প্রতীকী চিত্র। কার্ডের ওপরে লেখা রয়েছে ফাগুনের বৌভাত। আর ভিতরে কার্ডের চারদিকে জামদানির পাড়ের মাঝখানে আমন্ত্রণ বাণী। অপূর্ব দেশীয় শিল্পের সমন্বয়ে এক অসাধারণ আমন্ত্রণপত্র। হানিফ সংকেতের অনুষ্ঠানে যেমন চমক থাকে, থাকে দেশীয় সংস্কৃতির কথা, দেশের মাটির কথা, তেমনি তার নিজের পারিবারিক অনুষ্ঠানেও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। এখানেই তার স্বকীয়তা ও কথা-কাজের মিল। জানা গেছে, গত ২২ মার্চ ঢাকার অদূরে হেমায়েতপুরে তার নিজস্ব শুটিং স্পট ফাগুন নিকেতনে আয়োজন করেছিলেন হলদে গ্রামীণ মেলা। যেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল হলুদ অনুষ্ঠান। বিশাল মাঠজুড়ে আয়োজিত সেই হলদে মেলাটিও ছিল আকর্ষণীয় এবং ব্যতিক্রমী। উল্লেখ্য, হানিফ সংকেতের নিজস্ব কোনো ফেসবুক নেই, আছে ফ্যান পেজ। যেখানে আজ পর্যন্ত কখনই তিনি কোনো পারিবারিক ছবি যেমন দেননি তেমনি অনুষ্ঠান ছাড়া কোনো ব্যক্তিগত ছবিও পোস্ট করেননি। তাছাড়া পত্রপত্রিকায় কিংবা টিভিতে কখনো তার পারিবারিক ছবি বা পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো সংবাদও দেখা যায়নি। কারণ এসব ব্যাপারে তিনি এবং তার পরিবার বরাবরই প্রচারবিমুখ। তবে এ বিয়ের অনুষ্ঠানের সুবাদে তার পারিবারিক কিছু চিত্র প্রথমবারের মতো আমন্ত্রিত অতিথি ও তারকাদের মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ ফেসবুকে প্রকাশিত হয়েছে। আর সেখান থেকেই ভেসে চলছে ফেসবুকের পাতায় পাতায়। দর্শকরা দেখছেন, প্রশংসা করছেন আর দোয়া করছেন বর-কনের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। ফাগুন ও রাওনাকের জন্য বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা। আমরা তাদের সুখী সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করছি।