শুক্রবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
৫০ বছরপূর্তিতে নাট্য সংগঠন আরণ্যক

আরণ্যক থেকে নাট্যাঙ্গনে যে তারকারা

আরণ্যক থেকে নাট্যাঙ্গনে যে তারকারা

৫০ বছর মামুনুর রশীদের হাত ধরে আরণ্যক আমাদের নাট্যাঙ্গনে আলো ছড়াচ্ছে। এ নাট্য সংগঠন থেকে উঠে এসেছেন ফয়েজ জহির, সালাউদ্দিন লাভলু, আজিজুল হাকিম, বৃন্দাবন দাস, তমালিকা কর্মকার, আজাদ আবুল কালাম, চঞ্চল চৌধুরী, আ খ ম হাসান, শামীম জামান, জয়রাজদের মতো অনেক গুণী অভিনয়শিল্পী।  তারা আমাদের মঞ্চ ও ভিজ্যুয়াল মিডিয়া উভয় জায়গাকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

৫০ বছর নাট্যজন মামুনুর রশীদের হাত ধরে আরণ্যক নাট্যাঙ্গনে আলো ছড়াচ্ছে। আরণ্যকের পাঁচ দশক পূর্তিতে অনুভূতির কথা জানিয়ে এই নাট্যকার বলেন, ৫০ বছর পেরিয়ে এসেছি। আরণ্যক থেকে আমরা ফয়েজ জহির, সালাউদ্দিন লাভলু, আজিজুল হাকিম, বৃন্দাবন দাস, তমালিকা কর্মকার, আজাদ আবুল কালাম, চঞ্চল চৌধুরী, আ খ ম হাসান, শামীম জামান, জয়রাজদের মতো অনেক নামি অভিনয়শিল্পী পেয়েছি। যারা আমাদের মঞ্চ ও ভিজ্যুয়াল মিডিয়া উভয় জায়গাকে সমৃদ্ধ করেছেন। মঞ্চনাটক, পথনাটক ও মুক্তনাটক করে নাট্যচর্চাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে আরণ্যক।

মামুনুর রশীদ বলেন, ৫০ বছর একটা দীর্ঘ সময়, অর্ধশতাব্দীর পথপরিক্রমা, খুব সহজ কথা নয়। ১৯৭২ সালে আমরা যখন যাত্রা শুরু করি তখন এর কোনো অবকাঠামো ছিল না। অনেক উত্থান-পতন আর মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছি। তারপর এক সময় সমৃদ্ধ হয়েছে নাট্যদল আরণ্যক। নাট্যজন মামুনুর রশীদ দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ৫০ বছরে আরণ্যকের সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি হলো পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আজও পায়নি এত বড় একটি নাট্যদল। ঢাকা শহরে নাট্যমঞ্চ খুবই অপ্রতুল। এখানে আরও মঞ্চ দরকার ছিল। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরার মতো জনবহুল এলাকায় কোনো নাট্যমঞ্চ গড়ে ওঠেনি। উত্তরা থেকে একজন দর্শককে সেগুনবাগিচার শিল্পকলায় নাটক দেখতে আসতে যেতে আড়াই ঘণ্টা করে ৫ ঘণ্টা আর নাটক দেখতে ২ ঘণ্টা মোট ৭ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। তাহলে একটি নাটক দেখতে কতজন দর্শকের পক্ষে ৭ ঘণ্টা ব্যয় করা সম্ভব? এসব প্রতিকূলতার কারণে আমরা মঞ্চের মানুষেরা এখন পর্যন্ত নাটককে জীবিকা হিসেবে নিতে পারিনি। জীবনের তাগিদে অন্য কাজও করতে হয়। অন্যদিকে আশার কথা হলো- এখনো বিপুল পরিমাণে ছেলেমেয়ে থিয়েটারে আসছে। তাদের এই আগ্রহ মঞ্চনাটকের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। আমাদের দেশটা খুবই নাট্যপ্রিয় দেশ। দেশে এত মিডিয়ার সম্প্রসারণের পরও মঞ্চনাটকের প্রতি নতুন প্রজন্মের এই আগ্রহ সত্যিই আশার সঞ্চার করে। পরিশেষে আমি বলব প্রত্যেকটা থিয়েটার হচ্ছে দেশ ও জাতির জন্য এক একেকটা মেসেজ। নতুন যারা এখানে আসছে তাদের সবাইকে এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে এবং সেভাবেই মঞ্চনাটক নিয়ে এগোতে হবে। মনে রাখতে হবে এখন শুধু শারীরিক বাচনভঙ্গি দিয়ে নাটক করা সম্ভব নয়, এর জন্য দরকার বুদ্ধি ও মেধার বিস্তার।

১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে নাট্যচর্চায় যাত্রা শুরু করে আরণ্যক নাট্যদল। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটি দিয়ে প্রথম মঞ্চে আসে তারা। ‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণিসংগ্রামের সুতীক্ষè হাতিয়ার’ স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে দলটি। মঞ্চনাটক, পথনাটক ও মুক্তনাটক করে নাট্যচর্চাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে আরণ্যক।

নাট্য ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূরের কথায়- মুক্তনাটকের মাধ্যমে আরণ্যকই প্রথম বাংলাদেশে রাজনৈতিক থিয়েটারের চর্চা শুরু করে, যা পরবর্তী সময়ে আমাদের জাতীয় আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। 

আরণ্যকের প্রধান মামুনুর রশীদ বলেন, প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উদযাপন একটি বড় ঘটনা। এটা উদযাপন করতেই আমরা উৎসবের আয়োজন করছি। বেশ কয়েকটি পুরনো নাটকও উৎসবে নতুন করে মঞ্চস্থ হচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের নিয়মিত প্রযোজনাগুলোও এতে যুক্ত হয়েছে।

চলতি বছর প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরপূর্তি উদযাপনে গত ২৭ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ উৎসবে আরণ্যকের নতুন-পুরনো ৯টি নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। সঙ্গে থাকছে সেমিনার, যন্ত্রসংগীত, প্রকাশনা উৎসবসহ নানা আয়োজন। যেখানে নবীন ও বর্তমানের নিয়মিত সদস্যদের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছেন ফজলুর রহমান বাবু, চঞ্চল চৌধুরী, আ খ ম হাসান, শামীম জামান, জয়রাজ, তমালিকা কর্মকারের মতো তারকা শিল্পীরা। উৎসবের নাটকে অভিনয় করতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এসেছেন তমালিকা কর্মকার।

অরণ্যকের মোট প্রযোজিত মঞ্চনাটক প্রায় ৪০টি, পথনাটক ২৪টির মতো।

আরণ্যকের শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে এই দলের প্রধান ও নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সাত তরুণ স্বাধীন বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে আরণ্যক নিয়ে। ওই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর কবর নাটক নিয়ে প্রথম মঞ্চে আসে তারা। ‘আরণ্যক’ নামটি দিয়েছিলেন প্রয়াত নাট্যজন আবদুল্লাহ আল মামুন। মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন দফতরে বসে আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, বলেছিলাম, একটা নাটকের দল করব, কী নাম দেওয়া যায়? তিনিই ‘আরণ্যক’ নামটি দিয়েছিলেন।

মামুনুর রশীদ বলেন, ‘প্রথম ১০ বছরে নাট্যচর্চার অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পারি, মহিলা সমিতি বা অন্য কোনো মিলনায়তনের সীমিত আসনের মঞ্চে নাটককে কখনই প্রচলিত বিনোদনের ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। অভিনেতা ও মধ্যবিত্ত দর্শকের মধ্যে একটা দূরত্ব থেকেই যাবে।’ এমন উপলব্ধি থেকে নাট্যচর্চায় পরিবর্তন আনে আরণ্যক। বেছে নেয় সহজতর ও জীবনঘনিষ্ঠ উপস্থাপনা।

১৯৮২ সালে মুক্তনাটকের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরণ্যক মঞ্চে আনে আবদুল্লাহেল মাহমুদ রচিত ‘সাত পুরুষের ঋণ’। ১৯৮৬ সালে ‘নানকার পালা’ আরণ্যকের নাট্যচর্চার আরেকটি পালাবদল। মামুনুর রশীদ জানান, ‘নানকার পালা’ মঞ্চে আসার পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা আর স্বৈরাচারী নির্যাতনের কালে ব্যাহত হলো স্বাভাবিক নাট্যচর্চা। এ সময় মঞ্চ ছেড়ে পথে নেমে এলো আরণ্যক। মিছিল, বিক্ষোভ আর পথনাটক এক হয়ে গেল।

আগেই বলা হয়েছে, এবারের উৎসবে ৯টি নাটক দেখানো হচ্ছে। সবকটি নাটকই নিজেদের। একটি দলের মৌলিক ৯টি নাটক নিয়ে উৎসবের আয়োজন অনন্য ঘটনা। সব বিবেচনায় বলা যায়, ৫০ বছরেও আরণ্যকের টগবগে তারুণ্য প্রবহমান। মঞ্চনাটক, পথনাটক ও মুক্তনাটক করে নাট্যচর্চাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে দলটি।

দলের কান্ডারি মামুনুর রশীদ বলেন, ‘শোষণহীন মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে আরণ্যক এই নিরন্তর সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে।’

সর্বশেষ খবর