‘আমরা এখন রবীন্দ্র আদর্শ বিচ্যুত হয়ে পড়ছি বলেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবক্ষয় নেমে এসেছে।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজকের জন্মদিনে এমনই আক্ষেপ প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী লিলি ইসলামের। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর বলা কথা তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ
আজ রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তী, আজকের দিনে তাঁকে ঘিরে আপনার ভাবনা কী?
আসলে আমরা যে রবীন্দ্র ভাবনা নিয়ে কাজ করতে চাই নানা প্রতিকূলতায় তা কতটুকু করতে পারছি সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বর্তমানে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভিনদেশি কালচারসহ নানা অনিয়মের কারণে যে দম বন্ধ অবস্থা চলছে তাতে আক্ষেপ নিয়ে বলাই যায় যে, আমরা সংস্কৃতির মূল ধারা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। এমন অবস্থায় নিজস্ব কৃষ্টিকালচার নিয়ে আমি শঙ্কিত।
‘রবীন্দ্র আদর্শ’ বাঙালি জাতিকে কতটা উজ্জীবিত করে বলে আপনার ধারণা?
বাঙালি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে রবীন্দ্র আদর্শের বিকল্প নেই। এর উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথের গান ও বাণী মুক্তিযোদ্ধাদের ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের অমর বাণী হলো- পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। কবিগুরুর দীক্ষা ছিল অহিংসা, সহমর্মিতা সদা বজায় রাখতে হবে এবং পাস্পরিক ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে। তাঁর চিরন্তন বাণী ছিল ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই’। আজ এই আদর্শের অভাব ঘটেছে বলেই সংস্কৃতি ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের সত্যিকার অর্থে প্রতিষ্ঠা করতে হলে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ প্রত্যেকের মধ্যে ধারণ করতে হবে। সব কিছুতেই কবিগুরুকে স্মরণ করতে হবে ও তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আজ কবিগুরুর জন্মদিনে এটিই যেন হয় আমাদের প্রতিজ্ঞা।
নতুন প্রজন্ম কবিগুরুকে কতটা যথাযথভাবে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারছে বলে মনে করছেন?
কবিগুরুকে নিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ নানাভাবে তারা রবীন্দ্র আদর্শ চর্চায় যুক্ত হচ্ছে। যেমন এবার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে অনুষ্ঠিতব্য রবীন্দ্র সম্মেলনে নতুন ছেলেমেয়েরা ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছে। এটি বাঙালি জাতির জন্য আশার কথা। রবীন্দ্র আয়োজনে নতুনদের এই যোগদান যেন থেমে না যায় সে আশাই আমি করব।’
এরপরও নতুনদের রবীন্দ্রচর্চা নিয়ে কোনো দুঃখ বোধ রয়েছে কী আপনার?
হ্যাঁ, দুঃখ বোধ তো কিছুটা অবশ্যই রয়েছে। কারণ যে পরিমাণে নতুনরা রবীন্দ্রচর্চায় আসছে তাতে মুসলমানের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কম। এটি কিন্তু ঠিক নয়, কেননা রবীন্দ্রনাথ হলেন মানবতার কবি। সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি সর্বজনীন সৃষ্টিশীল একজন মানুষ। তাঁকে ও তাঁর আদর্শকে বাদ দিয়ে কোনো ধর্মের মানুষের সংস্কৃতিচর্চা যথাযথ হতে পারে না। এ বিষয়টি আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
জাতি হিসেবে আমরা রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে অমরত্ব দিয়ে যেতে পারি?
তাঁর আদর্শ চর্চা ও অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে তাঁর অমরত্ব। নানা আয়োজন যেমন- সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, আলোচনা সভা এমন আরও অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমরা কবিগুরুকে অমরত্ব দিয়ে যেতে পারি।
এবারের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে তাঁকে নিয়ে কেমন আয়োজন থাকছে?
এবারও সরকারিভাবে তাঁকে নিয়ে তিন দিনের সম্মেলনের আয়োজন থাকছে। এবারের সম্মেলনের স্লোগান হলো- ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে’। এই পঙতিটি কবিগুরু পতিস্বরে বসেই লিখেছিলেন। এই বাণীর মমার্থ হলো- ‘সম্প্রীতি’র আহ্বান। সম্মেলনের প্রথম দিনে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আমার পরিচালিত রবীন্দ্র সংগঠন ‘উত্তরায়ণ’কে নিয়ে আমি যেন সূচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। তাই আমি ‘গল্প গানে রবীন্দ্রনাথ’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এটি পরিবেশন করবে উত্তরায়ণ, আর এর পরিচালনা, পরিকল্পনা ও গ্রন্থনা আমারই করা। এতে নৃত্য পরিচালনা করবেন তামান্না রহমান এবং মুনমুন আহমেদ।
এ ছাড়া বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থা ১১ থেকে ১৩ মে তিন দিনব্যাপী রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এবার এতে তারা আমাকে বিশেষ সম্মাননা দেবে। সবশেষে আমার প্রত্যাশা থাকবে এই সম্মেলনের মাধ্যমেই যেন রবীন্দ্রচর্চা শেষ হয়ে না যায়। আমরা যেন রবীন্দ্র আদর্শকে মন ও মননে ধারণ করে অনন্ত পথ এগিয়ে যাই।