বুধবার, ১৭ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিদায় মিয়া ভাই...

বিদায় মিয়া ভাই...

‘রেজিস্ট্রি করা চিঠি আইবো, পিওন আইসা ডাক দিবো, সেই চিঠিখান পড়তে হইবো আন্ধার কবরে, ফুরুৎ কইরা উইরা যাইবো প্রাণ পাখিরে’... একটি চলচ্চিত্রে এই গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা সবার প্রিয় মিয়া ভাই ফারুক। এই গানটি আজ সত্যি হয়ে গেল তাঁর জীবনে... রঙিন দুনিয়ার মায়া  কাটিয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়লেন আন্ধার কবরে।  তাঁর জীবনের কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

‘ওরে নীল দরিয়া/আমায় দেরে দে ছাড়িয়া/বন্দী হইয়া মনোয়া পাখি, হায়রে/কান্দে রইয়া রইয়া।/কাছের মানুষ দূরে থুইয়া,/মরি আমি ধড়-ফড়াইয়া, রে/ দারুণ জ্বালা দিবানিশি/অন্তরে অন্তরে...’

অভিনেতা ফারুক ভাইয়ের এই আকুতি নীল দরিয়া ঠিকই রেখেছে, ছেড়েও দিয়েছে তাঁকে, কিন্তু পৃথিবীর এই নীল দরিয়া বড়ই নিষ্ঠুর। কারণ তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তবে এই ধরাধামে থাকতে দেওয়া হয়নি, পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পরপারে... এই বিদায় চিরদিনের, বড়ই কষ্টের। এ দেশের মানুষ তাঁর প্রিয় মিয়া ভাইকে আর কখনো দেখবে না, এই দুঃখ কোনো দিন ভোলার নয়। বেশ কয়েক বছর মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে লড়তে অবশেষে জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত ফারুক ভাই হেরে গেলেন... ক্লান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন এখন সবার প্রিয় এই মানুষটি।

 

এক নজরে

ফারুক নামে পরিচিত আকবর হোসেন পাঠান দুলু ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আজগার হোসেন পাঠান। তাঁর  শৈশব-কৈশোর ও যৌবনকাল কেটেছে পুরান ঢাকায়। পাঁচ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে ঢাকাই সিনেমায় তাঁর অভিষেক হয়। এরপর ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘লাঠিয়াল’, ‘সুজন-সখী’, ‘নয়ন মণি’, ‘সারেং বৌ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সাহেব’, ‘আলোর মিছিল’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘মিয়া ভাই’সহ শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। ফারুক ১৯৭৫ সালে ‘লাঠিয়াল’ সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। ১৯৮৭ সালে ‘মিয়া ভাই’ চলচ্চিত্রের সাফল্যের পর তিনি চলচ্চিত্রাঙ্গনে মিয়া ভাই হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ২০১৯ সালে কলকাতার সম্মানজনক ১৮তম টেলিসিনে অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। প্রায় পাঁচ দশক ঢালিউডে অবদান রেখেছেন অভিনেতা ফারুক। অভিনয় থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১৭ আসনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

 

যেভাবে চলচ্চিত্রে

দেশীয় চলচ্চিত্রে মিয়া ভাই খ্যাতি পাওয়া জনপ্রিয় একজন অভিনেতার নাম ফারুক। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। বলিষ্ঠ অভিনয় দিয়ে দর্শকহৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছিলেন। ‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া’ প্রয়াত আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ছবির এ গানটি এখনো সমান জনপ্রিয়। আর এ গানটি শুনলেই একজন দক্ষ অভিনেতার ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তিনি হলেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা ফারুক। যাঁর পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। ফারুক নামটি তাঁকে দেওয়া হয়েছিল চলচ্চিত্রের পোশাকি নাম হিসেবে। অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, পরিচালক এইচ আকবর এবং ফারুক নামে নিজের একজন বন্ধু মিলে তাঁকে দিয়েছিলেন এ নাম। ছাত্রজীবনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাড়া-মহল্লায় নাটকে অভিনয় করতেন তিনি। এইচ আকবর পরিচালিত জলছবি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে ফারুকের অভিষেক ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় তাঁর অভিনীত প্রথম ছবি ‘জলছবি’। চলচ্চিত্রে আসার কারণ হিসেবে এই কিংবদন্তি অভিনেতা বলেছিলেন, ছাত্রলীগ করার কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আমার বিরুদ্ধে ৩৭টি হয়রানিমূলক মামলা করে। এসব মামলা থেকে বাঁচতে বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে চলচ্চিত্রে আসি।

 

শেষ জন্মদিনে দেশবাসীর সামনে

জীবিত অবস্থায় ঢাকাই ছবির এ অভিনেতার শেষ জন্মদিন ছিল গত বছরের ১৮ আগস্ট। এ উপলক্ষে ১৭ আগস্ট একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন এ অভিনেতা। কে জানত এই ভিডিও বার্তা হবে জন্মদিন উপলক্ষে অভিনেতার শেষ ভিডিও বার্তা। সেই ভিডিওতে এই অভিনেতা বলেছিলেন, ‘দেশের মানুষের ভালোবাসা ফারুক কোনো দিন ভুলবে না।’

 

প্রথম ছবি কবরীর সঙ্গে  পারিশ্রমিক ৫০০ টাকা

ছয় দফা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কারণে তাঁর নামে মামলাও হয়। ছয় দফা আন্দোলনের দুই বছর পর ১৯৬৮ সালে নিজের প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’র শুটিং শুরু করেন ফারুক। ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমার জন্য কত পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তিনি? ২০১৬ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক অডিও সাক্ষাৎকারে তা জানিয়েছিলেন অভিনেতা নিজেই। ছয় দফা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন ফারুক। তখন তাঁর নামে ৩৬টি মামলায় হয়। ছাত্র রাজনীতিতে তিনি তখন সক্রিয়, সিনেমায় অভিনয় নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। মামলা থেকে বাঁচার জন্য তাঁর বন্ধুবান্ধবরা বলে, চলচ্চিত্রে ঢুকে যাও। এরপরই চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। ফারুকের প্রথম সিনেমা ‘জলছবি’। ১৯৬৮ সালে ছবিটির শুটিং শুরু হয় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৭১-এ। ছবিতে তাঁর সহকর্মী ছিলেন কবরী। বলা যায় ফারুকের সিনেমা-জীবন শুরুই হয় কবরীর সঙ্গে। এই ছবিতে তাঁকে পারিশ্রমিক হিসেবে ৫০০ টাকা দেওয়া হয়েছিল।

 

মিয়া ভাইয়ের নায়িকারা

অভিনেতা ফারুকের বিপরীতে অভিনয় করেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি সব অভিনেত্রী। তার মধ্যে রয়েছেন- কবরী, ববিতা, সুচরিতা, রোজিনা, সুচন্দা, অঞ্জু ঘোষ, অঞ্জনা, শাবানা, নিপা মোনালিসা, সুনেত্রাসহ আরও অনেক নায়িকা। সত্তর ও আশির দশকের সব শীর্ষ নায়িকার বিপরীতে কাজ করলেও ববিতা-ফারুক জুটিই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়।

 

তুমুল জনপ্রিয়তায় ববিতা ও কবরীর সঙ্গে জুটি

দীর্ঘ অভিনয়-জীবনে ফারুক কবরী ও ববিতা ছাড়াও শাবানা, রোজিনা, অঞ্জনা, সুচরিতা, অঞ্জু ঘোষসহ সত্তর ও আশির দশকের সব শীর্ষ নায়িকার বিপরীতে কাজ করেছেন। এমনকি আনোয়ারা এবং সুচন্দার মতো দুই অভিনেত্রীর বিপরীতেও দুই সিনেমায় নায়ক ছিলেন তিনি। তবে ফারুক-কবরী জুটি আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল ‘সুজন-সখী’। আর জনপ্রিয়তায় ববিতা-ফারুক জুটিই ছিল সেরা।

 

২০ টাকায় ডিম ছুড়তেন

ফারুক পুরান ঢাকায় বেড়ে উঠেন। একসময় পাড়া-মহল্লায় নাটক বা কোনো অনুষ্ঠান পন্ড করাই ছিল তাঁর কাজ। ২০ টাকার বিনিময়ে ডিম ছুড়ে ভন্ডুল করে দিতেন সে সব আয়োজন। যুদ্ধজাহাজ চালানোর স্বপ্ন দেখতেন ছোটবেলায়, কিন্তু হয়ে গেলেন অভিনেতা। ছাত্রজীবনে পুরান ঢাকায় মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।

 

উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র

নয়ন মণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুজন-সখী, জনতা এক্সপ্রেস, কথা দিলাম, দিন যায় কথা থাকে, সারেং বৌ, লাঠিয়াল, আবার তোরা মানুষ হ, আলোর মিছিল প্রভৃতি।

 

সর্বশেষ অভিনীত চলচ্চিত্র

২০০৮ সালে নির্মিত আজাদী হাসানত ফিরোজ পরিচালিত ‘ঘরের লক্ষ্মী’ ছিল ফারুক অভিনীত শেষ ছবি।

ববিতার স্মৃতিচারণা

সব কই মাছ আমরা খেয়ে ফেললাম

১৯৭৬ সালে মুক্তি পেল প্রয়াত আমজাদ হোসেন পরিচালিত নয়ন মণি ছবিটি। এই ছবিতে ফারুক নয়ন আর আমি মণি চরিত্রে অভিনয় করলাম। দর্শক আমাদের জুটিকে পরম ভালোবাসায় সাদরে গ্রহণ করল। তখন এই ছবির গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরছিল। যেমন- ‘চুল ধইরো না খোঁপা খুলে যাবে হে নাগর’ কিংবা ‘আমি কোথায় থাকিরে বটগাছের পাতা নাইরে’। ছবিতে নয়নরূপী ফারুকের অনবদ্য অভিনয়ে এই ছবি স্বাধীন দেশে প্রথম প্লাটিনাম জুবলি পালনের ইতিহাস হয়ে যায়। এই সাফল্যে আমরা একে একে অভিনয় করি ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কথা দিলাম’, ‘লাঠিয়াল’সহ অনেক ছবিতে। অবশ্য নয়ন মণির আগে ‘আলোর মিছিল’ এবং আরও কয়েকটি ছবিতে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। সতীর্থ নায়ক ফারুককে ভগ্নহৃদয়ে স্মরণ করে অভিনেত্রী ববিতা আরও বলেন, সর্বশেষ আমাদের দেখা হয়েছিল ২০১৮ সালে, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৬ আসরে আমরা দুজন আজীবন সম্মাননা পাই। এরপর আর আমাদের দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। তবে খোঁজখবর পেতাম তাঁর স্ত্রী ফারহানা পাঠানের বোনের কাছ থেকে। ববিতা বললেন, দীর্ঘ অভিনয়জীবনে ৫০টির মতো ছবিতে আমরা একসঙ্গে অভিনয় করেছি। ছবিগুলোতে অভিনয় করতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে কত শত শত স্মৃতি যে জমা পড়েছে। ববিতা বলেন, ‘অভিনয়শিল্পী হিসেবে ফারুক ছিলেন অসাধারণ, অতুলনীয়। বিশেষ করে গ্রামীণ পটভূমির চলচ্চিত্রে এত অসাধারণভাবে মিশে যেতে পারতেন, তা আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল বলে মনে হয় না। যখন তিনি ছবিতে কাজ করতেন, ইমোশনাল হয়ে কাজ করতেন। আর মানুষ হিসেবে ফারুক ভাইকে বাইরের কেউ কেউ বদরাগি, বদমেজাজি ভাবতেন। খুব ভয় পেতেন- এমনটা আমরা প্রায়ই শুনতাম। কিন্তু তিনি মোটেও  তেমনটি ছিলেন না। ছিলেন খুব নরম মনের। শিশুসুলভ মনের একজন মানুষ ছিলেন আমাদের ফারুক ভাই।’ ছবির সেটে আমরা নানা মজা করে সময় কাটাতাম। কারণ ফারুক ভাই কাজের প্রতি যেমন ছিলেন সিনসিয়ার তেমনি অবসর সময়ে ছিলেন খুবই মজাপ্রিয় মানুষ। একটি ছবির শুটিং হচ্ছিল আউটডোরে। আগের রাত থেকে একটানা শুটিং চলছিল। দুপুর হতে হতে আমাদের খিদে চরমে। শুটিংয়ের বিরতিতে ইউনিটের সবাই ফ্রেশ হতে গেছে। একটি নৌকায় রান্নাবান্না হয়েছে। সেদিন কই মাছ রান্না করা হয়েছিল। ফারুক ভাইয়ের প্রাণও খিদেয় ওষ্ঠাগত। ফারুক আমাকে ডেকে নৌকায় নিয়ে গেলেন, বললেন, ‘দেখ সবাই কখন ফ্রেশ হবে খাবে জানি না। এত দেরি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গেলে মরেই যাব। এসো আমরা কিছু খেয়ে নিই। বলতে বলতে কই মাছের হাঁড়িটা নিয়ে আমরা দুজন সব মাছ খেয়ে শেষ করে ফেললাম।’ এমন আরও অনেক মজার স্মৃতি আছে তাঁকে ঘিরে। এখন এসব মনে পড়লে দুই  চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু গড়ায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর