শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা
বিশেষ সাক্ষাৎকার

প্রত্যেক শিল্পীই কাজের স্বীকৃতি পেতে চায়

প্রত্যেক শিল্পীই কাজের স্বীকৃতি পেতে চায়

প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। দুই বাংলায় তার রবীন্দ্রসংগীতের তুমুল জনপ্রিয়তা। সংগীতে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ২০১৬ সালে তিনি অর্জন করেন বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা পদক’। অন্যদিকে ভারত থেকে তিনি পেয়েছেন ‘বঙ্গভূষণ’ এবং ‘সংগীত সম্মান পুরস্কার’ সম্মাননা। এবার এ শিল্পী পাচ্ছেন ভারতের মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ পদক।  এ সম্মাননা প্রাপ্তি এবং সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল

 

কেমন আছেন? অভিনন্দন জানাচ্ছি ‘পদ্মশ্রী’ সম্মাননায় ভূষিত হওয়ার জন্য। এ অসামান্য প্রাপ্তিতে কেমন বোধ করছেন? 

জি, অনেক অনেক ভালো আছি। আর হ্যাঁ, আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ আমার এ অর্জনে অভিনন্দন জানানোর জন্য। আমি খুবই আনন্দিত ও সম্মানিতবোধ করছি। এমন স্বীকৃতি ও সম্মাননা সবসময়ই আনন্দদায়ক। প্রত্যেক শিল্পীই কাজের স্বীকৃতি পেতে চায়। আমি মনে করি, এটা আমার জন্য অনেক বড় একটা আশীর্বাদ। এ জীবনে এমন সম্মান ও ভালোবাসা পাব সেটা কখনো ভাবিনি। আমাকে যে সম্মান দেওয়া হচ্ছে এতে সৃষ্টিকর্তা, আমার মা-বাবা, শ্রোতা, আমার ছাত্রছাত্রী সবার কাছেই কৃতজ্ঞ।

 

তাহলে তো দায়বদ্ধতা আরও বেড়ে গেল...

অনেক বেড়ে গেল। এখন যে সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া হলো, তার যোগ্য যেন হয়ে উঠতে পারি। আগামীতে ভালোভাবে যেন সব কাজ করতে পারি। দোয়া করবেন আমার জন্য। আমি মনে করি, স্বীকৃতি ও সম্মাননা কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে দেয়। যখন এমন সম্মাননা পাই তখন ভাবি, আসলে আমি এর যোগ্য কি না! সেই যোগ্য যেন হয়ে উঠতে পারি সবসময় সেই প্রার্থনা করি। আপনারাও ভালোবাসায় আজীবন পাশে থাকবেন।

 

‘সুরের ধারা’র কার্যক্রম কেমন চলছে?

সুরের ধারা বৃহত্তর পরিসরে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কাজ করছে, যাতে লাখো বাঙালির অংশীদারিত্ব থাকে। আর বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথ যে একটি অনিবার্য সত্তা, তা কি অস্বীকার করার জো আছে? তাই মানুষের সৃষ্টিশীল মননকে সমৃদ্ধ করতে বৃহৎ পরিসরে সুরের ধারাকে বহন করা।

 

‘সুরের ধারা’র জন্য জমি পাওয়া গেছে শুনেছিলাম। সেটির অগ্রগতি কতদূর?

প্রস্তুতি চলছে। প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। নকশা তৈরি হচ্ছে। বসিলার রামচন্দ্রপুরের ৫৫ শতাংশ জমি নিয়ে কাজটি হবে। এটি হয়ে গেলে প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে সংগীত প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হবে।

 

রবীন্দ্রনাথ-শান্তিনিকেতনের প্রতি আগ্রহী কীভাবে?

শান্তিনিকেতন আমার স্বপ্নের জায়গা। আমার তৈরি হওয়া, আমার মনন, বোধ তৈরিতে শান্তিনিকেতনের অবশ্যই একটা বড় ভূমিকা আছে। সবদিক থেকে সাংগীতিক যে বেড়ে ওঠা, সেটা তো বটেই, রবীন্দ্রনাথের দর্শন-সাহিত্য সবকিছুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয়ের সূত্রপাত শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথের যে প্রকৃতি তার সঙ্গে পরিচয় এবং তার মধ্য দিয়ে আমার নিজের চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছিল শান্তিনিকেতনে। মোহর দি (গুরু কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) যতদিন বেঁচে ছিলেন সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ ছিল, নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল। অন্যদিকে বাড়িতেও রবীন্দ্রনাথ খুব চর্চিত ছিলেন। ছোট থেকেই তার লেখা পড়তাম।

 

আর ছায়ানটের সঙ্গে সম্পর্ক...

ছায়ানটের সঙ্গে সম্পর্ক আত্মার। দীর্ঘকাল এ সংগঠনটির সঙ্গে সম্পর্ক। ২০১১ সালে চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন করতে গিয়ে সুরের ধারার জন্ম হয়। আমি মনে করি, ছায়ানট এবং সুরের ধারা রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে পরস্পরের পরিপূরক।

 

রবীন্দ্রনাথের গানে ইনস্ট্রুমেন্ট কমিয়ে রেকর্ডিং করলে ভাবটা আরও ব্যক্তিগত হয় বলে মনে করেন?

এটা আসলে মানুষ অনুযায়ী একেকজনের ভাবনা। কেউ তানপুরা নিয়ে রেকর্ড করছে, তো কেউ ওয়েস্টার্ন ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে। তা ছাড়া অনুষ্ঠান হলে সঙ্গে আরও পাঁচজন যন্ত্রসংগীতশিল্পীরা থাকেন। তাদের তো বাজাতে বারণ করা যায় না। তবে একটা সফট গান হলে লাউড মিউজিক বাজাতে বারণ করি। কিছু গানে শুধু হারমোনিয়াম বাজিয়েও গাই। এ ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা টানা যায় না।

 

রবীন্দ্রনাথের গান শিখতে যে আত্মনিবেদন প্রয়োজন, এখন কি তার বড্ড অভাব?

এখন তো সময়টাই পাল্টে গেছে। পৃথিবী পাল্টে গেছে। শুধু গান বলে নয়, আমরা কোনোকিছু অত সময় ও নিষ্ঠা দিয়ে করি না। রান্নার পরিশ্রম না করে অনলাইনে খাবার অর্ডার করি। চিঠি লেখার কষ্ট না করে হোয়াটসঅ্যাপ টেক্সট। আগে শুধু টিভি ছিল, এখন ইউটিউব, ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়া। সারাক্ষণ স্ক্রলিং। সময়ের বদলটাও মেনে নিতে হবে। তবে এও ঠিক যে রবীন্দ্রসংগীতের শিকড় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। এটুকু কিন্তু প্রয়োজন।

 

রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয়তা কি কমছে?

রবীন্দ্রনাথের গানকে আধুনিক গানের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে। তার গানের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে না পারলে অর্ধেকটা সেখানেই হারিয়ে গেল। গানের কথার নান্দনিকতা বুঝতে হবে। ব্যান্ড বা আধুনিক গানে যে হুলুস্থূল কান্ড হয়, সেটায় কিন্তু মানসিক স্থিতি নেই। রবীন্দ্রনাথের গান তেমন নয়। সে গান মনকে স্থিত করে ডুবিয়ে দিচ্ছে গভীরে। রবীন্দ্রসংগীত শুধু শোনার জন্য শোনা নয়। সে গান কারও কারও জীবনের সংকটের সময় ‘প্রয়োজন’ হয়ে ওঠে।

 

প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রচর্চা কতটুকু প্রভাব ফেলেছে?

রবীন্দ্রচর্চা একটি দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। যতদিন বাঙালির অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন এ চর্চা অব্যাহত থাকবে।

 

বাংলাদেশে কি রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা বেশি হয়?

বাংলাদেশে প্রচুর চর্চা হয়। যদিও বাংলাদেশে বাংলা জাতীয় ভাষা কিন্তু এখানে বাংলা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই সীমিত।

 

সংস্কৃতিচর্চায় একটা বিচ্ছিন্নতা ও শূন্যতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন?

এ কথা সত্য যে, এখনকার প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতিচর্চা মানুষের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়েছে। দুটো কারণ রয়েছে, আগের মতো গ্রামের মানুষের সাংস্কৃতিকভাবে তৎপর থাকতে না পারা আর শহরের মানুষের জীবনে সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রভাব। আকাশ সংস্কৃতির কারণে শহরে সংস্কৃতির বিশ্বায়ন ঘটেছে। সবার হাতে হাতে অনলাইনের বিচিত্র সম্ভার। নাগরিক মানুষের জীবনযাপন ও সংস্কৃতি এখন অনেকটাই বহির্মুখী। শহরে বাঙালি সংস্কৃতির সুর আর আগের তারে বাজে না। সবটা মিলিয়েই একটা বিচ্ছিন্নতা, একটা শূন্যতা।

 

সরকারিভাবে আপনার সংগীতকর্ম, ছবি, গানের অ্যালবাম সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে...

আমি তো সেটা (ভার্চুয়ালি গান সংরক্ষণ) বুঝি না, আবার পারিও না। আজকালের ছেলেমেয়েরা যেভাবে প্রযুক্তি নিয়ে ধারণা রাখে, আমার সে রকম ধারণা নেই। বাংলাদেশ সরকার এ দায়িত্ব নেওয়ায় আমার জন্য ভালো হয়েছে। এ যুগে এসে এটা না পারলে পিছিয়ে যেতে হয়। আমাদের মতো পুরনো শিল্পীদের গান সংরক্ষণে এটা খুব ভালো উদ্যোগ বলা যায়।

সর্বশেষ খবর