সিনেমার স্বপ্নটা দেখান ফিজিক্সের আনিস সাবেত। তাঁর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে। ফিজিক্স নিয়ে পড়লেও উনি প্রায়ই শোনাতেন আলো-আঁধারের গল্প, স্বপ্ন দেখতেন ছবি বানানোর। এমনকি সে সময়ে আহমেদ ছফার ‘ওংকার’ উপন্যাস নিয়ে চিত্রনাট্যও লিখে ফেলেন তিনি। কিন্তু তা পর্দায় আনার আগেই পড়াশোনার তাগিদে দেশ ছাড়তে হয়। তবে স্বপ্ন ছাড়েননি, বিদেশের মাটিতে বসেই বানালেন নিজের স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র, জিতলেন পুরস্কারও। ১০ বছর পর দেশে ফিরে সে গল্প শুনিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদকে। তারপর হঠাৎ হানা দিল ক্যান্সার, আনিস সাবেতকে স্বপ্নের সঙ্গে বিসর্জন দিতে হয়েছিল জীবনকেও। ওনার চলে যাওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদের মনে সেই স্বপ্ন ঢুকে গেছে। একদিন ভোরবেলা স্ত্রী গুলতেকিনকে জানালেন সেই স্বপ্নের কথা, ছবি বানানোর কথা। ছবির নাম ‘আগুনের পরশমণি’। চাইলেই কি আর ছবি বানানো যায়! আবার স্বপ্নকেও তো নিজ হাতে মারা যায় না। নিজের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘আগুনের পরশমণি’কে চিত্রনাট্যে রূপ দিতে শুরু করলেন। সেই সঙ্গে সিনেমা তৈরির ওপর লেখা দেশি-বিদেশি বই খুঁজে সেগুলো পড়তে শুরু করলেন। বইয়ের জন্য সাহায্য নিলেন বন্ধুদের। এদিকে আরেক সমস্যা এসে জুড়ে বসল! হয় অধ্যাপক হওয়ার জন্য রিসার্চের কাজ চালিয়ে যেতে হবে, নয়তো সিনেমা নিয়ে থাকতে হবে। মনের কথা শুনে রিসার্চ বাদ দিয়ে চিত্রনাট্যে মনোনিবেশ করলেন। তবে তাঁর ভাগ্য সহায় ছিল। দুটোই পেলেন একসঙ্গে। হাতে চিত্রনাট্য, মানে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন; কিন্তু পকেট ফাঁকা। ফাঁকা বলতে শূন্য না, হাতে মাত্র দুই লাখ টাকা। সিনেমার জন্য এটা ফাঁকাই ধরা যায়। সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন বন্ধু এবং নাট্যাভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। দিনভর দুজনে মিলে অর্থ সন্ধানে ঘোরাঘুরি করলেও মানুষের কাছ থেকে শুধু উৎসাহই মেলাতে পারলেন। রাতে একাকী ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো তথ্যমন্ত্রীর নাম, সেখানে গিয়েও হতাশা নিয়েই ফিরতে হলো। শেষে ঠিক করলেন বাসা বিক্রি করবেন, তবু ছবি বানাবেনই। এরই মধ্যে সুখবর মিলল সরকার আবার ছবির জন্য অনুদান প্রথা চালু করেছে এবং সেখানে তিনটা ছবির মধ্যে রয়েছে আগুনের পরশমণির নাম। সিনেমার চরিত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও নিজের মনের কথাই শুনলেন। বদিউল আলম চরিত্রে রাখলেন আসাদুজ্জামান নূরকে, রাত্রী চরিত্রে বিপাশা হায়াত, একে একে যুক্ত করা হলো ডলি জহুর, আবুল হায়াত, দিলারা জামান, শীলা, পুতুল, সালেহ আহমেদ, ওয়ালিউল ইসলাম ভূঁইয়াসহ আরও অনেককে। সহকারী পরিচালক হিসেবে নিলেন তারা চৌধুরীকে; যাঁর রেকর্ড ছিল কোনো পরিচালক সিনেমায় তাঁকে দ্বিতীয়বার নেননি। সম্পাদনায় যুক্ত করলেন আতিকুর রহমান মল্লিককে। মানুষের কথা না শুনেই ক্যামেরায় নিলেন আখতার হোসেনকে। সত্য সাহা যুক্ত হলেন সংগীত পরিচালক হিসেবে। মাসুক হেলাল, ধ্রুব এষ বাদ রাখেননি কাউকে। সিনেমা বানাতে হলে খাজা বাবার দোয়া নিতে হয়, এটা শুনে অবাকই হলেন হুমায়ূন আহমেদ। মোজাম্মেল সাহেবের কথা রাখতে, মনের কৌতূহল মেটাতে তাঁকে নিয়েই গেলেন আজমির শরিফ। খাদেমের মারফতে স্ক্রিপ্ট পাঠানো হলো ভিতরে। কিন্তু সে রীতিমতো চমকে দিল যে চিত্রনাট্যে বিরাট গন্ডগোল, ফুপুর চরিত্র নেই। তাহলে কি আধ্যাত্মিক ব্যাপার সত্যিই আছে! কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়, সেখানে ওনারই আরেক ভক্তের সম্পর্কজুড়ে ছিল। যিনি উপন্যাসটা আগে পড়েছিলেন। মাথায় কুলাভর্তি ফুল নিয়ে চিত্রনাট্য ঢোকাতে হলো মাজারের গিলাফের ভিতর। কথা ছিল সিনেমা রিলিজের দিন তা বের করা হবে গিলাফের ভিতর থেকে। তা বের করা হয়েছিল কি না, সে খবর আর পাননি হুমায়ূন আহমেদ। দোয়া নেওয়া শেষ হলেও সিনেমার জন্য বসতে হবে পরীক্ষায়। পরিচালক সমিতি গোঁ ধরেছে তারা পরীক্ষা নেবে। যদি সেখানে উত্তীর্ণ হতে পারেন, তবেই সিনেমা বানাতে পারবেন। ছবির জগতে পরিচিত মুখ চাষী নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে জনা বিশেক মানুষের সামনে বসতে হলো পরীক্ষায়। কোনোমতে পাস নম্বর পেয়ে মিলেছিল সহযোগী সদস্যপদ। সিনেমার জগতে পরিচিত চারটি শব্দ লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, কাট। কিন্তু পরিচালক প্রথম দিনেই ভুলে গেলেন কাট বলার কথা। ক্যামেরা চলছে, ক্যামেরাম্যান আখতার সাহেব তা মনে করিয়ে দিলেন। কিন্তু যতক্ষণে কাট বলেছেন, ততক্ষণে পরের দিন খবরের পাতায় এ খবর উঠে এসেছে। এ নিয়ে হয়েছে প্রচুর হাস্যরস। এসব অবশ্য তিনি গায়ে মাখলেন না। ‘আগুনের পরশমণি’ মানুষের মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়। শুধু দর্শকমন জয় নয়, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ছবিসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে একাধিক পুরস্কার জয়ী হয় হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’।
হুমায়ূন আহমেদের রচনা নিয়ে যত চলচ্চিত্র
হুমায়ূন আহমেদের লেখা উপন্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে বহু কালজয়ী সিনেমা। নন্দিত এই লেখকের জন্মদিন আজ। তাঁর চিত্রনাট্য থেকে নির্মিত সিনেমাগুলো হলো- শঙ্খনীল কারাগার হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ অবলম্বনে পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান নির্মাণ করেন ‘শঙ্খনীল কারাগার’ সিনেমা। এটি মুক্তি পায় ১৯৯২ সালে। ওই বছর সিনেমাটির জন্য হুমায়ূন আহমেদ শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এ ছাড়া শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ডলি জহুর এবং শ্রেষ্ঠ শব্দ গ্রাহক এম এ মজিদ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস থেকে নির্মিত প্রথম সিনেমা এটি।
‘কৃষ্ণপক্ষ’ সিনেমা দিয়ে পরিচালক হিসেবে অভিষেক ঘটে হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের। এটি নির্মিত হয় হুমায়ূন আহমেদের ‘কৃষ্ণপক্ষ’ উপন্যাস অবলম্বনে। এতে অভিনয় করেছেন রিয়াজ, মাহিয়া মাহি, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, আজাদ আবুল কালাম, তানিয়া আহমেদ, মৌটুসী বিশ্বাস, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, কায়েস চৌধুরী, ফারুক আহমেদ, রফিকউল্লাহ সেলিম, ঝুনা চৌধুরী, স্বাধীন খসরু, আরফান আহমেদ, মাসুদ আখন্দ, তারিক স্বপন, জয়ীতা মহলানবীশ, এহসানুর রহমান, আইনুন পুতুল, জুয়েল রানা, মোহাম্মদ ইব্রাহীম, পূজা চেরী প্রমুখ। রিয়াজ-মাহির জুটিবদ্ধ প্রথম সিনেমা এটি। ২০১৬ সালে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। দেবী ২০১৮ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত রহস্যঘেরা সিনেমা ‘দেবী’। এটি পরিচালনা করেন অ ন ম বিশ্বাস। ২০১৫-১৬ সালের সরকারি অনুদানে ‘দেবী’ নির্মিত হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয় কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে দেবী প্রদর্শিত হয়েছে। এতে মিসির আলির চরিত্রে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী আর রানু চরিত্রে জয়া আহসান। এ ছাড়া অভিনয় করেছেন ইরেশ যাকের, শবনম ফারিয়া, অনিমেষ আইচসহ অনেকে। ২০১৮ সালের সবচেয়ে ব্যবসা সফল সিনেমা ছিল ‘দেবী’। এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের কাহিনি নিয়ে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন ‘আবদার’। তার গল্প থেকে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘দূরত্ব’ ও ‘প্রিয়তমেষু’। ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘নন্দিত নরকে’ সিনেমা পরিচালনা করেন বেলাল আহমেদ। ‘সাজঘর’ উপন্যাস থেকে শাহ আলম কিরণ তৈরি করেন ‘সাজঘর’ এবং জনম জনম উপন্যাস অবলম্বনে আবু সাইয়ীদ বানান ‘নিরন্তর’ সিনেমা।