ঢাকাই চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা নব্বইয়ের দশকের শেষভাগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন এবং সেখানেই সপরিবার থিতু হয়েছেন। ঢাকাই চলচ্চিত্রের বিউটিকুইন খ্যাত এ অভিনেত্রী তাঁর অভিনয়জীবন ও চলচ্চিত্র জগৎ নিয়ে মাঝেমধ্যে খুবই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। বলেন জীবনের নানান অজানা অধ্যায়ের কথা। তেমনি তাঁর বলা কিছু কথা এখানে তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ
অভিনেত্রী শাবানা বলেন, আমি যখন ছবিতে আসি ছবির জগৎটাই অন্যরকম ছিল। মাত্র ৯ বছর বয়সে আমি প্রথম পর্দায় আসি। ছবিটা ছিল ‘নতুন সুর’। তখন সময়টা ১৯৬২ সাল হবে। একটা শিশু চরিত্রে অভিনয় করি। কেমন করেছিলাম মনে নেই। তবে আগে থেকে কোনো কিছু জানাশোনা ছিল না। হঠাৎ করে সুযোগ পেয়ে যাই। আমার বাবা কোর্টে চাকরি করলেও বরাবরই তাঁর মধ্যে একটা শিল্পীসুলভ মন কাজ করত। এজন্যই মুসলমান মেয়েদের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ হলেও বাবা আমাকে অভিনয় করতে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তো তিনি নিজেও পরিচালক হন। আমার ডাকনাম ছিল রত্না, ভালো নাম আফরোজা। এ দুটো নামের কোনোটাই শেষ পর্যন্ত থাকেনি। এখন আমি শাবানা। তবে সেই রত্নাকেও ভুলে থাকতে চাই না। রত্না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায়নি বটে, তবে রত্না শিখেছিল জীবন থেকে। আর এজন্যই রত্নার শিক্ষা আজকের শাবানার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। আমার নিজের কাছেই অবাক লাগে মায়ের আঁচলে মুখ মোছা রত্না কীভাবে আজকের শাবানায় রূপান্তরিত হলো। অভিনয় তখন আমার কাছে নেশায় পরিণত হতে চলেছে। ভালো লাগত। কেন লাগত বলতে পারব না। আমি অভিনয় সম্পর্কে কোনো শিক্ষা কারও কাছ থেকে পাইনি। আমার সব শিক্ষা আমার চারপাশের জগৎ থেকে আর বিভিন্ন পরিচালকের কাছ থেকে পেয়েছি। ‘নতুন সুর’ মুক্তি পাওয়ার পর আমি ‘তালাশে’ কাজ করি। এটা সম্ভবত ১৯৬৩ সাল হবে। তালাশে একটা ‘গ্রুপ ডান্সে’ অংশ নিয়েছিলাম। ওই সময় আমার নাম রত্নাই ছিল। এরপর এ সময় আরও কয়েকটি ছবিতে কাজ করি। এ চরিত্রগুলোও অনুল্লেখযোগ্য। ফিল্মের ভাষায় ‘এক্সট্রা’। এর জন্য অবশ্য আমার এখন খারাপ লাগে না। বরং গৌরব বোধ করি যে, একদম ছোট থেকে নিজের ক্ষমতাবলে আজ আমি এ অবস্থানে এসেছি। ১৯৬৩-৬৫ সালের দিকে আমি ক্রমশ ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তোলার চেষ্টা করছিলাম। তখন বনবাসে রূপবান, ডাকবাবু ও ভাইয়া ছবিতে ‘সহনায়িকা’র সুযোগ পাই। সেই সময়ের প্রেক্ষিতে তখন এটা ছিল আমার জন্য বিরাট সুযোগ। আসলে তখন ইন্ডাস্ট্রিতে অভিনয়টা এখনকার মতো এত ব্যবসায়িক হয়নি। কাজ করলে শিল্পীমূল্যটা পাওয়া যেত। এখন হয়তো শিল্পীরা তখনের চেয়ে অনেক বেশি টাকা পান; কিন্তু সেই আন্তরিকতা আর সম্মান পাওয়া খুব কঠিন। আমার প্রথম পরিচালক এহতেশাম হলেও ইবনে মিজান আমাকে নায়িকা হিসেবে কাস্ট করেন তাঁর ছবি ‘জংলী মেয়ে’তে। ইবনে মিজানের সঙ্গে পরিচয় হয় ‘আবার বনবাসে রূপবান’ ছবিতে কাজ করার সময়। ওই সময় তিনি আমার কাজ দেখে সন্তুষ্ট হন এবং আশ্বাস দেন তার পরের কোনো এক ছবিতে নায়িকা করবেন। তবে এ ডাক যে এত তাড়াতাড়ি পাব ভাবতে পারিনি। সে সময় দাপুটে পরিচালক ছিলেন এহতেশাম, মোস্তাফিজ। এদের ছবিতে কাজ করা সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল।
‘জংলী মেয়ে’তে কাজ করার সময় একদিন ডাক পাই এহতেশামের ‘চকোরী’তে। তরুণী রত্নার কাছে এটা ছিল চাঁদ হাতে পাওয়া। আর এ ছবি থেকেই আমার নতুন সময়ের শুরু হয়। এহতেশাম আমার রত্না নাম পাল্টে নতুন নাম দেন শাবানা। আমি এখন শাবানা হলেও সেই রত্নাকেও ভুলিনি। আসলে ‘চকোরী’ ছিল আমার নতুন জীবনের প্রথম মাইলস্টোন। ছবিটি আশাতীত ব্যবসা করে। আগের সময়টা কষ্টকর হলেও মনে হয় না তাতে আমার কোনো ক্ষতি হয়েছে।
বাণিজ্যিক ছবিতে আমার রমরমা চাহিদা থাকলেও একশ্রেণির দর্শক ও নির্মাতা আমাকে এড়িয়ে চলতেন। আমার বিরুদ্ধে তাদের সমালোচনার অন্ত ছিল না, আমি বেঁটে, আমার কণ্ঠ ভালো না, আমার হাসি-কান্না আলাদা করা যায় না- ইত্যাদি। এসব সমালোচনার একটা মোক্ষম জবাব দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিলাম। এটা এসে যায় ১৯৭৭ সালে ‘জননী’ ছবিতে জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর। এটা ছিল আমার প্রথম জাতীয় পুরস্কার। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার।
খুব স্পষ্ট মনে আছে, ঘোষণা শুনে আমার চোখে পানি এসে পড়েছিল। এতদিনে আমার কাজের স্বীকৃতি পেলাম। অবশ্য কোনো শিল্পীর জন্য পুরস্কারটাই প্রধান হতে পারে না। তার জন্য বড় পুরস্কার দর্শকদের ভালোবাসা। সেই পুরস্কার আমি অনেক আগেই পেয়েছিলাম। তারপরও পুরস্কার শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করে। কাজ করে যেতে উৎসাহ জোগায়। চলচ্চিত্রশিল্পের সেই আগের পরিবেশ এখন নেই। থাকার কথাও নয়। সময়ের সঙ্গে বদলে যায় সবকিছু। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়ে। সে সময় ইন্ডাস্ট্রিতে সবাই একটা পরিবার হয়ে কাজ করত। সহশিল্পীদের মধ্যে ছিল আন্তরিকতা। ইউনিটের একজন অসুস্থ হলে সবাই তার খোঁজ দিত। পরিচালক ছিলেন পরিবারের বাবার মতো। খুঁটিনাটি সবকিছু তিনিই তদারক করতেন। আমরা কেউ অভিনয়ে খারাপ করলে পরিচালক নিজে সেই অংশ দেখিয়ে দিতেন। আমার অভিনয়জীবনে পরিচালকদের ভূমিকাটা প্রথম। অভিনয়ে আসার আগে আমার এ সম্পর্কে কোনো পড়াশোনা বা ব্যবহারিক জ্ঞান কিছুই ছিল না। আমি যা শিখেছি তার সবটুকুই শিখেছি বিভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে। তারা আমাকে হাত ধরে শিখিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে আমি এহতেশাম ও মরহুম মোস্তাফিজ ভাইয়ের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
আমি মনে করি চলচ্চিত্রশিল্পীদের কার্যক্রম ইন্ডাস্ট্রিনির্ভর হওয়া উচিত। এর মাধ্যমেই তার চিন্তাভাবনা উপস্থাপন, সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারে। আমাদের দেশে পরিচালকরা ভিন্ন ধরনের ছবি করার সাহস করেন না। আমার মনে হয় না আমাদের দেশে মেধাবী শিল্পীর অভাব আছে, ভালো নির্মাতা আর পৃষ্ঠপোষক পেলে এখানেও শিল্পোত্তীর্ণ ছবি তৈরি হতে পারে। তবে ভালো ছবি তৈরির জন্য অবশ্যই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে জরুরিভাবে যে গুণটা থাকা দরকার বলে আমার মনে হয় তা হলো- সহনশীলতা ও পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। আমরা যখন প্রথম এসেছি তখন চলচ্চিত্রে কাজ করা ছিল দুঃসাহসের ব্যাপার। সমাজ বিচ্ছিন্নতার একটা ঝুঁঁকি নিয়ে কাজ করতে হতো। এখনকার মেয়েদের জন্য তো ফিল্মে আসা কোনো ব্যাপারই নয়। সবকিছু সহজ হয়ে গেছে। এখন যারা নতুন আসছে তাদের আমি সানন্দে স্বাগত জানাই।