এবারের ইত্যাদির ঝিনাইদহ পর্ব অনেক দিক থেকেই ব্যতিক্রমী। ইত্যাদির ইতিহাসে এই প্রথম চার ঘণ্টার বৃষ্টি আক্রান্ত ছিল ইত্যাদি। তাই এবারের এই বৃষ্টিভেজা ইত্যাদিতে ইত্যাদির চিরচেনা আলো ঝলমল দৃশ্য না থাকলেও উপস্থাপিত প্রতিটি বিষয়ই ছিল অত্যন্ত শানিত ও মানবিক। বরেণ্য নির্মাতা হানিফ সংকেতের নির্মাণ মুনশিয়ানায় ঝিনাইদহের অতিপ্রাচীন সুদীর্ঘ গৌরবময় ইতিহাসের চিত্র ফুটে উঠেছে পুরো অনুষ্ঠানে। ইত্যাদির মাধ্যমে জানা গেল ঝিনাইদহের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ফকির লালন শাহ, সিরাজ সাঁই, পাঞ্জু শাহ, দুদ্দু সাঁই এসব কীর্তিমান মরমি কবি-সাধকের অবস্থান এই ঝিনাইদহেই। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান, বিপ্লবী বাঘা যতীনসহ তুলে ধরা হয়েছে ঝিনাইদহের কীর্তিমান ব্যক্তিত্বদের। মল্লিকপুরের ১১ একর জমিজুড়ে বিস্তৃত বিশাল বট গাছের নিচে দাঁড়িয়ে হানিফ সংকেত তুলে ধরেছেন এশিয়ার বৃহত্তম বট গাছের চিত্র। ইত্যাদি যে জেলাতেই অনুষ্ঠান করে সেই স্থানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে। আর তাই ঝিনাইদহেও করা হয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম বিশাল দিগন্ত বিস্তৃত কৃষি খামার দত্তনগর কৃষি খামারে। যেখানে উৎপাদিত হয় দেশের ৬০ ভাগ কৃষি বীজ। খামারটির বেশির ভাগই পড়েছে ঝিনাইদহের মহেশপুরে এবং কিছুটা অংশ পড়েছে চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগরে। দত্তনগর কৃষি ফার্মের ওপর নির্মিত প্রতিবেদনটিও ছিল বেশ তথ্যসমৃদ্ধ। ইত্যাদিতে না দেখলে অনেকেই হয়তো এ খামারের বিস্তৃতি এবং গুরুত্বের কথা জানতেন না। ইত্যাদির মাধ্যমে জানা গেল, দেশে একমাত্র ঝিনাইদহ জেলাতেই দুটি কালজয়ী গ্রন্থের নামে দুটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে। একটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’, অন্যটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’।
এবারের পর্বে প্রত্যেকটি নাটিকা ছিল বক্তব্যধর্মী। প্রতিটি বিষয় বাস্তব ও সময়োপযোগী। ঝিনাইদহের ব্র্যান্ডিং পণ্য কলা আর পান নিয়ে করা দর্শক পর্বটি ছিল বেশ উপভোগ্য। গান গেয়েছেন ঝিনাইদহের মহেশপুরের সন্তান কণ্ঠশিল্পী মনির খান। গানটি লিখেছেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, সুর করেছেন কিশোর দাস। আর এক মরমি কবি পাগলা কানাইয়ের একটি জনপ্রিয় গান গেয়েছেন তসিবা ও সেলিম চৌধুরী। সংগীতায়োজন করেছেন মেহেদী। ঝিনাইদহকে নিয়ে ছিল স্থানীয় নৃত্যশিল্পীদের মন দোলানো নৃত্য। গানটি লিখেছেন ঝিনাইদহের সন্তান গীতিকার মনিরুজ্জামান পলাশ। ৩০ মে বিশ্ব সমুদ্র সিংহ বা সি লায়ন দিবস উপলক্ষে বিদেশি পর্বে ছিল সান ডিয়েগোর প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে থাকা সমুদ্র সিংহদের ওপর একটি তথ্যসমৃদ্ধ প্রতিবেদন। দুজন সমাজ সচেতন সমাজকর্মী জহির রায়হান ও মো. নাজমুলকে তুলে ধরা হয়েছে। আর্থিক অসচ্ছলতা সত্ত্বেও যাদের রয়েছে মানবিক মন। পেশায় একজন রংমিস্ত্রি হলেও জহির রায়হান পথিকদের জন্য গাছ লাগান, নলকূপ স্থাপন করেন, পাখিদের তৃষ্ণা মেটাতে পানির ব্যবস্থা করা, দেয়ালে দেয়ালে মনীষীদের উক্তি লেখাসহ পরিচালনা করেন একটি গ্রন্থাগার। তার এসব কাজে সহায়তা করার জন্য ১ লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয়। মহেশপুরের ভবনগরে প্রায় ২০০ কালোমুখো হনুমান রয়েছে। যাদের বিচরণ গাছের ডালে ডালে। অভুক্ত এই প্রাণীগুলোকে নিয়মিত কলা, রুটি আর বাদাম খাওয়ান মানবিক মানুষ মহেশপুরের নাজমুল। জহির রায়হান আর নাজমুলের প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা অনেককেই অনুপ্রাণিত করবে- এখানেই ইত্যাদির সার্থকতা। এবারের ইত্যাদির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মানবিক প্রতিবেদন ছিল চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার পাহাড়ি এলাকা তালবাড়িয়া ত্রিপুরাপাড়ার চরম পানির সংকট নিয়ে করা প্রতিবেদনটি। এই পাড়ার প্রায় ১ হাজার মানুষ দুই যুগ ধরে চরম পানি সংকটে আছেন। পাড়াপ্রধান সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘কেউ তাদের কথা পাত্তা দেয় না। অথচ মাত্র ৪ লাখ টাকায় একটি সোলার পদ্ধতিতে চালিত ডিপ টিউবওয়েল দিলেই সব সমস্যার সমাধান হতো।’ ইত্যাদির টিমকে দেখে তারা আশান্বিত হন। হানিফ সংকেত তাদের কষ্টের কথা শোনেন, পানি সমস্যার সমাধানের জন্য স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে ৪ লাখ টাকা তুলে দেন। এভাবেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে ইত্যাদি শুধু সমস্যা তুলেই ধরে না, তার তাৎক্ষণিক সমাধানেরও চেষ্টা করেন। ধন্যবাদ হানিফ সংকেত।