দেশে মেইনস্ট্রিমের চলচ্চিত্র যেখানে দিনদিন হতাশায় ডুবাচ্ছে, সেখানে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো যেন আশার প্রদীপ হয়ে জ্বলছে- এমনটাই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশিবিদেশি বিভিন্ন উৎসবে এরই মধ্যে বাংলাদেশের একাধিক স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা অংশ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছে। সুনাম বয়ে নিয়ে এসেছে দেশের জন্য। এটি বাংলাদেশ তথা দেশি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্য ইতিবাচক। এ ধারা অব্যাহত থাকলে স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমায় পেশাদার শিল্পীদের উপস্থিতিও আগামীতে দেখা যাবে বলে অনেকের বিশ্বাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, পেশাদার শিল্পী ও নির্মাতারা স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণে এগিয়ে এলে আরও ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়বে। এদিকে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের তৃপ্তির কথা হলো- ‘বিশ্ব সিনেমার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ উৎসব ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ আমাদের ঘরানার ছবিগুলো প্রায় প্রতি বছর স্থান করে নেয়। সর্বশেষ গত আসরে শর্টফিল্ম কম্পিটিশন বিভাগে জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবি ‘আলী’। ১৫ মিনিট দৈর্ঘ্যরে ছবিটি পরিচালনা করেছেন আদনান আল রাজীব। শুধু এ সিনেমা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন উৎসবে বাংলাদেশের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাগুলো স্থান করে নিচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ইতোমধ্যে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে আহসান স্মরণ পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘আকাশে’, আবীর ফেরদৌস মুখরের ‘সুব্রত সেনগুপ্ত’, মাহমুদুল হাসান আদনানের ‘দ্য স্কাই গেটস গ্লুমি অ্যাট নাইট’, মাহমুদ হাসানের ‘ইতিবৃত্ত কিংবা বাস্তবতার পুনরারম্ভ’, ফুয়াদুজ্জামান ফুয়াদের ‘শব্দের ভেতর ঘর’, ভিকি জাহেদের ‘একটি খোলা জানালা’সহ আরও কিছু এই ধারার ছবি। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎসবে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের একাধিক স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা। এর মধ্যে একটি ‘সওদা’। নেপাল ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ষষ্ঠ আসরে অংশ নেয় এটি। ফকির বিপ্লব পরিচালিত সিনেমাটি শর্টফিল্ম বিভাগে সেরার পুরস্কার জিতে নিয়েছে। ২০২৪ সালে এটি কলকাতা রামধনু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় এবং সেখানেও দর্শকদের প্রশংসা কুড়ায়। এ ছাড়া এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছে, পুরস্কারও জিতেছে। একই উৎসবে অংশ নিয়ে প্রশংসিত হয় আরও দুটি সিনেমা ‘অ্যা স্লেইল উইদাউট শেল’ ও ‘দ্য টেস্ট অব হানি’। এ ছাড়া গত বছরের শেষ দিকে ইতালির তেরনি চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা শর্টফিল্মের পুরস্কার জিতেছে ‘দ্য টেস্ট অব হানি’। এটি নির্মাণ করেন ফাবিহা মনির ও মোহাম্মদ রকিবুল হাসান। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব, ফ্রান্সের দশম টুলুজ ইন্ডিয়ান সিনেমা ফেস্টিভ্যাল এবং কানাডার ১৪তম সাউথ এশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব মনট্রিয়েলে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশের শর্টফিল্ম ‘দাঁড়কাক’। এটি নির্মাণ করেছেন জায়েদ সিদ্দিকী। এটি আরও একাধিক আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। ভেনিস ইন্টারকালচার ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বুদাপেস্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অনারেবল মেনশন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে দুটি শর্টফিল্ম ‘ছুরত’ ও ‘আনটাং’। ভারতের কালাকারি চলচ্চিত্র উৎসবে সাড়া ফেলে রনি তানভীরের ছোট ছবি ‘টুগেদার’। অস্ট্রেলিয়ার সোলাস্টা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে আমন্ত্রণ পায় নির্মাতা সাদেক সাব্বির পরিচালিত শর্টফিল্ম ‘দ্য লাস্ট ওয়ার্ড’ ও বুলগেরিয়ার গোল্ডেন ফেমি চলচ্চিত্র উৎসবের চতুর্থ আসরে নির্বাচিত হয় কে এম সোহাগ রানা পরিচালিত ‘অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড’।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলা ছবিতে যে বাণিজ্যিক ধারা শুরু হয়েছিল, তাতে বড় পরিবর্তন আসে আশির দশকের মধ্যভাগে। এ সময়ে আমাদের চলচ্চিত্রে এলেন একঝাঁক তরুণ মেধাবী ও শিক্ষিত নির্মাতা। আলমগীর কবিরের নেতৃত্ব বা পৃষ্ঠপোষকতায় এ সময় তাঁরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের উত্থান ঘটালেন। মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, মোস্তফা কামাল, তারেক মাসুদরা এসে মূলধারার বাইরে গিয়ে বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের আন্দোলন গড়ে তোলেন। স্বল্পদৈর্ঘ্যরে প্রথম ছবি ‘আগামী’র কাজ শুরু হয় ১৯৮২ সালে এবং এটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। ওই সময় তরুণদের কাছে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবিগুলো ব্যাপক সাড়া জাগায়। বিশেষ করে আশির দশকের শেষ ভাগে যখন দেশীয় চলচ্চিত্র শৈল্পিকতা পরিহার করে অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক হয়ে দাঁড়ায় তখন রুচিশীলদের জন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানালেন মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, তারেক মাসুদ, আবু সাইয়িদরা। তাদের পথ ধরে এগিয়ে এলেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা প্রমুখ। শৈল্পিক চলচ্চিত্র নির্মাণে তারাও দেখালেন মুনশিয়ানা। এরপর এলেন আবু শাহেদ ইমন, আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদরা। আমাদের এসব স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র কান, বুসানে যাচ্ছে, বিদেশে পুরস্কৃত
হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের কিছু শিক্ষার্থীও ভালো কিছু ছবি নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে ঝুমুর আসমা জুঁই, নিলাসহ আরও কয়েকজন আছেন। ওদের চলচ্চিত্র বিদেশেও গেছে। আশির দশকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কিছু তরুণ কর্মী ১৬ মিমিতে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের একটা সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থিত হলেন। এসব ছবির বিষয়বস্তু থেকে নির্মাণ পদ্ধতি, প্রদর্শন ব্যবস্থা, সবকিছুই ছিল বিকল্প। ছবিগুলোর বিষয়বস্তু ছিল একেবারেই নতুন। গরুর গাড়িতে করে একটা মৃতদেহ নিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘোরা হচ্ছে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে। এ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম ‘চাকা’, এর নির্মাতা হলেন মোরশেদুল ইসলাম। এরপর এ ধারার চলচ্চিত্রটি হলো- পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ববঙ্গের একটা মফস্বল শহরে একটা হিন্দু পরিবারের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসার গল্প নিয়ে ‘চিত্রা নদীর পারে’। সব বিচারেই এসব স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র ছিল বিকল্পধারার। এই বিকল্প প্রক্রিয়াটি আরও জোরদার হয় ‘আগামী’, ‘হুলিয়া’, এ দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি থেকেই। এ ঘরানার চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান তখন চালু ছিল না। এক্ষেত্রে সরকারি অনুদান দেওয়া শুরু হয় ২০২০ সাল থেকে। আগে নির্মাতারা তাই অর্থের স্বল্পতার অভাবটা মেটাতেন শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে, সৃজনশীলতা দিয়ে। বলা যেতে পারে, এসব ছবি অনেকটাই বস্তুগত সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে মানসিক শক্তির, মাইন্ড-ওভার-ম্যাটারের বিষয়। অর্থের যে কমতি, তা পুষিয়ে নেওয়া হতো শ্রমশক্তি দিয়ে। কথাগুলো বললেন চলচ্চিত্র নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল। এই নির্মাতা আরও বলেন, মূলত অর্থের অভাবের কারণেই আমাদের ছবিগুলো নির্মাণে দীর্ঘ সময় লেগেছে। এখনো লাগে। তারেক মাসুদ আর আমার মাঝে একটা কৌতুক ছিল। আমরা বলাবলি করতাম, বাংলাদেশে আমাদের জন্য ‘সিনেমা দেরিতে’ হচ্ছে ‘সিনেমা দেরিতে’। তারেকের ‘আদম সুরত’ ছবিটা বানাতে সময় লেগেছিল সাত বছর, ‘আমার স্মৃতি ১৯৭১’ ছবিটিও সাত বছর ধরে তৈরি, আর ‘নদীর নাম মধুমতী’ লেগেছিল পাঁচ বছর। দেরির মূল কারণ, প্রচণ্ড অর্থাভাব। করপোরেট পুঁজি আমাদের অর্থ দেয় না। আমরাও তাদের কাছে যেতে চাই না। আমাদের অধিকাংশ ছবিই তৈরি হয়েছে অনেক অনেক মানুষের দান, অনুদান ও ঋণ নিয়ে। ফলে কৃতজ্ঞতার টাইটেল কার্ডটা তো দীর্ঘ হবেই। এত বেশি মানুষের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হয়। এ এক ধরনের অঘোষিত ক্রাউড-ফান্ডিং বা গণ-অর্থায়ন এবং এটা আমরা শুরু করেছি ক্রাউড-ফান্ডিং শব্দটা প্রচলিত হওয়ার বহু আগে থেকেই। সেই প্রায় সিকি শতাব্দী আগে থেকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রাউড ফান্ডিংয়েও আমরা ছবি করেছি। যেমন আমার ‘সীমান্তরেখা’ ছবিটি। বাংলাদেশে এই-ই প্রথম গণ-অর্থায়ন বা ক্রাউড-ফান্ডিংয়ে একটা বড় প্রামাণ্যচিত্র সম্পন্ন হলো। আবু সাঈদ ওঁর ‘একটি কবির মৃত্যু’ স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির জন্যও গণ-অর্থায়ন করে কিছু সফলতা পেয়েছেন। অন্যরাও পান। আমার ‘রূপসা নদীর বাঁকে’ চলচ্চিত্রটিও গণ-অর্থায়ন বা ক্রাউড-ফান্ডিং নির্ভর। আরেকটি বিষয় হলো- আমি সব সময় বিশ্বাস করে এসেছি, একটা ছবির চিত্রনাট্যের দৈর্ঘ্য যতখানি হবে, ঠিক ততটা দৈর্ঘ্যই, সে ছবির জন্য ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য’। কখনোই তা বাণিজ্যিক সিনেমা সার্কিট বা টেলিভিশন শ্লটের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অনুযায়ী নয়। আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য ‘হুলিয়া’ মাত্র আঠাশ মিনিটের ছবি। মোরশেদুল ইসলামের ‘আগামী’ মাত্র পঁচিশ মিনিটের। আবার ‘আমার স্মৃতি ১৯৭১’ ছবিটা তিন ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের। আমরা কোনো দিনই পুঁজির বেঁধে দেওয়া বাণিজ্যিক দৈর্ঘ্যে বিশ্বাস করিনি। দৈর্ঘ্যরে স্বাধীনতা আমাদের কাছে শিল্পীর স্বাধীনতারই অংশ। হুলিয়া, চিত্রা নদীর পারে, অগ্নি যমুনা, বিস্মরণের নদী, ইতি সালমা, ফুল কুমার, শিলালিপিসহ বাংলাদেশে নির্মিত বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র সাধুবাদ পেয়েছে। তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, তারেক মাসুদ, শামীম আখতার, এ কে এম জাকারিয়া, রাশেদ চৌধুরী, আশিক মোস্তফা প্রমুখ নির্মাতা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নান্দনিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে খ্যাতি লাভ করেছেন। স্বল্পদৈর্ঘ্যরে চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, মুক্তির কথা বলব। আমাদের ভয় ছিল, সিনেমা হলো ১৬ মিলিমিটারে গ্রহণ করবে কি না। আমরা বিকল্পভাবে যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমরা নিজেরাই দর্শকদের দেখাব, যে কোনো জায়গায় প্রদর্শনী করা যাবে, এমন সিনেমা বানাতে চেয়েছিলাম। পরে ‘আগামী’ সিনেমাটির প্রথম প্রদর্শনীতে দর্শকদের জায়গা দিতে পারিনি। একটির বদলে তিনটি শো করা হয়েছিল। এরপর সারা দেশে আগামী দেখিয়েছি। সিনেমাটি দর্শক গ্রহণ করেছিলেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির জন্য এটাই ছিল বড় সফলতা।’