একসময় এ দেশে মঞ্চনাটক ও যাত্রাপালা ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় বিনোদন। শহর কিংবা মফস্বল- সব জায়গাতেই মঞ্চনাটক ও যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হতো। দর্শকপ্রিয় অনেক যাত্রাপালা ও মঞ্চনাটক নিয়ে তৈরি হতে থাকে সিনেমা। এমন কয়েকটি জনপ্রিয় সিনেমার কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
মুখ ও মুখোশ [১৯৫৬]
মুখ ও মুখোশ মূলত আবদুল জব্বার খানেরই লেখা মঞ্চনাটক ডাকাতের চলচ্চিত্ররূপ। আবদুল জব্বার খান অনেকটা জেদের বশেই ঢাকার প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন মূলত নাট্যাঙ্গনের লোক। নিজে নাটক লিখতেন এবং পরিচালনাও করতেন। ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মুখ ও মুখোশ’ মূলত তারই লেখা মঞ্চনাটক ডাকাতের চলচ্চিত্ররূপ।
ধারাপাত [১৯৬৩]
‘ধারাপাত’ সিনেমাটি নির্মাণ করা হয় আমজাদ হোসেনের একটি মঞ্চসফল নাটক থেকে। ঢাকার চলচ্চিত্রের শুরুর দিকের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকার সালাহউদ্দিনও ছিলেন বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব। পরে তিনি চলচ্চিত্রে আগ্রহী হন। যে নদী মরুপথে (১৯৬১) এবং সূর্যস্নান (১৯৬২) নির্মাণের পর তিনি নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সালাহউদ্দিন প্রোডাকশন্স প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম ছবি ‘ধারাপাত’। ছবিটি তিনি নির্মাণ করেন আমজাদ হোসেনের একটি মঞ্চসফল নাটক থেকে।
১৩নং ফেকু ওস্তাগার লেন [১৯৬৬]
ষাট ও সত্তর দশকের জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা খান জয়নুল রচিত মঞ্চনাটক ‘শান্তি নিকেতন’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র সম্পাদক বশীর হোসেন নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’। কেবল হাস্যরসকে ভিত্তি করে চলচ্চিত্র, যাকে বলে বিশুদ্ধ কমেডি ফিল্ম ঢাকায় খুব বেশি নির্মিত হয়নি। এ স্বল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রের মধ্যে সেরাটিকে বেছে নিতে বললে অনেকেই এ চলচ্চিত্রটিকে বেছে নেবেন। চলচ্চিত্রটিতে অন্যতম একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন খান জয়নুল। চলচ্চিত্রটির কাহিনিকারও তিনি। আর সেই কাহিনি লেখেন তারই জনপ্রিয় মঞ্চনাটক শান্তি নিকেতন অবলম্বনে।
রূপবান [১৯৬৫]
ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে ‘রূপবান’ নামে একটি যাত্রাপালা খুব সুনাম অর্জন করে। দেশের আনাচে-কানাচে এই যাত্রা মঞ্চস্থ হতে থাকে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সালাহউদ্দিন একদিন মফস্বলের এক গ্রামে গিয়ে সারা রাত জেগে এই যাত্রা দেখলেন। দেখে উপলব্ধি করলেন, গল্পে ও নাটকীয়তায় মাটির গন্ধ আছে বলেই হয়তো দর্শকের কাছে এর এত আকর্ষণ। তা ছাড়া এতে আছে হৃদয়গ্রাহী লোকসংগীতের ব্যবহার। এসব চিন্তাভাবনা করে এই জনপ্রিয় লোকগাথাটিকে সিনেমার পর্দায় তুলে আনার সিদ্ধান্ত নেন সালাহউদ্দিন। তবে যাত্রাপালার বিষয় চলচ্চিত্র হিসেবে দর্শকের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে তা নিয়ে সালাহউদ্দিনের মনে একটা সংশয় ছিল। তবু তিনি সব সংশয় আর উদ্বেগ ফেলে কিছু টাকা জোগাড় করে ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করলেন। ‘রূপবান’ ১৯৬৫ সালে মুক্তি পেল এবং প্রবল জনপ্রিয়তায় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে রইল।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা [১৯৬৭)
নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাহিনি রচনা করা হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে লেখা পাঁচটি নাটক থেকে। বাংলাদেশে ইতিহাসভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা। একই সঙ্গে এ চলচ্চিত্রটিতেই প্রথমবারের মতো বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা উপস্থাপন করা হয়, বেশ কৌশলে যদিও। মূলত সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বাঙালির স্বাধীন চেতনার প্রতীক এ ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন পরিচালক খান আতাউর রহমান। আর সে জন্য তিনি কাহিনি রচনা করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে লেখা পাঁচটি নাটক থেকে। এ পাঁচ সিরাজউদ্দৌলার নাট্যকাররা হলেন-
অক্ষয় মৈত্র, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মো. নেজামতুল্লা ও সেকান্দর (সিকান্দার) আবু জাফর। ১৯৬৭ সালে ছবিটি মুক্তি পেয়ে রীতিমতো সাফল্যের অনন্য ইতিহাস রচনা করে।
সাত ভাই চম্পা [১৯৬৮]
সাত ভাই চম্পা ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায়। এর আগে এটি ছিল মঞ্চনাটক ও যাত্রাপালা। চলচ্চিত্রটি ব্যবসাসফল হয়। এটি পরিচালনা করেন দীলিপ সোম। চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখেন খান আতাউর রহমান। প্রযোজনা করেন মিজানুর রহমান বুলেট। সংগীত পরিচালনা করেন আমির আলী। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন- কবরী ও আজিম। চলচ্চিত্রটিকে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট সর্বকালের সেরা দশটি বাংলা চলচ্চিত্রের মধ্যে স্থান দিয়েছে।
বেদের মেয়ে জোসনা [১৯৮৯]
যাত্রাপালা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত এবং অঞ্জু ঘোষ ও ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত ১৯৮৯ সালের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ নির্মিত হয়েছে। যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল সিনেমা হিসেবে স্বীকৃত। অঞ্জু ঘোষ ও ইলিয়াস কাঞ্চন অভিনীত এ চলচ্চিত্রটি ব্লকবাস্টার হিট হয় এবং এটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক দর্শক টানার রেকর্ড গড়ে।
কীত্তনখোলা [২০০০]
সেলিম আল দীনের আরেক বিখ্যাত নাটক কীত্তনখোলা (১৯৮৬)। নাটকটি থেকে আবু সাইয়ীদ ২০০০ সালে নির্মাণ করেন একই নামের এ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি মোট ৯টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেয়।
চাকা [১৯৯৩]
স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নাট্যকার সেলিম আল-দীন। তিনি কেবল একজন শক্তিশালী নাট্যকারই নন। তাঁর নাটকগুলোও বেশ দুরূহই বটে। এই দুরূহতা দুই অর্থেই; সেগুলো সম্যক উপলব্ধি করাটা যেমন দুরূহ, মঞ্চস্থ করাটাও তেমনি। অথচ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে মোরশেদুল ইসলাম তাঁর তেমনই এক নাটক ‘চাকা’কে (১৯৯৩) একই নামে চলচ্চিত্রায়িত করেন। চলচ্চিত্রটি জার্মানির মানহাইম-হাইডেলবার্গ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে একটি সম্মাননা পুরস্কারও লাভ করে।