রক অ্যান্ড রোলের রাজা এলভিস প্রিসলি। শুধু গান দিয়ে নয়, ব্যক্তিত্বের আবেদন, পোশাক, স্টাইল সব মিলিয়ে প্রিসলি যেন ছিলেন এক গল্পের রাজকুমার। আমাদের দেশেও তেমন একজন ‘এলভিস প্রিসলি’ ছিলেন। গান করতেন। ছিলেন নায়ক। ব্যক্তিত্ব, পোশাক, স্টাইল সব মিলিয়ে ছিলেন এক গল্পের রাজকুমার। তিনি আর কেউ নন প্রয়াত চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল। ভক্তরা তাঁকে বলতেন, বাংলার এলভিস প্রিসলি। হয়তো তিনি নিজেও প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রিসলিতে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যে কজন বড়পর্দার অভিনেতা এসেছিলেন, নায়ক হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম জাফর ইকবাল। তিনি তাঁর সময়ের তুলনায় এগিয়ে ছিলেন। ফ্যাশনে, শরীরী ভাষায়। নায়ক হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও সংগীতশিল্পী হয়ে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এ চিরসবুজ তারকা। অভিজাত পরিবারের ছেলে জাফর ইকবাল। ঢাকার গুলশানে জন্ম। জাফর ইকবালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন সংগীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। এক স্মৃতিচারণায় কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘জাফর ইকবাল দারুণ স্মার্ট ছিলেন। শুধু পোশাকে নয়, রুচিবোধ, ইনটেলেকচুয়াল হাইট, ফ্যাশন সচেতনতা সবই ছিল নজরকাড়ার মতো। এই অঙ্গনে আর কারও মধ্যে এ রকম দেখিনি। আমি নিজেই দেখেছি, তাঁর বাসার ‘শু’ র্যাকে ৩০০ রকমের জুতা। জুতা রাখার আলাদা একটা কর্নার ছিল। জুতার সঙ্গে মিল রেখে ড্রেস পরতেন। এখনকার কোনো নায়কের মধ্যেও এমন ফ্যাশন সচেতনতা আছে কি না, জানি না।’ দুর্বলতা ছিল ব্র্যান্ডের জামা, দামি সিগারেট আর পারফিউমে। দিনে ছয়বার জামা পালটাতেন আর সাত ধরনের পারফিউম ব্যবহার করতেন। ক্যামেরার সামনে বা বাস্তব জীবনে জাফর ইকবালের পোশাকেও ছিল স্বতন্ত্র, জিন্সের সঙ্গে ছোট হাতা টি-শার্ট গায়ে কোনো নায়ককে তাঁর আগে দেখা গেছে বলে মনে হয় না। এন্ডি গিবদের মতো পশ্চিমা সেলেব্রিটিরা পরতেন তেমন টি-শার্ট। সে সময় ঢাকার তরুণেরা মার্কেটে গিয়ে নাকি বলতেন, জাফর ইকবাল মার্কা শার্ট দেন। নায়ক ও গায়ক জাফর ইকবাল ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সুদর্শন এই নায়ক সিনেমায় আসার আগেই গায়ক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তাঁর সময়ে সবচেয়ে স্মার্ট ও স্টাইলিশ নায়ক বলা হতো তাঁকে। ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’ গানটি শুনেননি এমন মানুষ কমই পাওয়া যাবে। গানটির গায়ক জাফর ইকবাল। ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ এ গানটিও এদেশে বেশ জনপ্রিয়। এ গানটি নায়করাজ রাজ্জাক পরিচালিত ‘বদনাম’ সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছিল। জাফর ইকবালকে দিয়ে গানটি করানোর নেপথ্যের গল্প বলতে গিয়ে রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘কেন জানি আমার মনে হয়েছিল এই স্যাড গানটি জাফর ইকবাল ছাড়া আর কেউ পারফেক্টলি গাইতে পারবে না। যখন জাফরকে গানটি দেখালাম তখন ওর চোখের কোণে অশ্রু জমে উঠেছিল। কারণ আমি জানতাম ও ছিল খুবই অভিমানী এবং আবেগপ্রবণ একজন ছেলে। যা হোক গানটি অসাধারণ দরদ দিয়ে গাইল ও। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, গাইবার পর অঝোরে কান্না শুরু করল সে। আমি ও সংগীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজসহ ইউনিটের সবাই মিলে অনেক কষ্টে তাঁর কান্না থামালাম।’ আরও অনেক গানই গেয়েছিল জাফর ইকবাল। আসলে নায়ক ও গায়ক হিসেবে ছিল তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তা। একজন মানুষ নায়ক হিসেবে সব মানুষের কাছে ভালোবাসা কুড়িয়েছেন, একই সঙ্গে গায়ক হিসেবেও ভালোবাসা ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ষাটের দশকে জাফর ইকবাল ঢাকায় একটি ব্যান্ড দল গড়ে তোলেন। নাম ছিল- রোলিং স্টোন। তবে, সিনেমায় আসার পর গান গাওয়া কমে যায় জাফর ইকবালের। ব্যস্ততা বেড়ে যায় সিনেমায়। কতটা সুদর্শন, কতটা স্টাইলিশ ছিলেন, তা তার অভিনীত সিনেমা দেখেই অনুমান করা যায়। ঢাকাই সিনেমার স্টাইলিশ নায়ক ও চিরসবুজ নায়কও বলা হতো তাঁকে। তাঁর মননে ছিল আধুনিকতা। পশ্চিমা, আন্তর্জাতিক সংগীত তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। তাই গিটারে হাত পাকিয়ে নেমে পড়েন ব্যান্ড মিউজিকে। ১৯৬৭ সালে বন্ধুদের নিয়ে ‘র্যাম্বলিং স্টোনস’ নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেছিলেন জাফর ইকবাল। এই ব্যান্ডের হয়ে বহু কনসার্ট করেছিলেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, কনসার্ট করতে গিয়েই তাঁর নায়ক হওয়ার জার্নির শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে এক অনুষ্ঠানে তিনি যখন মঞ্চে গিটার বাজিয়ে গলা ছেড়ে গাইছেন, তখন দর্শক সারিতে বসা নন্দিত নির্মাতা খান আতাউর রহমান। স্টেজের সেই সুদর্শন তরুণের মাঝে তিনি দেখতে পান আগামীর চিত্রনায়ককে। তাই নিজের সিনেমা ‘আপন পর’-এ জাফর ইকবালকে কাস্ট করেন। আর এভাবেই গায়ক থেকে নায়ক হয়ে ওঠেন জাফর ইকবাল। প্রায় ১৫০ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন এই অকালপ্রয়াত নায়ক। তুমুল জনপ্রিয়তা আর সাফল্য পেলেও ব্যক্তিজীবনে নায়িকা ববিতার সঙ্গে প্রেমে ব্যর্থ হওয়ায় শান্তির দেখা পাননি জাফর ইকবাল। তাই মানসিক অবসাদে আক্রান্ত হন। অভ্যস্ত হয়ে পড়েন অনিয়ন্ত্রিত জীবনে। যার ফলে মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। নষ্ট হয়ে যায় তাঁর হার্ট ও কিডনি। ফলে ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।