'সময় থাকতে হাঁইটা চল দেরি কইরো না...'। সত্যি দেরি করেননি অাঁখি আলমগীর। বয়স তখন কাঁচা রোদের সীমানা ছাড়ায়নি। গানটি নিয়ে হাজির হলেন 'ভাত দে' ছবিতে। একই সঙ্গে তুখোড় অভিনয়। নির্মাতা আমজাদ হোসেন বাকরুদ্ধ। বলেই ফেললেন এই 'মেয়ে একদিন ঝড় তুলবে'। গুরুর কথাই সত্যি হলো। সময় বেশি দূর গড়ায়নি। এই ছবিই হাতের মুঠোয় এনে দিলো জাতীয় সম্মাননা। ওইটুকু বয়সে জাতীয় সম্মান তার বোধকে করে তোলে শাণিত। বাবা অভিনেতা আলমগীর আর মা খোশনূর আলমগীরের চোখে আনন্দ-অশ্রু। সেই সুখের অশ্রুকে এখনো শুকাতে দেননি অাঁখি। সপ্তসুর তার কণ্ঠমালা হয়েই আছে।
গান আমার প্রাণ... বলতে বলতে তার দৃষ্টি হারায় সপ্তর্ষী মণ্ডলে। তারার দেশের একজন হয়ে আছেন নিজেও। তাই হয়তো এই নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়া। সম্বিত ফিরে এলে কঠিন কথাটা সাদামাঠা করেই বলেন, 'অভিনয় করলাম, মডেল হলাম- সবই হলো; কিন্তু গানটা প্রাণে বড় বাজে। গান ছাড়া আমি আর প্রাণ ছাড়া পাখি যেন একই উপমা। গানকে মনের ঘরে শক্ত করে বেঁধে নিয়ে হেঁটে চলেছি। এই হাঁটার শেষ নেই।
মা বলতেন গলায় সুর থাকলে জীবন বর্ণময় হয়। জীবনের আকাশে রঙধনু সাত রঙের ভেলা ভাসায়। মায়ের কথাই সত্যি। আমি এখন রঙের আকাশে ডানা মেলে সুরের সপ্তডিঙায় ভেসে বেড়াচ্ছি। আহা, কি যে পরম সুখ...। এই সুখের নেই কোনো সীমানা।
খালামনি বেনু আহমেদ হারমোনিয়ামে আঙ্গুল বসিয়ে গলার ভাঁজে সপ্তসুর এঁকে দেন।
ওস্তাদ সৈয়দ শামসূল হুদা, আখতার সামদানি, সঞ্জীব প্রমুখরা সেই সুরে এনে দেন পূর্ণতা।
সকালের কাঁচারোদ বড় প্রিয়। রোদের সিঁড়িতে প্রতিদিন তির তির করে বেড়ে ওঠা।
গান তো সাধনার বিষয়। সাধনার সাধ বড় তৃপ্তিময়। ভোরে উঠে এখনো গলা সাধি। চর্চাটা গানকে বাঁচিয়ে রাখে। এ সত্যিটা বুঝতে হবে। পরম সত্যি বটে।'
অাঁখি বলেন, গান আসে প্রকৃতির সিঁড়ি বেয়ে। প্রকৃতিকে ভালোবাসার মধ্যেই গানের স্থায়িত্ব। ফুল আর পাখি গানের অনুষঙ্গ। প্রজাপতি পাখা মেলে রঙিন ফুলে। দেখলেই মনটা রোমান্টিকতায় ভরে ওঠে। ওদের দেখে গলায় ঝির ঝির করে বইতে থাকে গানের হাওয়া। বড় সুরেলা হয় কণ্ঠ। ফুল, পাখি আর প্রজাপতিও যেন গানের টানে রোমান্টিক হয়ে ওঠে। আহা কি যে আনন্দ।
পুরস্কার মানে হাতে একটা ট্রফি উঠে আসা নয়। শ্রোতার মনে চিরদিনের আসন পেতে নেওয়াই সত্যিকারের অর্জন। এই অর্জন কতটা পেয়েছি তার হিসাব করা বড় কঠিন।
এভাবেই অাঁখির বিনয়ী উচ্চারণ।
শেষ বিকেলে ক্লান্ত পাখিরা নীড়ে ফিরে। গান নিয়ে অাঁখির ক্লান্তি নেই। বেলা শেষে ঘরে ফেরার তাড়াও নেই। শেখার অনেক বাকি রয়ে গেছে তার। সেই পুরনো কথা- 'শেখার কোনো শেষ নেই।' অাঁখির তাতেই বিশ্বাস। তার বিশ্বাস নিরেট খাঁটি। তাই তো সুরের পাখি হয়ে আছেন তিনি।
সবার আগে গান। তারপর অন্য কিছু। মা-বাবা শিল্পী। তারা উজ্জ্বল নক্ষত্র। সে তুলনায় আমি জলের তলে ছোট্ট নুড়ি। তাদের মতো বিশাল হয়ে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তবে গর্বে বুক ভরে আছে। তাদের পরম মমতার ছায়ায় বেড়ে উঠতে পেরেছি। মা-বাবার পথ ধরে হাঁটতে পারছি। জীবনে এর চেয়ে পরম পাওয়া আর কি হতে পারে।
একদিকে মা-বাবার আদরের ছায়া অন্যদিকে গানের মায়া। জড়িয়ে আছি কি এক অপরূপ মমতায়। এই মমতার শেষ নেই। গানের রাজ্যে আমার নিত্য বসবাস। সুরের ভুবনে আজীবনের বাসিন্দা হয়ে থাকতে চাই...।