নানা সমস্যায় জড়িয়ে গেছে মঞ্চনাটক চর্চা। তাই এগিয়ে যেতে পারছে না শিল্পচর্চার এই মাধ্যমটি। একদিকে আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ত বিচরণ। অন্যদিকে ভিজুয়াল মিডিয়ার দোর্দণ্ড প্রতাপ। সব কিছু মিলিয়ে মঞ্চ একটি নাজুক অবস্থানে থাকলেও এই মাধ্যমটির সমৃদ্ধিতে এগিয়ে আসছে না খোদ নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্তরাও। মঞ্চনাটককে উপজীব্য করে নাট্যাঙ্গনে যারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত রয়েছেন নাটকের উন্নয়নে ও সমৃদ্ধিতে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। নাটকের অভিভাবক সংগঠনের পরিচয় নিয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান নামের একটি সংগঠন থাকলেও তাদের কাজটা কী এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে নাট্যকর্মীদের মাঝে। নাটককে পুঁজি করে নিজেদের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখলেও নাটকের উন্নয়নে কিছু করছে না বলে ফেডারেশানের কর্তাব্যক্তিদের প্রতি ক্ষোভের শেষ নেই সাধারণ নাট্যকর্মীদের। একদিকে নানা সমস্যায় জর্জরিত নাট্যাঙ্গন অন্যদিকে আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ততা ও প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত উৎকর্ষতার কারণে নাট্যচর্চার এই অঙ্গনটি বর্তমানে জৌলুসহীন। নাটকের দলের তুলনায় মিলনায়তনের অপ্রতুলতা, দিনে দিনে দর্শকদের অনাগ্রহ, নারী নাট্যকর্মীর অভাব ও পোশাদারিত্বের অভাবে নাটকের পাঠশালা বলে খ্যাত মঞ্চনাটক বর্তমানে ঐতিহ্য থেকে অনেকাংশেই বিচ্যুৎ। একান্ত ভালোলাগা, অনুরাগ ও ভালোবাসার কারণে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেও যেসব দল এখনো নিয়মিত থিয়েটার চর্চা করছে মিলনায়তনের অপ্রতুলতার কারণে সেসব দলের থিয়েটার চর্চাও ব্যাহত হচ্ছে মারাত্দকভাবে। অন্যদিকে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক পরিচয়ের অনুপ্রবেশের কারনেও কলুষিত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে অহঙ্কার করার এই ক্ষেত্রটি। ঢাকা থিয়েটার, আরণ্যক, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়, নাগরিক নাট্যাঙ্গন, লোক নাট্যদল [সিদ্ধেশ্বরী], থিয়েটার, সুবচন নাট্য সংসদ, সময় নাট্যদল, প্রাচ্যনাট, পদাতিক ছাড়া বেশিরভাগ নাট্যদলের মিলনায়তন পেতে অনেক বেগ পেতে হয় বলে অনেক নাটকের দল তাদের চর্চা ও বিকাশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে না। গুটিকয়েক নাট্যদল শীর্ষস্থানীয় নাট্যদলের কর্তাব্যক্তি ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নেতাদের স্তুতিকরণের মাধ্যমে নাটকের চর্চা অব্যাহত রেখে নিজেদের টিকিয়ে রাখলেও হল পাওয়ার আশায় বেশিরভাগ নাট্যদলই দিনের পর দিন প্রতীক্ষার প্রহর গুনেই যাচ্ছে। থিয়েটারে বিভক্তি ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব মঞ্চনাটককে মারাত্দকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন বিভিন্ন নাট্যদলের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। বিভিন্ন নাটকের দলের ভাঙনের মধ্য দিয়েও এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে নাটকের চর্চার চেয়ে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়েই সংস্কৃতির এই অঙ্গনে নিজেদের আবির্ভূত করেছিলেন বিভিন্ন দলের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। একসঙ্গে নাট্যচর্চা ও নাট্য আন্দোলনের প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করলেও নেতৃত্বের সাধ গ্রহণের প্রত্যাশায় পরবর্তীতে ভাগ হয়ে যায় রাজধানীর বেশ কয়েকটি নাটকের দল। এর মধ্যে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় ভেঙে গঠিত হয় নাগরিক নাট্যাঙ্গন ও নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল, থিয়েটার ভেঙে গিয়ে আরামবাগ, তোপখানা, বেইলি রোড বিভিন্ন নামে থিয়েটারও বিভক্ত হয় কয়েকভাগে। অন্যদিকে লোক নাট্যদল ভেঙে তৈরি হয় 'লোক নাট্যদল (সিদ্ধেশ্বরী), লোক নাট্যদল (বনানী) ও লোক নাট্যদল (টিএসসি)। একইভাবে পদাতিক, মহাকাল, দৃষ্টিপাতসহ অনেক নাটকের দলেই বিভক্তি ঘটে নিজেদের বনিবনা না হওয়া কিংবা নেতৃত্বের সাধ গ্রহণের বাসনায়। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করাতে মাসখানেক আগে দিনব্যাপী পথনাটক পরিষদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। এই নিয়ে নাট্যকর্মীদের মাঝেও রয়েছে চাপা ক্ষোভ। নাটকের দলের ভাঙন নিয়ে খোদ সাধারণ নাট্যকর্মীরাও বিরক্ত এবং বিব্রত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভিন্ন নাট্যদলের বেশ কয়েকজন নাট্যকর্মী জানান, যেসব দল নাট্যব্যক্তিত্বদের আশীর্বাদে পেয়ে থাকে কেবল সেসব নাট্যদলই নাটকের চর্চা ও বিকাশ অব্যাহত রাখতে পারে। নাট্যব্যক্তিত্বরা নাটকের চর্চার তুলনায় নিজেদের নেতৃত্ব নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকাতে নাটকের এই অঙ্গন সমৃদ্ধির পথে এগোতে পারছে না বলেও মন্তব্য করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাট্যকর্মীরা। অন্যদিকে নাট্যচর্চায় পেশাদারিত্ব তৈরির লক্ষ্যে রেপার্টরি পদ্ধতি চালু হলেও সবগুলো দলকে রেপার্টরির আওতায় আনা হচ্ছে না বলে মঞ্চের নির্দিষ্ট গণ্ডি ছাড়িয়ে অভিনয়ে ক্যারিয়ার গড়ার আশায় থিয়েটারে নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীদের অনেকেই বর্তমানে টেলিভিশনের রঙ্গিন ভুবনের পথে পা বাড়িয়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে বাঙালির অহঙ্কার ও গৌরব করার এই ক্ষেত্রটি মর্যাদার আসন থেকে বিচ্যুৎ হতেও খুব বেশি সময় লাগবে না বলে মনে করেন মঞ্চনাটকের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে নাট্যজন কেরামত মওলা বলেন, 'মানুষ অতিমাত্রায় টেলিভিশনমুখী হওয়াতে মঞ্চনাটক দর্শক হারাচ্ছে। দীর্ঘদিন কাজ করার পরও আশানুরূপ চরিত্র না পাওয়ায় দলগুলোতে ভাঙন ধরে। দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে প্রতিটি নাট্যদলের কর্তাব্যক্তিদের আরও নমনীয় হতে হবে'। নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী বলেন, 'দলগুলোতে গণতন্ত্র নেই বলে ভাঙন ঘটে থাকে। দলের শৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রের অভাবেই নাট্যকর্মীরা দলছুট হয়ে নতুন দল গঠন করেন। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে অনেক নাট্যকর্মী দল থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করেন'।