নব্বই দশকের শেষভাগ থেকেই মানসম্মত ছবি পাচ্ছেন না বলে দর্শকের অভিযোগ। স্বাভাবিক সময় তো বটেই, ঈদ উৎসবেও নেই ভালো মানের ছবি। দর্শকের কথায় সারা বছর গতানুগতিক ছবি মুক্তি পায়। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা ঈদের মতো আনন্দ উৎসবে সত্যিকারের বাংলা ছবি দেখে আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে তুলব। কিন্তু তা আর হয় না। অথচ ষাট থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত ঈদে ছবি দেখতে দর্শক সপরিবারে সিনেমা হলে যেত। দর্শক বলছে চলচ্চিত্রকাররা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে, দর্শক এখন ছোট পর্দায় ভিনদেশি চ্যানেলে বন্দী। তাই তারা সিনেমা হলবিমুখ। এ কথা আসলে ঠিক নয়। কারণ ভালো ছবি পেলে দর্শক যে সিনেমা হলে যায় তার অনেক প্রমাণ আছে। 'মনপুরা' ছবির কথাই ধরা যাক। ছবিটি দেখতে শুধু শহরে নয়, গ্রাম-গঞ্জেও দর্শক পরিবেশ নেই এমন সিনেমা হলে পরিবার নিয়ে ছুটে গেছে। তাই আগে মানসম্মত ছবি নির্মাণ করা দরকার। তাহলে শুধু ঈদে নয়, বছর জুড়ে দর্শক সিনেমা হলে ভিড় করবে। দেশীয় ছবির সোনালি দিন ফিরবে। দর্শকের প্রশ্ন, বর্তমানে মান বজায় রেখে ছবি নির্মাণে বাধা কোথায়? এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা। তাদের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
আমজাদ হোসেন
দীর্ঘদিন ধরে দর্শক ঈদ বা স্বাভাবিক সময়েও মনের মতো ছবি পাচ্ছেন না বলে যে অভিযোগ করছেন তার সঙ্গে আমি একমত। কারণ ছবির প্রধান উপাদান হলো গল্প ও চিত্রনাট্য। বর্তমানে ছবিতে গল্পের বড় অভাব। নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ গল্প নিয়ে ছবি নির্মাণ হবে। এতে ফুটে উঠবে আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের নানা সমস্যা। সমস্যা সমাধানের দিক-নির্দেশনাও থাকবে। আর সবই হবে বিনোদনের মাধ্যমে। এটিই চান আমাদের দর্শক। অতীতে এভাবে ছবি নির্মাণ হয়েছে বলেই শতভাগ দর্শক গ্রহণযোগ্যতা মিলত। কিন্তু এখন যারা ছবি নির্মাণ করেন তারা এ বিষয়টির প্রতি কতটা নজর দেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে অনেকেই ভালো মানের ছবি নির্মাণ করছেন। কিন্তু এর পরিমাণ খুবই কম। প্রচার-প্রচারণাও নেই। তাই ভালো ছবিগুলোও দর্শকের নজরে আসে না। আমি মনে করি, শুধু ঈদ উৎসবে কেন, সারা বছরই দর্শককে মানসম্মত ছবি উপহার দেওয়া সম্ভব। কারণ আমাদের দেশে ভালো গল্পকার বা গল্পের অভাব নেই। সুতরাং ভিনদেশি গল্প অনুকরণ বা নকল নয়, নিজস্ব গল্প, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির দিকে নজর দিতে হবে। তাহলে শুধু ঈদে নয়, সবসময়ই দর্শক আমাদের ছবির সঙ্গে থাকবেন।
সুচন্দা
একটা সময় ছিল যখন দর্শক ঈদের দিন আত্দীয়-পরিজনের বাসায় ঘুরে বেড়ানো ও অন্যান্য আনন্দ আয়োজনের সঙ্গে পরিবার নিয়ে ছবি দেখার বিষয়টি ওই দিনের তালিকায় সংযুক্ত করতেন। কারণ ঈদের দিনে ছবি দেখা মানে সবচেয়ে বড় আনন্দের ব্যাপার। এই দিনটায় ছবি না দেখার অর্থ আনন্দে অপূর্ণতা থেকে যাওয়া। আর এই দিকটার প্রতি নজর রেখে নির্মাতারাও উঁচু মানের ছবি নির্মাণ করতেন। এখন যে ভালো মানের ছবি নির্মাণ হয় না তা নয়। তবে নির্মাতারা গল্পের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন না বলেই দর্শক গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যায় না। আমাদের দর্শক সবসময়ই নিজেদের জীবনযাপন ও পারিপার্শ্বিক চিত্র দেখতে চান। আর তা পাওয়া সম্ভব কেবল নিজ দেশের গল্পে। এখনকার বেশির ভাগ ছবিতেই বিষয়টি উপেক্ষিত। অথচ আমাদের দেশে গল্পের কোনো অভাব নেই। পাশাপাশি নির্মাণ এবং পারফরম্যান্সেও রয়েছে দৈন্যতা। তাই গল্পের বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে আগে। চিত্রনাট্যের প্রতিও যত্নবান হতে হবে। গান, চিত্রধারণ, শর্টডিভিশন, এডিটিং এসব বিষয় তো রয়েছেই। লক্ষ্য রাখতে হবে সব কিছুই যেন সময় উপযোগী হয়। সময়জ্ঞান হচ্ছে সাফল্যের মূলমন্ত্র।
শবনম
ছোটবেলায় দেখতাম ঈদের দিন ছবি দেখার জন্য সবার কী ব্যাকুলতা। পরে যখন চলচ্চিত্রে এলাম তখন দেখলাম নির্মাতারা আনন্দ আয়োজন বিশেষ করে ঈদের ছবি নির্মাণে বেশি যত্নবান হতেন। কারণ অন্য সময়ের চেয়ে ঈদের সময় দর্শকের প্রত্যাশা থাকে বেশি। তারা এই দিনটিতে আরও ভালো কিছু দেখতে চান। তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতেন ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই। দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণের আনন্দে সবাই শেয়ার করতাম। তখন ঈদের ছবি মানেই ছিল বিশেষ কিছু। শুধু নির্মাণ নয়, প্রচার-প্রচারণায়ও ছিল সাজ সাজ রব, ভিন্নধর্মী আয়োজন। এখন তেমনটা দেখি না। সব ক্ষেত্রেই উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব। এ অবস্থার কারণ খুঁজে বের করা দরকার। ছবি দেখা মানে শুধু বিনোদন পাওয়া নয়, সামাজিক ও পারিবারিক বহু গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ এতে সনি্নবেশিত থাকে, যা বিনোদনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ফলে বিনোদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সামাজিক ও পারিবারিক নানা বিষয়ে সচেতন হতে পারে। ফলে সবার কাছে ছবি দেখার বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক দিন ধরে দেখছি আমাদের বেশির ভাগ ছবিতে জীবনবোধের অভাব। বিষয়টি নিয়ে ভাববেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা। তারাই পারবেন মান ফেরাতে।
ফারুক
নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে এড়িয়ে কখনো সাফল্য পাওয়া যায় না। আগে ঈদের ছবি দর্শক-মন কাড়ত আর এখন চলে না বা মান নেই। এসব অভিযোগ একেবারে মিথ্যা নয়। ব্যর্থতা আমাদের। আমরা কেন দর্শক ধরে রাখতে পারছি না। নিজেরা গল্প এবং সার্বিক দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কেন ধার করে চলি। তাড়াহুড়ো করা নির্মাণ-মান নষ্টের অন্যতম কারণ। যে কাজে যতটা সময় লাগবে তা দেওয়া প্রয়োজন। যে ছবি নির্মাণে এক বছর সময় দরকার তা এক মাসে শেষ করা কীভাবে সম্ভব। এর ফলে সব ক্ষেত্রেই মানের অভাব দেখা দেয়। এখন উন্মুক্ত বিশ্ব ও প্রযুক্তির যুগ। মানুষকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই সোনালি অতীত এবং সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ফিরে যেতে নিজেদের ঐতিহ্য অাঁকড়ে ধরতে হবে। পাশাপাশি যুগের চাহিদা মেটাতে হবে। কারিগরি দিকের উন্নয়ন করতে হবে। নিজ দেশের গল্প ও সেই গল্পে আমাদের জীবনের কথা থাকতে হবে। গানের ক্ষেত্রেও তাই। এখনো অনেক ভালো কাজ হয়। কিন্তু নিজেদের অসচেতনতার কারণে দর্শক আস্থা হারিয়েছি বলে সেগুলো অলক্ষ্যেই থেকে যায়। তাই সুদিন ফেরাতে সচেতনতার বিকল্প নেই।