২৩ জুলাই, ২০১৯ ১০:২৭

আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি

শওগাত আলী সাগর

আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি

ডানিয়েল কেইন

‘আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’ ৩২ বছরের তরুণী ডানিয়েল কেইন যখন কথাগুলো উচ্চারণ করেন- অদৃশ্য কোনো বেদনাবোধ কি তার অন্তরাত্মাকে ছুঁয়ে দিয়েছিলো।’

আমার জীবনে অবশ্যই এমন একটি মুহুর্ত আছে, যেই মুহুর্তটি তাকে আমার জীবনের বিভীষিকা হিসেবে চিহ্নিত করবে। কিন্তু তাকে আমি একজন মানুষ হিসেবে দেখতে চাই, যে কী না জীবন নিয়ে ঘাতপ্রতিঘাতের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করেছে, কিন্তু কারো কাছ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি। কেউ তার দিকে সহযোগিতার একটি হাত বাড়িয়ে দেয়নি।’
এইটুকু পড়তে পড়তে বুকের ভেতর কোথায় যেনো টাপুরটুপুর বৃষ্টি পড়ার শব্দ হতে থাকে। 
কেইন কি সত্যি সত্যি ফয়সাল হোসাইনের প্রতি এমন মনোভাবই পোষন করে? কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? ৩২ বছরের তরতাজা এক তরুণীর জীবনকে যে একটি বুলেটে হুইরচেয়ারের সাথে লটকে দিয়েছে, সেই ফয়সালের জন্য এমন মমতার কথা মেয়েটা বলে কিভাবে?
থর্ণক্লিফ এলাকার ফয়সালের কথা আপনাদের মনে থাকতে পারে। গত বছরের ২২ জুলাই ডেনফোর্থের গ্রীক টাউনের একটি রেস্তারায় গুলি ছুঁড়েছিলো পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত এই তরুণ। ঘটনাস্থলে ২ জনের মৃত্যু ঘটেছিলো, গুলিবিদ্ধ হয়েছিলো ১৩ জন। কেইন তাদের একজন।
ফয়সালকে মুসলিম সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করেনি কেউ। পুলিশ, কানাডীয়ান মিডিয়া, আক্রান্ত মানুষগুলো কেউ বলেনি- পয়সাল মুসলিম, সে সন্ত্রাসী। এতোগুলো মানুষের জীবনের গতিকে এলোমেলো করে দেয়ার পরও ফয়সাল সহানুভূতিই পেয়েছে। এমন কি কেইনও বলছেন- আমি তাকে একজন মানুষ হিসেবেই দেখি।
কেইনের জীবনটাও যেনো ঠিক সিনেমার গল্পের মতো। নানাঘাত প্রতিঘাতে জীবন যুদ্ধে হার মেনে নিয়েছিলো অল্প বয়সেই। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো আত্মহত্যার। মাত্র ২০ বছর বয়সে জীবনকে নাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া তরুণীটি হঠাৎই প্রেমে পড়ে যায়। ঠিক তখনি ঘুরে যায় তার জীবনের মোড়। নার্সিং এ ভর্তি হয়ে নতুন করে জীবনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। 
ফয়সালের বুলেট যেনো তার জীবনের গতিকে প্রচন্ড বেড়ে ধাক্কা দিয়ে বসলো। বন্ধুর জন্মদিনের উৎসবে যোগ দিতে রেস্তোরাঁটায় গিয়েছিলো কেইন। রেস্তোরার ওয়েটার প্যাটি্ওতে এসে জানান দিলো- রেস্তোরাঁয় শ্যূটার ঢুকেছে। ওয়াইনের গ্লাসটা হাতে নিয়েই রেস্তোরার ভেতরে চলে আসে তারা। 
ঘটনাটা এখানেই শেষ হলো সমস্যা ছিলো না। কিন্তু ভেতরে খবর আসে কেউ একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে বাইরে পড়ে আছে। ইমার্জেন্সির নার্স পিংকসেন পার্টির কথা ভুলে গেলো সোজা বেরিয়ে গেলো গুলিবিদ্ধ মানুষটাকে উদ্ধার করতে। ‘ইমার্জেন্সি ডিউটি নার্স’ কি ব্যক্তিগত সময়েও ইমার্জেন্সি নার্স’ হয়ে যায়! নইলে হুট করে বেরিয়ে গেলো কেন? কেইনও মুহুর্তে পিংকসেনের পিছু নেয়।
কাছাকাছি আলো আধারিতে কাউকে কি দেখলো কেইন- মনে করতে পারে না। শুধু মনে পড়ে- সীসার মতো তপ্ত কিছু একটা তার শরীরের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ’রক্তের উপর শুয়ে আছি’- কেবল এইটুকু মনে করতে পারেন কেইন। 
এক বছর আগের সেই বিভৎস ঘটনাকে স্মরণ করছে আজ টরন্টো। স্মরণ করছে কেইনও। কিন্তু ফয়সালের জন্য তার সামান্য ঘৃনা নেই, বরং আছে অপার সহানুভূতি। ‘আমি শুধু ভাবি মনের ভেতর ভয়াবহ সহিংস চিন্তা ভাবনা নিয়ে ছেলেটা দিনের পর দিন কি নিঃসঙ্গতায় ছটফট করেছে, সহানুভূতির, ভালোবাসার এতটুকু স্পর্শ পায়নি ছেলেটা’…..। গ্রীক টাউনের রেস্তোরাঁয় উন্মাদের মতো গুলি ছুঁড়ে নিজের জীবনকেও উড়িয়ে দিয়েছিলো ফয়সাল হোসাইন। 
আমি শুধু ভাবি, কেইনের ভেতর কি এমন শক্তি আছে, কি এমন পরশ পাথর তৈরি হয়েছে তার মননে- এতোগুলো মানুষকে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া, দুই দুই টা মানুষকে খুন করে ফেলা মুসলিম ছেলেটার জন্য ভিন্নধর্মের একটা মেয়ে এমন মমতার কথা বলতে পারে?

লেখক: প্রকাশক নতুন দেশ।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর