১ এপ্রিল, ২০২০ ১২:১১

''পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, জানি না কার ভাগ্যে কী আছে?''

আমিনুল ইসলাম

''পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, জানি না কার ভাগ্যে কী আছে?''

আমিনুল ইসলাম

আজ ১৭ দিন একটানা ঘরে বন্দী হয়ে আছি। এক মুহূর্তে'র জন্য ঘরের বাইরে যাওয়া হয়নি।

কতো কি মনের মাঝে ভেসে উঠছে।

আচ্ছা - আমাদের চেনা এই পৃথিবীটা কি আবার আগের জায়গায় ফেরত যাবে?

আবারও কি আমরা মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াতে পারব প্রিয়জনদের সাথে নিয়ে?

এই মহামারী কি আমাদের সঠিক শিক্ষাটা দিয়ে যাবে, নাকি আমরা এক'ই থেকে যাবো?

খুব মনে হচ্ছে নিউইয়র্কে থাকা বন্ধু'টির কথা। আমাদের দুই জনের জীবনাদর্শ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

আমি আজীবন মেনে এসেছি এবং আমার হাজারো লেখায় লিখেছি- পৃথিবীতে আমরা খুব কম সময়ের জন্য আসি। তাই সীমার মাঝে থেকে যতটুকু সম্ভব উপভোগ করে নিতে হবে। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কখনো'ই বর্তমান'কে হারিয়ে ফেলা যাবে না! কারণ সেই রঙিন ভবিষ্যৎ হয়ত কোন দিন'ই দেখা দিবে না।

আমার বন্ধু'টা! আহা, আমেরিকায় গেল। কতো হবে বয়েস ৩৭-৩৮ হবে হয়ত! ট্যাক্সি চালাত সে। শেষ যে বার কথা হয়, আমি তাকে বলেছিলাম

-আমার এখানে এসে ঘুরে যা।

উত্তরে সে বলেছিল, ''এখন না। আরও কিছুদিন বেশি বেশি কাজ করে নেই। কিছু টাকা-পয়সা জমাই। বউ-বাচ্চা আছে; ওদের কথাও তো চিন্তা করতে হবে। আরও কিছু টাকা-পয়সা হোক, এরপর বউ-বাচ্চা নিয়ে যাবো তোর ওখানে। ব্যাংক ব্যাল্যান্সেরও তো দরকার আছে। গাড়ি-বাড়িরও তো দরকার আছে।''

আমি বলেছিলাম

-এতো কাজ করে কি করবি? এতো টাকা জমিয়ে'ই বা কি করবি? ভবিষ্যতের কি কোন ঠিক আছে? চলে আয় ঘুরতে। ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে দেখা যাবে।

ওর আর আমার এখানে আসা হলো না। করোনাভাইরাস ওর জীবন'টাই কেড়ে নিয়েছে।

আমি এমন অনেক মানুষকে জানি, যারা কেবল ছুটে বেড়াচ্ছে রঙিন জীবনের আশায়। জানি না করোনভাইরাসের পর তাদের এই উপলব্ধি হবে কিনা- জীবন খুব ছোট। রঙিন ভবিষ্যতের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা আমাদের বর্তমানকেই হারিয়ে ফেলি। রঙিন ভবিষ্যত আর ধরা দেয় না; মাঝখান থেকে আমাদের জীবনটাই হারিয়ে যায়।

পৃথিবীর স্বর্গ বলে পরিচিত ইউরোপ মহাদেশে প্রতিদিন শয়ে শয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। সংখ্যাটা হয়ত হাজারে হাজারে। প্রকৃত সংখ্যা হয়ত এই মুহূর্তে জানা সম্ভবও না। তবে এটা বুঝতে পারছি- দিন দিন পরিস্থতি খুব খারাপ হচ্ছে।

আচ্ছা, চেনা পৃথিবীটা আগের জায়গায় ফেরত যাবে তো?

এর মাঝেও বোধ করি আমরা স্বপ্ন দেখি। এইতো গত দুই ধরে আমার এখানে মাস্টার্সের ছাত্র'দের থিসিস ডিফেন্স চলছে। অন-লাইনে'ই ওরা ডিফেণ্ড করছে। আমরা শিক্ষক'রা আমাদের মতামত দিচ্ছি।

পৃথিবীর নানান দেশ থেকে আসা এই ছেলেপেলেগুলো হয়ত এসেছিল একটা রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে। পৃথিবীকে জয় করার স্বপ্নও হয়ত ওদের ছিল। কাল যখন ডিফেন্সে আমি এই ছেলেপেলেগুলো'কে গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে নিজের মতামত দিচ্ছিলাম, কখনো কখনো হয়ত ওদের কাজ দেখে খানিক রেগেও যাচ্ছিলাম; তখন মনে হচ্ছিলো

- আচ্ছা আমাদের এই পৃথিবী আগের জায়গায় ফেরত আসবে তো?

২০-২৫ বছর বয়সি এই ছেলেপেলেগুলো তাদের চেনা পৃথিবীতে আবার ফেরত যেতে পারবে তো? গবেষণা করার যেই শিক্ষা তারা এখন নিচ্ছে, সেটা কাজে লাগাতে পারবে তো?

মানব সভ্যতা তো কোন দিন পরাজিত হয়নি। তাহলে কেন আমরা এই অবস্থায় এসে দাঁড়ালাম? কেন আমরা সভ্য মানুষগুলো মানুষ'কে বাঁচিয়ে রাখার গবেষণা বাদ দিয়ে কি করে মানুষ মারতে হয় সেই গবেষণায় সফল হলাম?

এইতো আজ'ই জানতে পারলাম আমেরিকার পারমাণবিক বিমানবাহী রণতরী রুজভেল্ট এই মুহূর্তে আছে গুয়ামের সমুদ্র তীরে। এই রণতরীতো তৈরি করা হয়েছে মানুষ মারার জন্য। পৃথিবীর নানান দেশে এই রণতরী থেকে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত করা হয়েছে; মানুষ হত্যা করা হয়েছে!

আজ কিনা সেই রণতরী'র ক্যাপ্টেন বাঁচার জন্য আকুতি করে বলছে

-আমাদের বাঁচান। আমাদের ৪০০০ নাবিকের ১০০ জনের উপর করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। আমাদের বাঁচান এক্ষুণি। নইলে আমরা কেউ বাঁচব না!

এটা তো সেই রণতরী, যাকে বলা হতো পৃথিবীর সব চাইতে শক্তিশালী বিমানবাহী জাহাজ। যার কাজ ছিল মুহূর্তে'ই হাজার হাজার মানুষ হত্যা করা।

তারাই কিনা আজ বেঁচে থাকার জন্য আকুতি জানাচ্ছে!

আচ্ছা, আমরা আমাদের চেনা পৃথিবীতে ফেরত যাবো তো?

কাল বিকেলে হঠাৎ একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। আমার ফেসবুকে মোট প্রায় ৫০০০ বন্ধু আছে। এর আগে কখনো এমন বোধ করিনি। কাল হঠাৎ মনে হলো- ফেসবুক বন্ধুদের অনেক আত্মীয় স্বজন মারা যাচ্ছে। অনেকে'ই লিখেছে- তাদের বাবা-মা কিংবা অন্য আত্মীয় স্বজন মারা গিয়েছে। অবশ্য স্বাভাবিক মৃত্যু'র কথা'ই তারা লিখছে।

কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো- এই মৃত্যু'র সংবাদগুলো কেন যেন গত দুই দিনে আমার ফেসবুকে আমি বেশি পাচ্ছি! এর সাথে করোনার কোন সম্পর্ক নেই তো?

এরপর মনে হলো- হয়ত ১৭ দিন একটানা বাসায় থাকতে থাকতে এইসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করছি। এইসব কিছু'ই হয়ত না। অন্যদেরও কি এমন মনে হচ্ছে?

আচ্ছা, আমরা কি আবারও আমাদের চেনা পৃথিবীতে ফেরত যেতে পারব?

আমি যেই শহরে থাকি, তালিন নামক ছোট্ট এই শীতল শহরে গতকাল রাতেও তুষার পড়েছে। জনমানবহীন রাস্তা গুলো শ্বেতশুভ্র তুষারে ঢেকে গিয়েছে। আমি জানালার পর্দা টেনে এই দৃশ্য দেখে লিখতে বসেছি-

আচ্ছা, আমাদের চেনা পৃথিবীতে আবারও ফেরত যেতে পারব তো?

আমাদের শহরের পরিস্থিতিও দিন দিন খারাপ হচ্ছে। পরিষ্কার বুঝতে পারছি পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। জানি না কার ভাগ্যে কী আছে? যদি বেঁচে থাকি, তাহলে চেনা পৃথিবীতে ফেরত যেতে পারব তো?

এরপর হঠাৎ মনে হলো- চেনা পৃথিবীতে ফেরত যাবার কি আদৌ দরকার আছে?

আমরা না হয় আমাদের পৃথিবীটাকে আরও ভালোবাসা এবং মায়াময় করে গড়ে তুলব।

যেখানে যে কেউ, যে কাউকে ভালবাসতে পারবে। সেই ভালোবাসার কথা বলতে পারবে। সেই ভালোবাসা নিয়ে কেউ হাসিঠাট্টা করবে না।

যেখানে মানুষ মারার জন্য কেউ গবেষণা করবে না। কিভাবে মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা যায়; সেই গবেষণা হবে।

যেখানে মানুষজন অর্থ-সম্পদ, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, ভালো রেজাল্ট এইসবের পেছনে ক্রমাগত ছুটে বেড়াবে না।

বেঁচে থাকবে স্রেফ বর্তমান সময়টুকু'কে উপভোগ করার জন্য।

যেখানে আমাদের ভালোবাসার মানুষ সব রকম সঙ্কোচ ভুলে মুক্ত বাতাসে আমাদের হাত ধরে হাঁটবে, শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবে- ভালোবাসি! হোক না সে অন্য রকম ভালোবাসা, ক্ষতি কি তাতে।

আমরা কেউ কি বুঝতে পেরেছিলাম- যেই ভাইরাস চোখে পর্যন্ত দেখা যায় না; সেই ভাইরাস প্রবল পরাক্রমশালী দেশ আমেরিকা এবং তার পারমাণবিক রণতরী'র ক্যাপ্টেনকে পর্যন্ত নামিয়ে আনবে এক কাতারে- যেখানে তারা বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছে! আর সেই দৃশ্যও আমাদের দেখতে হবে?

এই ভাইরাস আমাদের সকল'কে এক জায়গায় নামিয়ে এনেছে।

মানুষে-মানুষে ভেদাভেদের যেই সমাজ আমরা গড়ে তুলেছিলাম; সেই সমাজ বরং ভেঙে যাক।

আমরা না হয় নতুন সমাজ গড়বো- যেই সমাজে আমার মতো মানুষকে, আমার ভালোবাসার মানুষ, হাজারো মানুষের সামনে জড়িয়ে ধরে বলতে পারবে - ভালোবাসি।

কে জানে, আমি বেঁচে থাকবো কিনা। কিংবা অন্য আরও অনেকে বেঁচে থাকবে কিনা!

কিন্তু যারাই শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাবো, আমরা সবাই মিলে মায়াবী এই পৃথিবী'কে না হয় আরও অনেক বেশি মায়াময় হিসেবে গড়ে তুলবো।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর