রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩ ০০:০০ টা

দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই

'৭০-এর নির্বাচনে দেশের ৯৮ ভাগ মানুষ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করার পরও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী জনরায় মেনে নেয়নি। শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। আসলে তারই পরিণতিতে '৭১-এ শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালির আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। গণতান্ত্রিক শাসন, শোষণ-বঞ্চনা মুক্ত অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থার জন্য '৭১-এ আমরা লড়াই করেছি। বাংলাদেশ স্বাধীনও হয়েছে এসব মূল্যবোধের ওপরই। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতেই হয়, এখন দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। দেশে এখন যা চলছে তাকে এক কথায় বলা যেতে পারে গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক স্বৈরাচার।

এটা ঠিক, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন দেশ ও নিজস্ব ভূখণ্ড পেয়েছি। ঠিকানা পেয়েছি। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কিন্তু আমরা যে আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তা বাস্তবায়িত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হলে, দেশের বর্তমান অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, আজ সবাইকে সহনশীল হতে হবে। ছাড় দেওয়ার জন্য সবার অবস্থান থেকে একটু একটু করে সরে আসতে হবে। বুঝতে হবে দেশের মালিক কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল নয়। দেশের প্রকৃত মালিক জনগণ। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান দেখাতে হবে। আজ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তানের কাঠামোয় '৭০-এর নির্বাচন নিয়েও তেমনই সংকট দেখা দিয়েছিল। পার্থক্য এই যে '৭০-এর সংকট দেখা দিয়েছিল নির্বাচন হওয়ার পর। এবার ২০১৩ সালে সংকট দেখা দিয়েছে নির্বাচনের আগেই। উভয় সংকটের কারণ প্রায় একই। '৭০-এ সব মানুষ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করেছিল। ন্যায়ত বাঙালির হাতে পাকিস্তানিদের শাসনক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা তারা দেয়নি। তারা অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেছিল। নিপীড়ন করে বাঙালিকে দমন করতে চেয়েছিল। তবে সেই শাসকগোষ্ঠী ছিল পশ্চিমা, ভিনদেশি। আজকের শাসকগোষ্ঠীও তাদের কায়েমি স্বার্থ ধরে রাখার জন্য পাতানো নির্বাচন করেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাচ্ছে, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

আমার মনে হয় যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটা একেবারেই একটি বিচিত্র ঘটনা। পৃথিবীর আর কোথাও একটি নিরস্ত্র আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নিয়ে এত তাড়াতাড়ি সাফল্যের নজির আছে বলে আমার জানা নেই। এ আন্দোলনে সবচেয়ে বড় গৌরব নিরস্ত্র নেতারা সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। আবার ব্যর্থতারও মূল কারণ মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব যে নেতাদের হাতে ছিল তারা কেউ-ই রণাঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। সে জন্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধা-অসুবিধা, ত্যাগ-তিতিক্ষা কখনো সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ওপরের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব মোটামুটি চলার মতো হলেও মাঝারি থেকে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। স্থানীয় নেতাদের যেখানে কম-বেশি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা ছিল, তারা তেমন কেউ-ই থাকেননি। তাদের তেমন কারোরই প্রত্যক্ষ যুদ্ধে কোনো অবদান বা ভূমিকা নেই। যুদ্ধটা আরেকটু দীর্ঘস্থায়ী হলে ওই নেতারা একেবারেই হারিয়ে যেতেন। যুদ্ধ ক্ষণস্থায়ী হয়েছে বলে ওইসব ব্যর্থ রাজনৈতিক নেতা স্বাধীনতার পর দেশে ফিরেই মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের জন্য সম্মান না করে; নিজেদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে নাজেহাল করেছেন, যার পরিণতিতে স্বাধীনতার পর পরই একটা মারাত্দক অশান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদিকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের জন্মের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পর পরই একটি জাতীয় বিভক্তি দেখা দিয়েছিল, যে কারণে স্বাধীনতার মূলনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার পথ ত্বরান্বিত হয়। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে জাতীয় ঐক্যের, সম্মিলিতভাবে দেশকে গড়ে তোলার সম্ভাবনা অনেকাংশেই সুদূরপরাহত হয়ে পড়ে, যার ফল আমরা এখনো ভোগ করছি। কতকাল ভোগ করতে হবে কেউই তা জানি না।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ ছিল। এর মধ্যে মুখ্য কারণ ছিল বৈষম্য। পাকিস্তানের নাগরিক হওয়ার পরও আমরা নাগরিক অধিকার পাইনি। আমরা ছিলাম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। কিন্তু সংখ্যালঘু হয়েও তারা আমাদের সঙ্গে দাসের মতো আচরণ করত। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যাই। এরপর আমাদের মাতৃভাষার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। আমরা ছিলাম পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬%, অথচ জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। ২৪ বছরের পাকিস্তানে কোনো বাঙালি প্রেসিডেন্ট হতে পারেনি। দু-এক জন যারা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তারাও ছিলেন পাকিস্তানিদের লেজুড়। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি '৫৬ সালে আওয়ামী লীগের ১৩ সদস্য নিয়ে ১৩-১৪ মাসের মন্ত্রিসভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে নির্বাচিত সেই সরকারের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আমাদের গোলাম বানিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। সেই দাসত্বমুক্তির সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার অপরাধে এ ভূখণ্ডের গণজাগরণের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। কিন্ত তারা সফলকাম হয়নি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য বীরত্বপূর্ব ঘটনার রচনাকারী আমার অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের এ দেশের মানুষ ভালোবেসে ডাকত কাদেরিয়া বাহিনী বলে। এ সময় আমাদের সশস্ত্র সদস্য ছিলেন ১৮ হাজার আর নিরস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন ৭২ হাজার। ১৬ আগস্ট ধলাপাড়ার সম্মুখযুদ্ধে আমি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান থেকে পিছু হটে যাইনি। আমাদের যোদ্ধারাও হানাদারদের বিরুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করেছেন। আমরা নিজস্ব উদ্যোগে দেশের অভ্যন্তরে থেকেই অস্ত্র সংগ্রহ করেছি। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের আগ পর্যন্ত আমরা টাঙ্গাইল জেলাসহ পাশের সিরাজগঞ্জ, পাবনা, জামালপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে প্রায় ৯০ বর্গমাইলের বিস্তীর্ণ এলাকা হানাদারমুক্ত রেখেছিলাম। এমনকি ডিসেম্বরে ভারতীয় ছত্রীসেনা অবতরণের আগেই আমরা ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জাতীয় বিজয়ের সংহতি রক্ষার স্বার্থে সে পরিকল্পনা থেকে সরে এসে সম্মিলিত আক্রমণে শরিক হই। অনেক শহীদের আত্দদান, অনেক রক্ত ও দেশের মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় এসেছে।

মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য '৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর আমি কাদের সিদ্দিকী একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি বীর উত্তম খেতাব লাভ করি। অনুলিখন : আহমদ সেলিম রেজা

 

 

সর্বশেষ খবর