মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

উপমন্ত্রী জয়ের যত তুঘলকি কাণ্ড, সচিবালয়ে ক্ষোভ

নিজামুল হক বিপুল

উপমন্ত্রী জয়ের যত তুঘলকি কাণ্ড, সচিবালয়ে ক্ষোভ

যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় তার মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম-সচিবের কক্ষে ভাঙচুর ও আরেক সিনিয়র সহকারী সচিবের কক্ষে তালা দেওয়ার ঘটনায় সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দিনভর ছিল আলোচনা। মন্ত্রণালয়ের ক্যান্টিনগুলোতেও উপমন্ত্রী জয়ের এমন তুঘলকি কর্মকাণ্ড নিয়ে সরব আলোচনা হয়েছে। তবে উপমন্ত্রীর নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চাপা অসেন্তাষের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। মন্ত্রণালয়ের ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে একাধিক বৈঠক করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। বিষয়টি নিয়ে তৎপর দেখা গেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদেরও। অন্যদিকে যুগ্ম-সচিবের কক্ষে ভাঙচুরের ঘটনায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সিনিয়র সচিবদের মাধ্যমে গতকাল প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন উপমন্ত্রী  জয়ের বিরুদ্ধে। এছাড়া মন্ত্রিসভার একাধিক সিনিয়র সদস্যও বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, এমন ঘটনা অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর আগেও তিনি এমন অস্বাভাবিক আচরণ করেছেন। এদিকে গতকাল দিনভর উপমন্ত্রী জয়ের নানা কর্মকাণ্ড নিয়েও আলোচনা ছিল মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে। দিনভর সরেজমিন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জয়ের নানা অপকর্মের কথা জানা গেছে। তবে  কোনো এক অজানার ভয়ে কেউই উপমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খুলে কোনো কথা বলতে চাননি। তাদের প্রত্যেকের চোখে মুখেই ছিল উপমন্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ ও অসন্তোষ। তারা বলেছেন, উপমন্ত্রীর অত্যাচার বন্ধ না হলে মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকাণ্ডই বৃথা যাবে। কারণ, উপমন্ত্রীর অকথ্য আচরণের জন্য নিজেদের মান সম্মানের ভয়ে এবং জীবন রক্ষার জন্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তা মন্ত্রণালয় ছেড়ে অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন।  নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এমন কোনো অপকর্ম নেই যার সঙ্গে উপমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা নেই। এমনকি তার পরিবারের সদস্যরাও মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দফতরগুলোতে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাসহ নানা অপরাধ করে যাচ্ছেন। আর কারণে-অকারণে মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কাজে উপমন্ত্রীর বাগড়া দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জানা গেছে, উপমন্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণের কারণে মন্ত্রিসভার গত ২৬ অক্টোবরের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধমকও দিয়েছিলেন উপমন্ত্রী জয়কে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উপমন্ত্রী জয়ের হুমকি-ধামকি আর নানামুখি অত্যাচারে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন মন্ত্রণালয়ের অধীন উপজেলা কর্মসংস্থান জোরদার প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) হারুন অর রশীদ। প্রায় চার মাস আগে তিনি মন্ত্রণালয় থেকে অন্যত্র বদলি হন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের হস্তক্ষেপে। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এই প্রকল্পের কাজ নিজের লোকজনদেরকে পাইয়ে দিতে প্রকল্পের পিডিকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখান উপমন্ত্রী। এ কারণেই তিনি মন্ত্রণালয় ছাড়েন। একইভাবে মন্ত্রণালয়ের অধীন ১১টি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. নবীরুল ইসলামকে ভয়ভীতি দেখান উপমন্ত্র্রী। এখানেও প্রকল্পের টেন্ডার তার কথা মতো করার জন্য এবং প্রকল্পের কাজ নিজের লোকজনদেরকে দিতে প্রকল্প পরিচালককে  বিভিন্নভাবে চাপ দেন জয়। এক পর্যায়ে তিনি পিডির বাসায় নিজের লোকজন পাঠিয়ে শাসিয়েছেন এবং হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে পিডি নবীরুল ইসলাম মাস কয়েক আগে প্রকল্পের দায়িত্ব তো ছেড়েছেনই, সঙ্গে মন্ত্রণালয়ও ছেড়ে গেছেন।  গত অর্থ বছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নামে থোক বরাদ্দ দেওয়া ৫০ কোটি টাকা ফেরত গেছে উপমন্ত্রী জয়ের কারণে। তিনি এ সংক্রান্ত একটি ফাইল গায়েব করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ওই থোক বরাদ্দের অনুকূলে মন্ত্রণালয় থেকে সারা দেশে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছিল মন্ত্রণালয়। সেই আলোকে একটি ফাইলও তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সব ডেস্ক ঘুরে ফাইলটি সচিবের দফতর হয়ে যখন উপ-মন্ত্রী জয়ের দফতরে যায় তারপর থেকেই সেটি গায়েব হয়ে যায়। ফাইলের বিষয়ে জয়ের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় যোগাযোগ করলে উপমন্ত্রী জানান, ফাইলটি অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরে দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দফতরে খোঁজ করেও ওই ফাইলের আর কোনো হদিস পাননি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। শুধু এই ফাইলই নয়, মন্ত্রণালয়ের অনেক ফাইলেই কারণে-অকারণে উপমন্ত্রী বাগড়া দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সচিব নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা অসংখ্যবার চেষ্টা করেও ওই ফাইলের কোনো হদিস পাইনি। ফাইলটি একেবারেই গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। মাস কয়েক আগে ফিফা থেকে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সুইজারল্যান্ড পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে চিঠি দেয় ফিফা কর্তৃপক্ষ। ওই চিঠি পেয়ে বাফুফে কর্তৃপক্ষ চারজন প্রতিনিধির নাম চূড়ান্ত করে জিও (সরকারি আদেশ) এর জন্য চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু উপমন্ত্রী জয় সেখানে বাগড়া দেন এবং আরও একজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে চাপ দেন। ফিফার চাহিদার বাইরে কোনো সদস্যকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বার বার উপমন্ত্রীকে বুঝানো হলেও তিনি সেটা মানতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় চার জনের স্থলে পাঁচ জনের নামে জিও করে। যাতে উপমন্ত্রীর নির্দেশে শেষ জন হিসেবে সিলেটের বিয়ানীবাজার স্পোর্টিং ক্লাবের কর্মকর্তা মো. সেলিম উদ্দীনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে মন্ত্রণালয়। পরবর্তিতে ঢাকাস্থ সুইজারল্যান্ড দূতাবাস পঞ্চম জনের বিষয়ে আপত্তি জানায় এবং জানিয়ে দেয় তাকে তারা ভিসা দেবে না। কিন্তু নাছোড়বান্দা উপমন্ত্রী সুইস দূতাবাসে নিজে একটি মুচলেকা দেন এই মর্মে যে, এই ব্যক্তি (সেলিম) সফর শেষে দেশে ফিরে আসবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে দেশেতো ফিরেইনি, উল্টো সুইজারল্যান্ডে থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজছে। এ বিষয়টি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত অবহিত। আর উপমন্ত্রী এখন বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাচ্ছেন।  উপমন্ত্রী জয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত যুব উন্নয়ন অধিদফতরকে তিনি শ্রমিক লীগের কার্যালয় বানিয়ে ফেলেছেন। তার আস্কারা পেয়ে অধিদফতরের ভিতরেই শ্রমিক লীগের লোকজন কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তাদের ভয়ে সারাক্ষণই তটস্থ রয়েছেন অধিদফতরের কর্মকর্তারা। শ্রমিক লীগের উৎপাতে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের কর্মকর্তারা স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না।  এর বাইরে আরিফ খান জয়ের বিরুদ্ধে আরও অসংখ্য অভিযোগ-অনুযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তিনি যখন তখন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তার কক্ষে ডেকে নিয়ে নানাভাবে অপদস্থ করেন, গালিগালাজ করেন। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষোভ-অসন্তোষ বিরাজ করছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে। কোনো কর্মকর্তাকে তার অপছন্দ হলেই তিনি সেই কর্মকর্তাকে জামায়াত-বিএনপি’র চর বলে প্রচার করেন। মন্ত্রণালয়, যুব উন্নয়ন অধিদফতর ও জাতীয় ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিদফতরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের দরপত্র আহ্বান করলেই উপমন্ত্রী তার পরিবারের সদস্য ও নিজেদের লোকজনকে কাজ পাইয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। শুধু তাই নয়, তার দুই-তিন ভাই যুব উন্নয়ন অধিদফতর ও জাতীয় ক্রীড়া সংস্থায় গিয়ে হুমকি ধামকিও দেন। আরেকটি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে উপমন্ত্রী জয়ের বিরুদ্ধে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খুব শিগগির যুব উন্নয়ন অধিদফতর থেকে একটি টিম যাবে মাল্টাতে। সেই টিমে অন্তর্ভুক্ত হতে ইচ্ছুক এমন দুই তরুণীকে নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে যান উপমন্ত্রী।  এরপর ওই দুই তরুণী মাল্টা যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত করলেই আরও অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে।  এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল উপমন্ত্রী জয়ের দফতরে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।   এদিকে রবিবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মুশুক মিয়ার দফতরে ভাঙচুর ও সিনিয়র সহকারী সচিব গোলাম কবীরের কক্ষে উপমন্ত্রীর তালা দেওয়ার ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গতকাল সারা দিনই বিক্ষুব্ধ ছিলেন। যুগ্ম-সচিব তার আরও কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে বৈঠকও করেছেন। তারা সচিবের সঙ্গে দেখা করে মন্ত্রণালয়ের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ চেয়েছেন। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব নূর  মোহাম্মদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আমার কাছে এসেছিলেন। আমি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি।

 

সর্বশেষ খবর